বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি
বাগেরহাট: প্রচন্ড দাবদাহ ও অনাবৃষ্টিতে চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন মোংলা উপকূলের চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষীরা। মৌসুমের শুরুতেই প্রথম দফায় ঘেরে ছাড়া পোনার অধিকাংশই মারা গেছে চলমান তাপদাহে। তারপর পরবর্তীতে দ্বিতীয় দফায় আবারো পোনা ছাড়া হলেও তাও মরছে প্রতিনিয়তই। তাই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ঘের চাষীরা। পাশাপাশি লোন-ধার-দেনা পরিশোধ ও পরিবার পরিজন নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। অথচ এখানে উৎপাদিত চিংড়ি ও কাঁকড়ার সিংহভাই রপ্তানী হচ্ছে বিদেশে। তাতে সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় হলেও ক্ষতিতেই থেকে যাচ্ছে চাষীরা। চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষে চাষীদের নেই সহজলভ্য ঋণের সুবিধা। যে যার মত করে ব্যাংক ও এনজিও লোন এবং ধার দেনা করে ঘের করে আসছেন। এতে অনেকেই আর্থিক ক্ষতিতে পড়ে নি:স্ব হয়ে পড়েছেন।
উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তর জানান, মোংলায় ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ১২হাজার চিংড়ি ও গলদার ঘের রয়েছে। তার মধ্যে পশুর নদীর ড্রেজিংয়ের বালু ফেলায় শুধু চিলা ইউনিয়নেই প্রায় ৩শ ঘের ভরাট হয়ে ঘেরের সংখ্যা কমে গেছে। এছাড়া শিল্পায়নের কারণে বুড়িরডাঙ্গা ইউনিয়নের ঘেরের সংখ্যা কমেছে দেড় শ’র মত। তাই নানা কারণে ক্রমেই কমে আসছে চিংড়ির ঘেরর সংখ্যা। এখানকার বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা ও আয়ের একমাত্র উৎস হলো এ ঘের। ঘের কমার সাথে সাথে নানা প্রতিকূলতায় কমছে ঘেরগুলোতে মাছের উৎপাদনও। তাই এতে বেকারও হয়ে পড়েছেন অনেক পরিবার।
উপজেলা মৎস অধিদপ্তরের হিসেব মতে এখানে রেজিষ্ট্রেশনকৃত বাগদা চিংড়ির ঘেরের সংখ্যা ৫ হাজার ৪শ ৮৬টি। আর গলদা চিংড়ির ঘের রয়েছে ২ হাজর ৯শ ৬০টি। আর রেজিস্ট্রেশনসহ মোট বাগদা ও গলদার ঘেরের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১২হাজার। এই সাড়ে ১২হাজার ঘেরের মধ্যে সাড়ে ৪শ ঘের কমে গেছে বালু ভরাট ও শিল্পায়নের কারণে। প্রতিবছর এখানকার বাগদা চিংড়ির ঘেরে ১০ কোটি ও গলদা চিংড়ির ঘেরে ৩ কোটি পোনা ছেড়ে থাকেন ঘের মালিকেরা। সেই পরিমাণে উৎপাদন হয়ে আসছে খুবই কমই।
মিঠাখালী ইউনিয়নের চিংড়ি ঘের মালিক মাহমুদ হাসান ছোট মনি ও সুমেল সারাফাত বলেন, আমাদের ৮টি ঘেরে প্রথম দফায় যে পোনা ছেড়ে ছিলাম তার শতকরা ৯৫ভাগ মাছই মারা গেছে। এরপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় যে পোনা ছেড়েছি তাও প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছে। কারণ হিসেবে তারা বলেন, প্রচন্ড তাপদাহ ও পানিতে অতি মাত্রার লবণাক্ততায় মাছ মারা যাচ্ছে। চিলা ইউনিয়নের ঘের মালিক আবু হোসেন পনি বলেন, মৌসুমের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ৮দফায় সাড়ে ৪লাখ টাকার পোনা ছেড়েছি। কিন্তু মাছ পেয়েছি মাত্র ৮ হাজার টাকার। বাকী মাছ মরে গেছে গরম ও লবণে। চাঁদপাই ইউনিয়নের ঘের ব্যবসায়ী মোল্লা তারিকুল ইসলাম, সুন্দরবন ইউনিয়নের ঘের ব্যবসায়ী ইব্রাহিম হোসেন ও বুড়িরডাঙ্গা ইউনিয়নের ঘের ব্যবসায়ী কাকন শেখ বলেন, আমরা তো ঘের করে দিন দিন লোকসানে রয়েছি। কিন্তু পূর্ব পুরুষেরা নিজ জমিতে ঘের করে আসছিলেন, আমরাও নিজেদের জমিতে চিংড়ি চাষ করে আসছি। এখন লোকসান হলেও আমাদের অন্য কোন কিছু করার তো কোন সুযোগ ও সাধ্য নেই। তাই বছরের পর বছর লোকসান টেনে যাচ্ছি।
এদিকে করোনাকালে নানা সমস্যার কারণে ঘেরের উৎপাদন কমে গিয়েছিল শতকরা ৪০ থেকে ৪৫ভাগ। এরপর থেকে আস্তে আস্তে ঘেরের উৎপাদন কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসতে শুরু করে। কিন্তু চলতি মৌসুমের মার্চ-এপ্রিল মাসে প্রচন্ড দাবদাহ ও লবণাক্ততার কারণে অধিকাংশ ঘেরের মাছ মরে যায়। তারপর থেকেও দফায় দফায় পোনা ছাড়লেও আশানুরুপ মাছ পাচ্ছেন না চাষীরা। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে প্রচন্ড তাপদাহ, অনাবৃষ্টি, ঘেরের গভীরতা কম থাকা, পানিতে অতিমাত্রার লবণাক্ততা, দুর্বল পোনা ও পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবহার না করায় চাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। মূলত এসব কারণেই প্রতিনিয়ত ঘেরের মাছ মরছে।
উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম বলেন, গত মৌসুমে এ উপজেলার ২ হাজর ২শ ৯২ হেক্টর জমির ঘেরে ১হাজার ৮শ ৩৪ মেট্টিক টন বাগদা, ৯শ ৭০ হেক্টর জমিতে ১ হাজর ৪শ ৫৫ মেট্টিক টন গলদা ও ৩শ ৬০ হেক্টর জমিতে ১শ ৮০ মেট্টিক টন কাঁকড়া উৎপাদন হয়েছিলো। আর ৩শ ১৫ হেক্টর জমির ৪ হাজার ১শ ১টি ঘের ও পুকুরে উৎপাদন হয়েছিল ৭শ ৮৭ মেট্টিক টন সাদা মাছ। এখানে উৎপাদিত বাগদার ৭০ ভাগ, গলদার ৫০ ভাগ ও কাঁকড়ার ৭০ ভাগই বিদেশে রপ্তানী হয়ে থাকে।