- আহ্রার হোসেন
- বিবিসি বাংলা, ঢাকা
“নবিতুন? নবিতুন দেহি ডাঙ্গর হইয়া গ্যাছে!” সারেং বউ ছবির নবিতুন চরিত্রে অভিনয় করা কবরীকে দেখার পর নায়ক ফারুকের প্রথম সংলাপই ছিল এটি।
১৯৭৮ সালে কবরীর সারেং বউ যখন মুক্তি পায়, তখন তিনি ‘ডাঙ্গর’-ই বটে। এরই মধ্যে তিনি অভিনয় করে ফেলেছেন ত্রিশটি ছায়াছবিতে। রাজ্জাকের সাথে তাঁর জুটি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে।
কিন্তু চৌষট্টিতে মুক্তি পাওয়া প্রথম ছবি ‘সুতরাং’-এ যখন তিনি অভিনয় করতে যান, তখন তার বয়স ছিল মোটে তেরো। জরিনা-রূপী সুতরাং-এর মূল নায়িকা যে স্রেফ একটি বালিকা – তা এই ছবিতে একেবারেই লুকনো যায়নি।
অথচ এই ছবিতে তাকে এক পর্যায়ে ‘গর্ভবতী’ হতে হয়। এমনকি এই ছবিতে জরিনার বাচ্চা হবার দৃশ্যও ছিল।
“গামছার মধ্যে তুলো ভরে পেটের ওপর লাগিয়ে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছিল – পেট যেন বড় দেখায়” – কবরী লিখেছেন তাঁর স্মৃতিচারণমূলক ‘স্মৃতিটুকু থাক’ গ্রন্থে।
চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গি বাজারের মিনা পাল তখন তার মায়ের ভাষায় ‘দুধের বাচ্চা’। শরীরে নারীত্বের কোন চিহ্নই ফুটে ওঠেনি।
তখনো তিনি কোনদিন পরেননি বক্ষবন্ধনী। সুতরাং-এ অভিনয় করার জন্য চট্টগ্রাম থেকে প্রথম ঢাকায় যাচ্ছেন।
কিছুতেই মা রাজি হচ্ছেন না। বিলাপ করে কাঁদছেন-‘আমার দুধের বাচ্চাকে আমি দেব না, সিনেমায় গেলে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে, নষ্ট করে ফেলবে’, লিখেছেন কবরী।
বিবিসি বাংলাকে ২০১১ সালে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে কবরী বলেছিলেন, “আমি তখন এমনই ছোট আমার সামনের একটা দাঁত পোকায় ধরা ছিল। মাত্রই দুধের দাঁত পড়েছে আমার। তখন আমি বাড়িতে কয়লা দিয়ে দাঁত মাজতাম। এই প্রথম ঢাকায় আসা।”
আর স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ‘স্মৃতিটুকু থাক’-এ তিনি লিখেছেন: “ঢাকায় এসে প্রথম টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত মাজি। প্রথম ব্রা পরি”।
“সুতরাং-এ কাজ করবার সময় পিঠে টাইট করে কী যেন বেঁধে দেয়, তার ওপর ব্লাউজ। পেটিকোট কোমরে ফিতা দিয়ে আটকানো। তার ওপর শাড়ি। রীতিমতো আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে নায়িকা বানানো হচ্ছে”।
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত কবরীর লেখা প্রথম গ্রন্থ ‘স্মৃতিটুকু থাক’।
কীভাবে হয়েছিলেন সুতরাং-এর নায়িকা?
“কী দেখে বা কী ভেবে দত্তদা আমাকে চলচ্চিত্রে নিলেন আমি আজও ভেবে পাই না। আমি যে কী রকম দেখতে ছিলাম – ফর্সা না কালো, লম্বা না বেঁটে, সুন্দরী না পচা, আমার নাক বোঁচা নাকি খাড়া মনেও পড়ে না” – লিখেছেন কবরী।
১৯৬৩ সালে সুতরাং ছবির পরিচালক সুভাষ দত্ত – যিনি এই ছবির নায়কের চরিত্রেও অভিনয় করবেন – একজন নায়িকা খুঁজছিলেন ছবির জন্য।
সিনেমার সঙ্গীত পরিচালক সত্য সাহা ছিলেন চট্টগ্রামের লোক। তার মাধ্যমেই মেলে মিনা পালের খোঁজ। মিনা পালই কবরীর পিতৃপ্রদত্ত নাম।
২০১১ সালে বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে কবরী বলেছিলেন, “আমার কখনোই ইচ্ছে ছিলো না অভিনয় করার। একেবারেই ছোটবেলায় যখন আমি সিক্স থেকে সেভেনে উঠেছিলাম, তখনই আমি সুতরাং চলচ্চিত্রে আসি”।
সুভাষ দত্ত তখন প্রধান অভিনেত্রী খুঁজে বের করার জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন।
“সেই সময়ে আমাদের পরিবারের সাথে ওই সিনেমার পরিচালক সত্য সাহা যোগাযোগ করেন। তিনি সুভাষ দত্তের খুব কাছের লোক ছিলেন। তাদের ছবির অনেক কিছুই আগে ঠিক করা ছিলো। শুধু ছবির যিনি প্রধান অভিনেত্রী হবেন সেই চরিত্রে তারা একজন কিশোরী অভিনেত্রী খুঁজছিলেন” – বিবিসিকে বলেছিলেন কবরী।
এক পর্যায়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় কিছু ছবি চালাচালির মাধ্যমে প্রাথমিক নির্বাচন হয়।
এরপর ঢাকায় এসে অডিশন দেন। ফ্রক পরে বাবা ও বোনের সাথে ঢাকায় এসেছিলেন কবরী। উঠেছিলেন সদরঘাটের কাছে বিউটি বোর্ডিংয়ে।
পরিচালক সুভাষ দত্ত অডিশনের সময় শাড়ী পরা অবস্থায় দেখতে চাইলে তার ফ্রকের ওপরেই পরিয়ে দেয়া হয়েছিল শাড়ি।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই তের বছর বয়সে তিনি নায়িকা হিসেবে নির্বাচিত হয়ে গেলেন প্রথম ছবিতে।
একটি সাইনিং মানিও পেয়েছিলেন তিনি। এক হাজার এগারো টাকার সেই সাইনিং মানি কবরীর জীবনের “প্রথম রোজগার।
শুরু হয়ে গেলো নতুন জীবনের গল্প”। ২০১৭-র স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থে লিখেছেন কবরী।
“ফিল্মে কাজ করতে চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গী বাজারে বেড়ে ওঠা কিশোরী মিনার নাম বদলে দত্তদা রাখলেন – কবরী”।
“রুপালি পর্দায় নায়িকা কবরী নামই হয়ে গেল আমার নতুন জীবনের পরিচয়। আমিও ধীরে ধীরে মিনার খোলস পাল্টে কবরী মোড়কে বন্দি হয়ে গেলাম”।