Home Second Lead ইন্টারনেট সেবা: সমন্বয়হীনতা ও ভোগান্তি

ইন্টারনেট সেবা: সমন্বয়হীনতা ও ভোগান্তি

ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের অভিযানে সংযোগ তার কেটে দেয়ার প্রতিবাদে ঢাকার ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ১৮ই অক্টোবর থেকে প্রতিদিন সকাল ১০ থেকে বেলা ০১টা পর্যন্ত ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে।

এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এবং ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে ইন্টারনেট সেবা গ্রাহকরা নানা ধরণের হয়রানির মুখে পড়ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

গত ১০ই অগাস্ট ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ফজলে নূর তাপস, ডিসেম্বরের মধ্যে দক্ষিণ সিটিকে তারের জঞ্জালমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন।

যার অংশ হিসেবে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে ঝুলে থাকা বাড়তি তার কেটে ফেলার উদ্যোগ নেয়। এর অংশ হিসেবে অনেক জায়গায় তার কেটে ফেলার কাজ শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার ধানমন্ডি এলাকার একাংশে কেবল বা তার কাটার কাজ চলছিল।

এবিষয়ে আইএসপিএবি- এর পরিচালক নাজমুল করিম ভূঁইয়া বলেন, “আমরা ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেয়ার পক্ষে নই। তবে সিটি কর্পোরেশন বলছে যে বিকল্প ব্যবস্থা আমাদের করে নিতে হবে। তবে ঢাকা শহরে এই ধরণের কোন বিকল্প ব্যবস্থা নেই। যার কারণে এই প্রতিবাদ।”

তবে সিটি কর্পোরেশন বলছে, ‘মাথার উপর দিয়ে তার নেয়া অবৈধ’।

ভোগন্তিতে গ্রাহকেরা

রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডি এলাকার বাসিন্দা ফারহানা মাহবুব। তিনি একজন চাকরিজীবী। সেই সাথে তার দুটি স্কুল পড়ুয়া সন্তান রয়েছে।

মিসেস মাহবুব জানান, করোনাভাইরাসের কারণে একদিকে সন্তানদের স্কুলের ক্লাস চলছে অনলাইনে। আর সেই সাথে নিজেকেও বাড়িতে থেকে অফিস করতে হয়।

তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশনের অভিযানের অংশ হিসেবে ঝুলন্ত তার কেটে দেয়ার কারণে এ পর্যন্ত চার বার ইন্টারনেট সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হয়েছে তাকে। প্রতিবারই একবার ইন্টারনেট সংযোগ চলে যাওয়ার পর এক থেকে দুদিন পর পর সংযোগ এসেছে।

মিসেস মাহবুব বলেন, ইন্টারনেট সংযোগ না থাকার কারণে সন্তানদের অনলাইন ক্লাস ও পরীক্ষা ব্যাহত হচ্ছে। দুই বাচ্চার ক্লাস এক সাথে শুরু হলে ঝামেলা হয়ে যায়। একটি মোবাইল দিয়ে দুই জনের পক্ষে ক্লাস করা সম্ভব হয় না। কারণ, ব্রডব্যান্ড না থাকায় মোবাইল অপারেটরদের ইন্টারনেট প্যাকেজ ব্যবহার করতে হয়। ওরা চিল্লাচিল্লি শুরু করে। সেই সাথে নিজের অফিসের কাজও ব্যাহত হয় বলে জানান তিনি।

পরীবাগ এলাকার বাসিন্দা শুচিস্মিতা তিথি বলেন, এ পর্যন্ত তিন বার ইন্টারনেট সংযোগ পরিবর্তন করেছেন তিনি। কিন্তু এর পরও নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ পান নি তিনি। পরে জানতে পেরেছেন যে, সিটি কর্পোরেশন থেকে একাধিকবার তার কেটে দেয়ার কারণে এ ধরণের সমস্যায় পড়েছেন তিনি।

