*শো-ডাউন’ করেছে বেশকিছু গণপরিবহন
*অর্ধেক যাত্রী’ পরিবহন সড়কের নতুন বিষফোঁড়া!
বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি
চট্টগ্রাম: টানা তিন দফার নিষেধাজ্ঞাতেই বন্ধ ছিল গণপরিবহন। আজ বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া চতুর্থ দফার কঠোর নিষেধাজ্ঞায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন চালু হলেও প্রথম দিনেই হেরফের।
যেখানে বলা হয়েছিল গাড়ির আসন সংখ্যার অর্ধেকের (৫০%) বেশি যাত্রী বহন করা যাবে না সেখানে গাড়িতে তোলা হচ্ছে সিট সংখ্যকের চেয়েও বেশি যাত্রী। এতেই থেমে থাকেনি নিচ্ছে ডাবল ভাড়াও।
স্বাস্থ্যবিধি মানার নির্দেশনা থাকলেও তা মানার কোনো কোনো কিছু দেখা যায়নি।
রাস্তায় চলাচলরত বাস বা স্টাফ বাসে ছিল না হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা জীবাণুনাশকের মতো কোনো সুরক্ষা সামগ্রী। শুধুমাত্র কয়েক সড়কে সিটের দূরত্ব বজায় রাখলেও আর কোনও স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই।
অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মানার মতো মনস্তত্ত্ব ও পরিবেশ আমাদের এখানে নেই। সুতরাং আমরা আরো বড় রকমের ঝুঁকির দিকে এগুচ্ছি।
এমনিতেই গণপরিবহন সংকটের কারণে নাজুক চট্টগ্রাম নগরীর ট্রাফিক ব্যাবস্থাপনার চিত্র। তার উপর ‘অর্ধেক যাত্রী’ পরিবহনের নির্দেশনা যেন সড়কের নতুন বিষফোঁড়া!
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ধরণের সিদ্ধান্ত সময় উপযোগী কিন্তু নগরীর জর্জরিত ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার কারণে এসব সিদ্ধান্ত মেনে চলা সম্ভব নয়। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বরঞ্চ সৃষ্টি হবে গণরোষ।
এদিকে স্বাস্থ্য বিধির প্রথমেই বলা হয়েছে, পাশাপাশি দুইটি আসনের একটিতে যাত্রী বসে অন্যটি ফাঁকা রাখতে হবে। কিন্তু কোনো আসন ফাঁকা না রেখেই শুধুমাত্র ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানার চেষ্টা করছে গণপরিবহনে। নিরাপদ দূরত্ব না মেনে শুধু ব্লিচিং পাউডার ছিটানো ও মাস্ক ব্যবহার করায় সংক্রমণ ঝুঁকি বাড়ছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বাসে আসন সংখ্যা বরাবর যাত্রী নেয়া হচ্ছে। বাসে প্রবেশের সময়ে পানিতে মেশানো ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে জীবাণুমুক্ত থাকার চেষ্টা করছেন। রাস্তায় বাসের সংখ্যা আগের তুলনায় অনেকটাই কম হলেও সিএনজি ও টেম্পু চলাচল প্রায় স্বাভাবিক হয়েছে। কিছু কিছু সিএনজি’ও গণপরিবহনের মতো ব্যবহৃত হচ্ছে। সব পরিবহনেই নিরাপদ দূরত্বের কোনো বালাই মানা হচ্ছে না। এছাড়া যাত্রীদের সবাই মুখে মাস্ক রেখেছেন। তারমধ্যে কেউ কেউ মুখের মাস্ক চিবুকে আটকে রেখে নাক-মুখ খোলা রেখেছেন।
বাসে চড়ে ইপিজেড থেকে একেখান মোড়ে যাওয়া একজন যাত্রীকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘কাজ কর্পোরেট অফিসে করলেও বেতন পাই সরকারি অফিসের পিয়নের সমান। এ অল্প টাকা পেয়ে রিজার্ভ সিএনজি নিয়ে অফিসে যাতায়াত করা সম্ভব না। যা হবে, তা দেখা যাবে। করোনার জন্য হাত গুটিয়ে বসে থাকলে পেটের খিদায় মারা যাবো।’
ইপিজেডএ এলাকায়ও কিছু গণপরিবহনে শুধু শারীরিক দূরত্বে বসার মাধ্যমেই স্বাস্থ্যবিধি সীমাবদ্ধ ছিল। বেশিরভাগ গণপরিবহনের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই ছিলো না।
