ড.শরীফ আস্-সাবের
করোনা ভাইরাস এখন একটি আতংকের নাম। এর বিস্তার রোধে এবং আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় ডাক্তারদের ভূমিকা সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ। তবে, এই আপদকালীন সময়ে অনেক চিকিৎসকই প্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম বা পিপিই (Personal protective equipment) ছাড়া ভইরাস আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন। কোথাও কোথাও নিরাপদ দুরত্ব বজায় রাখার স্বার্থে রোগীকে রশি দিয়ে তৈরি আবেষ্টনীতে রেখে দূর থেকে চিকিৎসা সেবা প্রদানের চেষ্টা করা হচ্ছে (প্রথম আলো, ২৪ মার্চ, ২০২০)। এরই মধ্যে কানাডা ফেরত গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল জটিলতায়আক্রান্ত একজন রোগীকে করোনাভাইরাসের রোগী ঠাউরে বিনা চিকিৎসায় মেরে ফেলায় আলোচনা সমালোচনার ঝড় উঠেছে দেশে ও বিদেশে।
এ কথা সত্য, ডাক্তারদের পেশায় প্রচুর ঝুঁকি বিদ্যমান। তাঁরা সংক্রামক ব্যাধিগ্রস্থ রোগী থেকে শুরু করে মানসিকভাবে অসুস্থ ও খুন খারাবিতে জখমি রোগীদের চিকিৎসাও করেন। পরিশ্রমও করেন প্রচুর। এই সব জেনে শুনেই তাঁরা ডাক্তারি পেশায় আসেন। এজন্যে তাঁদের কদর, সম্মান ও আয়ও অনেক পেশার চাইতে তুলনামূলকভাবে বেশী।
এই ভাইরাস পরিস্থিতিতে ব্যক্তিগত সুরক্ষা(প্রটেকশন) ও অন্যবিধ সুবিধাদি বিষয়ে ডাক্তারদের দাবী অযৌক্তিক নয়। বিশেষ করে, এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রনের ফ্রন্টলাইনে যেই সব ডাক্তার, নার্স ও চিকিৎসাকর্মীরা কাজ করছেন তাঁদের অবশ্যই ব্যক্তিগত সুরক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। তবে, সরকারী হাসপাতালগুলিতে পিপিই’র সরবরাহ অপ্রতুল এবং এর প্রায় সবই এককালীন ব্যবহার্য (one time use)।
যখন দেশের চিকিৎসকসহ সবাই পিপিই স্বল্পতাকে ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং চিকিৎসার একটি প্রধান অন্তরায় মনে করে এ বিষয়ে সরকারের আশু সহায়তা কামনা করছেন, দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী তখন পিপিই’র তেমন প্রয়োজন নেই বলে দাবী করেছেন। অবশ্য সেতুমন্ত্রী করোনা নিয়ন্ত্রনে সরঞ্জামের ঘাটতি আছে জানালেও পররাষ্ট্র মন্ত্রী করোনাভাইরাস মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের কাছে মেডিকেল সরঞ্জাম চেয়েছে মর্মে বিবৃতি প্রদান করেছেন।
এই প্রসঙ্গে অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের সবারই এই মুহূর্তে প্রটেকশন দরকার। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, এই প্রটেকশন দেশের নাগরিক হিসাবে সকলের সাংবিধানিক অধিকার। ডাক্তার, নার্স, আমলা ছাড়াও সকল খেটে খাওয়া মানুষের দরকার প্রটেকশন। যাঁরা ময়লা আবর্জনা পরিস্কার করছেন, বাজারে তরি-তরকারী বিক্রি করছেন, রাস্তার পাশে বসে ফলমূল বিক্রি করছেন, জুতা পলিশ করছেন, কলে কারখানায় শ্রম দিচ্ছেন, বাসের হেল্পার কন্ডাকটারের কাজ করছেন, রাস্তায় দাঁডিয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রন করছেন, ব্যাংকের কাউন্টারে বসে লেনদেন করছেন, হাসপাতালের ট্রলি ঠেলছেন, চিঠিপত্র বিলি করছেন, এঁদের সবারই প্রটেকশন দরকার। এমন কি বাজারের ক্রেতা থেকে শুরু করে সাংবাদিক যাঁরা ঝুঁকি নিয়ে বাজার করছেন কিংবা ভাইরাসের ভয় মাড়িয়ে ভীড় ঠেলে প্রকৃত অবস্থা উপলব্ধি করতে চাইছেন, তাঁদেরও প্রটেকশন দরকার। গোটা দেশ এখন প্রটেকশনের কাঙ্গাল।
বলাই বাহুল্য, পুরো তিন মাস ধরে করোনা ভাইরাস তার ভীতি ছড়াচ্ছে। অনেকেই মনে করেন, এরই মধ্যে চিকিৎসকেরা পরিস্থিতি আঁচ করে এর মোকাবেলায় প্রস্তুতি নিতে পারতেন – নিজ খরচে একক বা যৌথ উদ্যোগে যোগার করে রাখতে পারতেন পরিমিত পরিমানে পিপিই। অবশ্য এই দায়িত্ব শুধু চিকিৎসকদের একার নয় – সরকারেরও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি থাকা বাঞ্ছনীয় ছিল। এ বিষয়ে জাক্তারদের সংগঠন, বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশন (বিএমএ) কোন সুনির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করেছে বলেও আমার জানা নেই। তা ছাড়া, ফারমাসিউটিক্যাল কোম্পানি আর প্যাথলজির ল্যাবগুলো অনৈতিক কমিশন বিতরণ না করে ডাক্তারদের মধ্যে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পিপিই সরবরাহ করতে পারতো বলে অনেকেই মনে করেন।