শুচিস্মিতা তিথি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরী করেন। যার কারণে হোম অফিস করতে গেলে প্রায়ই তাকে সমস্যায় পড়তে হয় বলে জানান।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী উম্মে হানি তামিমা বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধ থাকলেও অনলাইনে ক্লাস করতে হচ্ছে তাকে। তবে তার কাটার কারণে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় এবং স্লো স্পিডের ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হচ্ছে তাকে।

“দেখা যায় যে পরীক্ষা চলছে, এর মধ্যে ইন্টারনেট নেই। তখন ঝামেলায় পড়ে যাই।”

সিটি কর্পোরেশন-আইএসপি পারস্পরিক দোষারোপ

তবে গ্রাহকদের এমন ভোগান্তির জন্য পরস্পরকে দুষছে সিটি কর্পোরেশন এবং ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।

সিটি কর্পোরেশন একদিকে অভিযোগ করছে যে ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলো তাদের কাছ থেকে অনুমোদন নেয়নি। আর ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, এ বিষয়ে পরিষ্কারভাবে কোন প্রক্রিয়ার কথা জানাচ্ছে না সিটি কর্পোরেশন।

এছাড়া বিকল্প কোন ব্যবস্থা না করেই কেবল বা তার কেটে দেয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তারা।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের বলেন, “মাথার উপর দিয়ে কেবল বা তার নেয়াটা এমনিতেই অবৈধ। অনেক বছর ধরে এটা চলে আসছে। আর এখন এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলেও উল্টো সেটার পক্ষেই সাফাই আসছে।”

কেবল মাথার উপর দিয়ে না নিয়ে বিকল্প ব্যবস্থা করার দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের নয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।

তিনি জানান, দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন প্রায় সব অঞ্চলে কেবল কাটার কাজ চলছে। এর মধ্যে শান্তিনগর, ধানমন্ডি, সিটি কলেজ, নগরভবনের চারপাশ, ওয়ারি, মুগদা এলাকায় কেবল কাটা হয়েছে। বাকি এলাকাগুলোতেও কাটা হবে।

“অনুমতি নিতে হলে সিটি কর্পোরেশনের কাছে আবেদন করতে হবে। সেখানে কিছু শর্তের বিনিময়ে অনুমতি দেয়া হবে। যার মধ্যে অন্যতম শর্ত হবে, তার মাথার উপর ঝোলানো যাবে না, মাটির নিচে হতে হবে এবং সিটি কর্পোরেশনকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ রেভিনিউ দিতে হবে।”

অনুমতি নেয়াটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার এবং এই সময়ের মধ্যে বিকল্প কি ব্যবস্থা হতে পারে এমন প্রশ্নের উত্তরে মি. আবু নাছের বলেন, ব্রডব্যান্ড ব্যবহারের পরিবর্তে অভিভাবকরা মোবাইল ফোন ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে।

“৫০০ টাকায় ৪০ জিবি ইন্টারনেট পাওয়া যায়। মাথার উপর দিয়ে যাওয়ার কারণে ইন্টারনেট নেই এবং এর কারণে অনলাইন ক্লাস বাধাগ্রস্ত হওয়ার অভিযোগ একটা মিস কনসেপ্ট এবং মানুষকে ভুল পথে ধাবিত করার অপপ্রয়াস।”

“আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলোর ট্রেড লাইসেন্সও সিটি কর্পোরেশনই দিয়ে থাকে। তবে এক্ষেত্রে ট্রেড লাইসেন্স অনেকগুলো অনুমোদনের একটা অংশমাত্র”।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের বলেন, “ট্রেড লাইসেন্স করা মানেই সে বিজনেসের বৈধতা পেয়ে গেলেন তা নয়।”

তবে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- আইএসপিএবি’ এর মহাসচিব ইমদাদুল হক বলেন, “কর্তৃপক্ষ বা নীতিনির্ধারক যারা রয়েছেন তাদেরকে আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে আমাদেরকে কত জায়গা থেকে অনুমতি নিতে হবে। বিটিসিএল আমাদের লাইসেন্স দিয়েছে, সিটি কর্পোরেশন ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে।”