সরেজমিনে আরো দেখা যায়, বন্দরনগরীর কাঠগড় এলাকায় গার্মেন্টস এর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্টাফ বাসের অধিকাংশেই ছিল না শারীরিক দূরত্ব। আগের মতই গাদাগাদি করে বাসের ভেতর যাত্রী পরিবহন করতে দেখা গেছে। গাড়ির প্রবেশ মুখে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও জীবাণুনাশক রাখার কথা থাকলেও তা দেখা যায়নি। এতে অনেককেই ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে।
অনেকেই জানিয়েছেন, শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে গণপরিবহনে চলাচলের নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে তা মানা হচ্ছেনা। গাড়ির প্রতিটি আসনে এমনকি ড্রাইভারের পাশে থাকা মেশিনের উপর বসেও যাত্রী চলাচল করতে হচ্ছে।
অন্যদিকে গণপরিবহনগুলোর অবস্থা আরো করুন। স্বাস্থ্য বিধি মানবে দূরের কথা কার আগে কে গাড়িতে উঠবে সেই প্রতিযোগিতা ছিল যাত্রীদের। তাছাড়া গাড়ির ড্রাইভার ও হেলপারের মাঝেও স্বাস্থ্য সচেতনতার বিষয়টি ছিল উপেক্ষায়। কিছু কিছু গাড়ী চালকের মুখে মাস্ক পর্যন্ত দেখা যায়নি। কিছু গাড়ি ব্যতিক্রম থাকলেও তাতে শুধু আসন ফাঁকা ছাড়া অন্য স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়নি।
ক্যানপার্কে গার্মেন্টস কর্মী আসাদ জামান বিজনেসটুডে২৪কে বলেন, বাসে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে না কেউ। শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা হচ্ছে না। জীবাণুনাশক স্প্রেও করা হচ্ছে না। স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব এখন শুধু কথা আর কাগজ কলমেই সীমাবদ্ধ। এই পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতে কি ঘটবে তা বলা মুশকিল। এক বাস শ্রমিক বিজনেসটুডে২৪কে বলেন, ‘সীমিত পরিসরে হলেও সরকার গণপরিবহন চালু করেছে। এতে আমরা খুশি। আয় বেশি না হলেও খেয়ে তো বাঁচতে পারব। আরেক শ্রমিক হাসান মিয়া বলেন, সরকার যে নির্দেশনা দিয়েছে তা মেনেই বাস চালানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে যাত্রীদের চাপ সামলানো কঠিন হয়ে পড়ছে।’
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি বেলায়েত হোসেন বলেন, আজকে প্রায় ২২ দিন পরে ৭০ ভাগ গণপরিবহন সড়কে নেমেছে। কাউন্টার সার্ভিসে শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে। লোকাল সার্ভিসের ক্ষেত্রে কিছু কিছু যাত্রী, চালক ও সহকারীর অসচেতনতা মাঝেমধ্যে দেখা যাচ্ছে। যদিও প্রশাসন কঠোরভাবে স্বাস্থ্য সুরক্ষা মানার বিষয়টি তদারকি করছেন।
চসিকের কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমন বিজনেসটুডে২৪কে বলেন, ‘যাত্রীরা যারা আছেন তাদেরও স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতন হওয়া জরুরি। গাড়িতে কী সুবিধা ভোগ করবেন, কোনটা স্বাস্থ্যবিধির লঙ্ঘন সেটাও যাত্রীদের জানা জরুরি।’
জানা যায়, ৬০ লাখ মানুষের বন্দর নগরীতে গণ পরিবহনের সংখ্যা সাড়ে ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার।
অন্যদিকে যাত্রী কল্যাণ সংস্থা বলছে, স্বাভাবিক অবস্থায় এই নগরীতে এসব গণপরিবহন ব্যবহার করার জন্য প্রতিদিন নগরীতে নেমে আসেন ২৫ থেকে ৩০ লাখ যাত্রী। সহজ সমীকরণে বলা চলে, গণ পরিবহনের প্রতি সিটের বিপরীতে আছেন কমপক্ষে ৯ থেকে ১১ জন যাত্রী। তবে বর্তমান করোনাকালে স্কুল-কলেজগুলো এখনো পর্যন্ত বন্ধ থাকার কারণে এই চাপ কিছুটা কম।
সড়কের এমন নাজুক অবস্থায় করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে ‘অর্ধেক যাত্রী’ নেওয়ার নির্দেশনা বাস্তবে কতটুকু কার্যকর সম্ভব? এমন প্রশ্নের উত্তরে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বিজনেসটুডে২৪কে বলেন, ‘মোটেও সম্ভব নয়। এই পরিস্তিতি বড়জোড় ২/৪ দিন পর সব আগের মত লেজে গোবরে হয়ে যাবে।’