এ কথা সত্য, আমাদের দেশে অনেক মানবদরদী চিকিৎসক আছেন যাঁরা অনেক প্রতিকুলতার মধ্যেও সততা ও পেশাদারিত্ব বজায় রেখে কাজ করে যাচ্ছেন। আমি মনে করি, এই প্যানডেমিক তাঁদের কর্তব্যপরায়নতা, নীতিবোধ এবং সেবার মানসিকতাকে জনসমক্ষে তুলে ধরার এক সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করেছে। সরকারের জন্য অপেক্ষা না করে জরুরী বিবেচনায় তাঁরা স্ব-উদ্যোগে পিপিই’রব্যবস্থা করতে পারেন এবং আপাতত: কাজ চলে সেই রকম ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম সংগ্রহ ও ব্যবহার করতে পারেন। নিজ প্রয়োজন মিটানোর পর নার্সসহ তাঁদের সহায়ক কর্মীদের মধ্যেও তাঁরা এইসব সরঞ্জাম বিতরণ করতে পারেন।
আমার জানা মতে, অনেক চিকিৎসকই ইতোমধ্যে নিজেদের জন্য পিপিই সংগ্রহ করেছেন এবং চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন -যদিও এঁদের অধিকাংশই প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন কিংবা বেসরকারী ক্লিনিক বা হাসপাতালে কাজ করেন। সরকারী হাসপাতালই যাঁদের একমাত্র ভরসা, দেশের সেইসব সাধারণ, নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য অবশ্য তা তেমন আশাব্যঞ্জক নয়।তবে অনেক ডাক্তারই ঝুঁকি নিয়ে সরকারী হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে কাজ করে যাচ্ছেন।
এদিকে চীন থেকে ফ্রন্টলাইন ডাক্তারদের জন্য মাত্র ১০ হাজার পিপিই আসছে। অথচ, হিসাব অনুযায়ী আগামী তিন মাসে করোনা সংক্রান্ত চিকিৎসা চালানোর জন্য কমপক্ষে ৫০ লক্ষ পিপিই দরকার বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হচ্ছে, দেশে পিপিই’র চরম সংকট বিরাজ করছে যা সহসা সমাধান হবার নয়। এমতাবস্থায়, পিপিই’র অপ্রতুলতাহেতু সংক্রমনের ভয়ে অনেক চিকিৎসক কর্মস্থলে যাওয়া থেকে বিরত রয়েছেন। দেশের এই আপদকালীন সময়ে চিকিৎসা সেবা হ্রাস পেলে কিংবা বন্ধ হয়ে গেলে দেশ এক চরম দুর্যোগের মুখে পতিত হবে আর চোখের সামনে রোগী মারা যাবে বিনা চিকিৎসায়। যে কোন বিবেকবান মানুষ অন্যের বিপদে এগিয়ে আসবে, এটাই তো স্বাভাবিক মানবধর্ম। কখনো কখনো মানুষ নিজের জীবন বিপন্ন করেও আগুন-পানিতে ঝাপিয়ে পড়ে বিপদগ্রস্তকে উদ্ধার করার জন্য। তাই চিকিৎসকদের কাছে বিনীত অনুরোধ, আপনারা জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে অসহায় রোগীদের আশাহত করবেন না, প্লিজ।
যাই হউক, এ বিষয়ে এ মুহূর্তে দরকার দ্রুতলয় সমন্বিত উদ্যোগের। চিকিৎসকদের মধ্যে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাবোধ ও আস্থা ফিরে না এলে দেশের করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা করা হয়ে উঠবে প্রায় অসম্ভব। সরকারের স্বাস্হ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্হ্য অধিদপ্তর, স্থানীয় প্রশাসন এবং বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশন (বিএমএ) কে এই আপদ মোকাবেলায় এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। সরকারী অনুদানের জন্য অপেক্ষা না করে বিএমএকে প্রয়োজনে সকল ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য পিপিই সরবরাহের উদ্যোগ নিতে হবে। বিভিন্ন এনজিওসহ দেশের ফারমাসিউটিক্যাল কোম্পানি, প্যাথলজি ল্যাব এবং ক্লিনিক ব্যবসায়ী্দেরও এ বিষয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত।
সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, দেশে ইতোমধ্যে স্বল্প খরচে পিপিই তৈরী শুরু হয়েছে এবং দেরীতে হলেও সরকার পিপিইর উপর থেকে আমদানী শুল্ক রহিত করেছে। এমতাবস্থায়, সরকার, বিএমএ এবং চিকিৎসকরা নিজ দায়িত্বে দেশীয় সরবরাহকারীদের কাছ থেকে কম খরচে পিপিই ক্রয় বা সংগ্রহ করতে পারবেন। তবে, এটি মনে রাখতে হবে সংক্রমণ ঠেকাতে শুধু ডাক্তার নয়, চিকিৎসা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত সকল নার্স ও অপরাপর স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদেরও পিপিই পরিধান নিশ্চিত করতে হবে। সেই সাথে জনসাধারণকে মেনে চলতে হবে করোনা স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ক যাবতীয় সরকারী বিধিমালা। অন্যথায় দেশের করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে আর জনবহুল বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হবে লক্ষ লক্ষ মানুষ।
========
লেখক অস্ট্রেলিয়ার আরএমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।