তারা মনে করছেন আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে নানা ধরণের সমস্যায় পরছেন তারা।

“প্রত্যেকটা অপরাটেরকে বছরে ২৫ লাখ টাকা করে সিটি কর্পোরেশনকে দেয়ার একটা প্রস্তাব আমাদের কাছে এসেছে। কিন্তু আমাদের অনেক অপারেটর রয়েছে যাদের মূলধনই ২০ লাখ টাকা নয়। সে কিভাবে বছর শেষে এতো টাকা দেবে।”

ইন্টারনেট সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন তাদের সাথে বৈঠক করে মাথার উপরে থাকা কেবল গুলোর বিষয়ে সমাধানে এসেছে। যার কারণে উত্তর সিটিতে মেইন রোড গুলো থেকে কেবল সরিয়ে নেয়া সম্ভব হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য রাস্তা থেকেও সরিয়ে নেয়া হবে।

তবে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের সাথে বার বার চেষ্টা করেও বৈঠকের কোন ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না বলে জানান তিনি।

এছাড়া সিটি কর্পোরেশন থেকে নতুন করে অনুমতি নিতে হলে অনেক সময় লাগবে এবং গ্রাহকদেরকে ইন্টারনেট সেবা দেয়াও বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন তারা।

উন্নত বিশ্বে বিদ্যুৎ সংযোগের মতো ইন্টারনেট বা স্যাটেলাইট সংযোগও রাস্তার নিচে লাইন টেনে বাড়িতে বা অফিসে সরবরাহ করা হয়। এজন্য তাদের কোন তার বাইরে থেকে দৃশ্যমান থাকে না।

কিন্তু বাংলাদেশে এখনও এমন কোন পরিপূর্ণ অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মাটির নিচে এই নেটওয়ার্কিং-এর ব্যবস্থা করলেও সেটার পরিধি সীমিত।

মূলত তারা ঢাকার মূল কয়েকটি সড়কের নীচ দিয়ে একটি কেন্দ্রীয় নেটওয়ার্কিং ব্যবস্থা তৈরি করেছে। সার্ভিস প্রোভাইডাররা নির্দিষ্ট ভাড়ার বিপরীতে সেই নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা ব্যবহার করলেও বাড়ি বাড়ি ইন্টারনেট বা স্যাটেলাইট সংযোগ পৌঁছে দেয়ার সময় ওই বিদ্যুতের খুঁটির ওপর দিয়েই তার টানতে হয়।

মাথার উপর ঝুলে থাকা তার ভূগর্ভস্থ ব্যবস্থায় সংযুক্ত করতে ভূগর্ভস্থ কমন নেটওয়ার্ক অর্থাৎ নেশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক-এনটিটিএন ব্যবস্থা করেছে সরকার। দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এই সুবিধা দিতে ১০ বছর আগে লাইসেন্স পায় এবং কাজ শুরু করে। তবে এরপরও পুরো ঢাকা শহর এখনো এই নেটওয়ার্কের আওতায় আসেনি।

এ বিষয়ে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- আইএসপিএবি’ এর মহাসচিব ইমদাদুল হক বলেন, শুধু মেইন রোডগুলোতে এই নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়েছে। সবগুলো হাউজহোল্ডগুলোতে এই সুবিধা নেই। যার কারণে চাইলেও সব তার ভূগর্ভস্থ ভাবে নেয়া সম্ভব নয়।

এই সমস্যার কারণে অনেক স্থাপনাই ইন্টারনেট সংযোগ সেবা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।

এ বিষয়ে আইএসপিএবি- এর পরিচালক নাজমুল করিম ভূঁইয়া বলেন, “বিটিসিএল বা সরকারি কোন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আমরা এখনো এনটিটিএন নেটওয়ার্কের কোন অফার আমরা পাই নাই। যেভাবে আমরা দিতে পারবো।”

-বিবিসি