Home চট্টগ্রাম চট্টগ্রামের মেহেদী হত্যার রহস্য যেভাবে উদঘাটন হলো

চট্টগ্রামের মেহেদী হত্যার রহস্য যেভাবে উদঘাটন হলো

রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকায় পাওয়া এক মৃতদেহের ব্যাপারে অনুসন্ধান চালিয়ে শেষ পর্যন্ত ওই হত্যা রহস্য উন্মোচন করা হয়েছে কুড়িয়ে পাওয়া এক টুকরো ছেঁড়া কাগজের মাধ্যমে।

পুলিশ বলছে, সপ্তাহ খানেক আগে হাতিরঝিল থেকে অজ্ঞাতনামা এক যুবকের অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করে তাদের একটি দল।

মরদেহটির হাত-পা রশি দিয়ে বেধে এটি বিছানার চাদর, মশারি আর পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে হাতিরঝিল লেকের মেরুল-বাড্ডা প্রান্তে ফেলে দেয় হত্যাকারীরা। সেখান থেকেই মরদেহটি উদ্ধার করে পুলিশ।

তবে মরদেহটিকে যাতে শনাক্ত করা না যায়, সেজন্য হাতের আঙুল ও চেহারা বিকৃত করে দিয়েছিল হত্যাকারীরা।

হত্যা সম্পর্কিত ক্লু’র খোঁজে মৃতদেহের চারপাশ খুঁজতে থাকে হাতিরঝিল থানা পুলিশ। লেকের যে স্থানে এ মৃতদেহটি ভেসে ছিল, শেষ পর্যন্ত সেখান থেকে প্রায় ৫০ মিটার উত্তরে একটি ছেঁড়া কাগজ পায় পুলিশ।

সেটিতে লিখে রাখা একটি মোবাইল ফোন নম্বরের সূত্র ধরে পুরো হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ধার করে তারা।

এই ঘটনার তদন্ত করেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তেজগাঁ শিল্পাঞ্চল এলাকার অতিরিক্ত উপ-কমিশনার হাফিজ আল ফারুক।

একটি ছেড়া কাগজ থেকে কিভাবে এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করা হল – এমন প্রশ্নের উত্তরে এডিসি হাফিজ আল ফারুক বলেন, হত্যাকারীরা নিহত ব্যক্তির মোবাইল ফোনটি লাশটি ফেলে দেয়ার সময় সাথে করে নিয়ে এসেছিল। ওই মোবাইল ফোনটি নতুন হওয়ার কারণে সেটি যাতে ভুল না হয় সেজন্য নম্বরটি কাগজে লিখে রেখেছিল হত্যাকারী। আর ওই কাগজটি দিয়েই মোড়ানো ছিল নিহতের মোবাইল ফোনটি, জানান তিনি।

হত্যাকারী মরদেহটি ফেলে দেয়ার পর কিছু দূরে গিয়ে মোবাইল ফোনটিও পানিতে ছুড়ে ফেলে দেয়। কিন্তু মোবাইলটি পানিতে পড়ে ডুবে গেলেও কাগজটি হালকা হওয়ার কারণে পানিতে না পড়ে পানির কাছাকাছি মাটিতে পড়ে।

মি. ফারুক বলেন, লাশটি ফেলে দেয়া হয় বিকেল সাড়ে চারটার দিকে। পুলিশ খবর পেয়ে সাতটার দিকে গিয়ে লাশটি উদ্ধার করে। আর ঘণ্টা খানেক পরে গেলে হয়তো কাগজটি নাও পাওয়া যেতে পারতো। তবে এরপরেও হত্যা রহস্য উদঘাটন করা যেতো বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।

“কোন ক্লুলেস ঘটনাই আসলে শেষ পর্যন্ত আর ক্লুলেস থাকে না,” বলেন তিনি।

পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত সন্দেহে চার জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বর্তমানে তারা জেলে রয়েছেন। এদের মধ্যে তিন জন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন।

এডিসি মি. ফারুক জানান, নিহত ওই যুবকের নাম আজিজুল ইসলাম মেহেদী। তার বয়স ২৪ বছরের মতো। তিনি চট্টগ্রামের ইসলামী ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ছিলেন, তবে তার বাবা যুক্তরাষ্ট্রে থাকতেন।

পড়াশুনার পাশাপাশি কানাডা যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন তিনি। সেই সূত্র ধরে এলাকার পরিচিত মানুষেরা পাসপোর্ট সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তার কাছে যেতো। পাসপোর্টে কারো নাম বা বয়স যদি ভুল থাকতো, তাহলে সেগুলো ঠিক করার কাজে সহায়তা করতেন ওই যুবক। এর বিনিময়ে তিনি আর্থিক সুবিধা নিতেন বলেও পুলিশ জানায়।

