Home চট্টগ্রাম চা শ্রমিকদের দুঃসহ জীবন

চা শ্রমিকদের দুঃসহ জীবন

তাপস প্রান্ত

চট্টগ্রাম: মঞ্জু ওড়াং, বয়স ৫০, চেহারা ও শরীরের জীর্ণ দশা দেখলে মনে হয়, বয়স ৮০ পার হয়েছে । কাজ করেন  চট্টগ্রামের একটি চা বাগানে। সকাল সাড়ে আটটায় বাসা থেকে বের হন, ফিরেন বিকেল সাড়ে চারটায়।  দৈনিক মজুরি ১২০ এবং সাপ্তাহে তিন কেজি চাল/আটা । তিনি বলেন যতক্ষণ গতরে শক্তি আছে, ততক্ষণ না হয় খাটলাম। অল্প একটু অসুস্থ হইলেই-তো কাজ করতে পারি না। তখন বাগান থেকে বলে, “কাজে যাও, আর না পারলে নাম কাটাও। ছেলে-মেয়ে অনেক সময় স্কুলের খাতা-কলম চায়, দিতে পারি না। ভালো-মন্দ খাইতি চায়, দিতে পারি না।

মঞ্জু ওড়াং

সরেজমিনে ফটিকছড়ির দু’টি চা বাগানে দেখা যায়, শুধু মঞ্জু ওড়াং না, প্রত্যেক  চা শ্রমিক দের জীবনের গল্প একই রকম।

লেবার লাইনে কাজ করা চা শ্রমিকদের বসবাসের জায়গা হয় ২২২ বর্গফুট ঘরে। ১২০ টাকা হারে কাজ করতে হয়। না হয় হারাতে হয় মাথা গোঁজার ঠাঁই।  এমনই এক হতভাগ্য জনগোষ্ঠী চা শ্রমিকরা। কিন্তু এই শিল্পের ১৫ লক্ষাধিক জনগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শ্রমে সচল থাকে দেশের অর্থনীতি।

জীবনের সাথে অবিরত যুদ্ধ চালায়  চা শ্রমিকেরা। লক্ষ্য থাকে একটাই, পরিবারের সবাই মিলে সুখে থাকবে। কিন্তু নানা প্রতিকূলতায়  মৌলিক অধিকার বঞ্চিত চা শ্রমিকদের  নেই কোন স্থায়ী মাথা গোঁজার ঠাঁই। 

স্থায়ী বাড়ি নির্মান কেন করতে পারছেন না জানিয়ে, চা শ্রমিক দিলীপ মুড়ং বলেন, এই স্বল্প মজুরীতে যেখানে তাদের জীবন ধারনই কঠিন সেখানে তাদের কেউ টাকা সঞ্চয় করে জমি কিনে মূলধারার সমাজে বসবাস শুরু করবে এই চিন্তাটিও করা কঠিন। ভাষা আর সংস্কৃতির বিস্তর ফারাকের কারণে মূলধারার বাঙালি সমাজের কাছেও নিগ্রহের শিকার চা শ্রমিকেরা। চা বাগানের শিশুরাও প্রাক প্রাথমিক আর প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডি পেরোতে পেরোতেই ডাক পড়ে চা বাগানে কাজ করার। পরিবারের বয়স্ক সদস্যের কেউ চা শ্রমিকের পদ থেকে অবসর নিলে সেই পরিবারের কাউকে চা শ্রমিক হিসেবে নিবন্ধনের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, যাতে তার পরিবারের আবাসনটি টিকিয়ে রাখা যায়।

চা শ্রমিক দেবনাম কুমার বলেন, চা শ্রমিকের দিন শুরু হয় সকাল ৮ টায় এবং শেষ হয় বিকাল ৫ টায়। এই দীর্ঘ সময়ের বেশিরভাগ সময়ই তাদের দাঁড়িয়ে কাটাতে হয়। প্রতিদিন তীব্র দাবদাহ অথবা ঘনবর্ষণ মাথায় নিয়ে ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’ তোলাই তাদের কাজ।

চা শ্রমিকের অর্ধেকেরও বেশী নারী। এই নারীদের অবস্থা আরও খারাপ। চা শ্রমিক নিরুমতি বলেন, শ্রমিককে দিনে ২৩ কেজি চা পাতা তোলার লক্ষ্য দিয়ে দেওয়া হয়। বাগান বিশেষে হয়তো এই লক্ষ্যটি ১৮ থেকে ২৪ কেজিতে উঠানামা করে। আর এই লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলে কাটা যায় মজুরী। অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে যেমন মজুরী কাটা যায় তেমনি লক্ষ্যের চেয়ে বেশি পাতা তুলতে পারলে প্রতি কেজি পাতার জন্য দুই থেকে তিন টাকা বাড়তি মজুরী দেওয়া হয়।

বারোমাসিয়া চা বাগানের শ্রমিক মনি রায় বলেন, সারাজীবন কষ্ট করে আমাদের দিন যাপন করতে হবে। আর কিছুই করার নেই।চা শিল্পে রপ্তানি খাতের চাকা চালু থাকলেও তাঁদের বেশিরভাগ গল্পই মনি রায়ের মত। তার ধারণা সময়ের ধারাবাহিকতার দ্রব্যমূল্যর উধ্বগতির কারণে পেরে উঠছেন না। বেতন বৈষম্য, বাসস্থান আর শিক্ষা-চিকিৎসায় দুরবস্থা নিয়েই তাদের বসতি। প্রতি সপ্তাহে চা বাগান থেকে ৩ কেজি চাল এবং সন্তানের জন্য ১কেজি চাল রেশন হিসাবে পান তিনি। তাঁর স্বামী স্থানীয় রাবার বাগানে চাকরি করে কোনোমতে সংসার চলে যাচ্ছে। কষ্ট সহ্য করে জীবন যাপন তাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশে চা শিল্পের ইতিহাস প্রায় ১৫০ বছরের। সিলেটে চা বাগান তৈরির শুরুর দিকে উন্নত জীবনযাপনের আশা নিয়ে জন্মমাটি ছেড়ে চা বাগানে কাজ করতে আসে দক্ষিণ ও মধ্য ভারতের অভাবী মানুষ। কিন্তু কাজে এসে তাদের স্বপ্ন গুঁড়িয়ে যায়। স্বপ্নভঙ্গের জ্বালা নিয়ে তারা ফিরতে চায় নিজের দেশে। শ্রমিকরা দেশ ত্যাগ করতে গেলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নির্বিচারে হাজার হাজার চা শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করে। ১৯২১ সালের ২০ মের সেই রক্তাক্ত পরিণতিতে চা শ্রমিকদের দেশে ফেরার স্বপ্নও শেষ হয়ে যায়।