ঢাকায় যে ব্যক্তির মাধ্যমে আজিজুল ইসলাম এই কাজগুলো করতেন তিনি ছিলেন তার বাল্যবন্ধু, যার সঙ্গে তিনি এক সময় চট্টগ্রামের একটি মাদ্রাসায় পড়াশুনা করেছেন।

ওই ব্যক্তি মূলত ঢাকায় গুলশানের একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করতেন। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারির সময় রেস্টুরেন্টের চাকরি হারান তিনি। আর্থিক কষ্টে পড়ে স্ত্রীর এক দূর সম্পর্কের ভাইয়ের কাছে টাকা ধার চান, যিনি পাসপোর্টের দালাল চক্রের সাথে জড়িত বলে জানায় পুলিশ। তবে টাকা ধার না দিয়ে পাসপোর্ট সংক্রান্ত কাজের করার প্রস্তাব দেয় ওই দালাল এবং এই কাজ থেকে যে টাকা আসবে, তা আধাআধি ভাগ করে নেয়ার প্রস্তাবও দেয়া হয়।

পুলিশ জানিয়েছে যে ওই সাবেক রেস্টুরেন্ট কর্মী, যাকে এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তখন চট্টগ্রামে থাকা তার বাল্যবন্ধু আজিজুল ইসলাম মেহেদীর সাথে যোগাযোগ করে। মি. ইসলাম তখন তাকে তিনটি পাসপোর্টের কাজ দেয়, যেগুলোতে শুধু নাম ও বয়সের ত্রুটি নয়, বরং বয়স ছয় বছর পর্যন্ত কমানোর বিষয় ছিল। এই কাজগুলো করা জন্য টাকাও দেয়া হয়।

কিন্তু পাসপোর্ট অফিসের দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণির এক কর্মচারী ওই কাজগুলো করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও তিনি কাজটি করতে পারেননি, বরং করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে টাকাগুলো খরচ করে ফেলেন রেস্টুরেন্ট কর্মী, জানিয়েছে পুলিশ।

তারা বলছেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ না হওয়ায় আজিজুল ইসলাম মেহেদী পাসপোর্ট ও টাকা ফেরত চান এবং এরপরই তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে ওই দুই ব্যক্তি।

পুলিশের এডিসি হাফিজ আল ফারুক বলেন, হত্যা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মেহেদীকে নতুন একটি মোবাইল নম্বর নেয়ার পরামর্শ দেয়। সাথে এটাও বলে যে ওই নম্বর যাতে তারা ছাড়া আর কেউ না জানে। এরপর চট্টগ্রাম থেকে ওই যুবক ঢাকা এলে তাকে খাবারের সাথে মিশিয়ে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো এবং পরে তাকে হত্যা করা হয়।

পুলিশের ওই কর্মকর্তা জানান, হত্যাকারীদের পরিকল্পনা ছিল যে মতিঝিল এলাকা থেকে খিলক্ষেত এলাকার মধ্যে যেকোন এক জায়গায় আজিজুল ইসলাম মেহেদীর লাশ ফেলে দেয়া। তার ফোন নম্বরটি যেহেতু নতুন ছিল, তাই সেটি একজন সন্দেহভাজন হত্যাকারী লিখে রাখে।

পুলিশ বলছে, তাদের পরিকল্পনা ছিল যে লাশ ফেলে দেয়ার পর নতুন ওই নম্বরটিতে পথচারীদের কারো ফোন থেকে কল করা বা এসএমএস দেয়া। যাতে পরবর্তীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি নতুন নম্বরটি পায়ও, হত্যাকারীদের যেন তারা খুঁজে বের করতে না পারে।

অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মি. ফারুক বলেন, আর পুরো ঘটনাটি যাতে ছিনতাইয়ের মতো মনে হয়, তেমন একটি রূপ দেয়ার চেষ্টা করেছিল হত্যাকারীরা।
হত্যার পর নিহতের আত্মীয়দের সাথেও যোগাযোগ করে একজন সন্দেহভাজন এবং জানায় যে আজিজুল ইসলাম তার বাসায় এলেও সকাল বেলা বের হয়ে গেছে ও তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

পুলিশ জানায়, যেদিন ওই রেস্টুরেন্ট কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়, ওই দিনই তিনি খিলক্ষেত থানায় আজিজুল ইসলামের নামে নিখোঁজ জিডি বা সাধারণ ডায়েরি করার পরিকল্পনা করেছিলেন। জিডিতে তিনি আজিজুল ইসলামের পুরনো মোবাইল নম্বরটি দিতে চেয়েছিলেন, যাতে তাকে খুঁজে পাওয়া না যায়।

-বিবিসি