বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক
কলকাতা: দিঘা ঘুরতে গিয়ে এক বিরল দৃশ্যের সাক্ষী থাকলেন পর্যটকরা। এমন এক দৃশ্য দেখেছেন সকলে যা হয়তো তাঁরা চাইলেও কোনওদিন ভুলতে পারবেন না। এখন আপনিও নিশ্চয়ই ভাবছেন যে কী এমন দৃশ্য দেখে সকলে চমকে গিয়েছেন? তাহলে বিস্তারিত জানতে চোখ রাখুন প্রতিবেদনটির ওপর।
আর পাঁচটা দিনের মতো ভ্যাপসা গরম থেকে একটু মুক্তি পেতে দিঘার সমুদ্র সৈকতে কেউ গা ভাসাচ্ছিলেন তো কেউ আবার পারে বসে সমুদ্রের আনন্দ উপভোগ করছিলেন। তবে আচমকাই যেন সবকিছুতে তাল কাটল। চোখের সামনে ভেসে উঠল এক অদ্ভুত এবং বিরল দৃশ্য। আর সকল পর্যটকের মধ্যে শোরগোল পরে গিয়েছে আস্ত এক প্রাণীকে নিয়ে। এ যে নীল ডলফিন! হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন।
বহু বছর পর ফের একবার দিঘার বালিয়ারিতে দেখা মিলল বিরল নীল ডলফিনকে। এহেন ঘটনাকে কেন্দ্র করে সকলের মধ্যেই স্বাভাবিকভাবে শোরগোল পরে গিয়েছে। অনেকে এহেন দৃশ্য দেখে নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করছেন। একপ্রকার এই বিরল প্রজাতির প্রাণীটিকে দেখতে দিঘার সমুদ্র পারে পর্যটকদের ভিড় উপচে পড়েছিল। যদিও ডলফিনটিকে মৃত অবস্থায় মিলেছে। স্থানীয়দের দাবি, জলে কোনওভাবে আহত হয়েছিল প্রাণীটি, এরপর তার থেকে মৃত্যু ঘটেছে।
গায়ের রঙ ঘন নীল। মাথা থেকে লেজের গোড়া অবধি মাপ কম করেও পাঁচ ফুট। ওজনে প্রায় ৯৫ কিলোগ্রাম। চকচকে গা, ঘন নীল রঙ যেন সমুদ্র আর আকাশের রঙের সঙ্গে মিশে গেছে। কিন্তু শরীরে প্রাণ নেই। ঢেউয়ের ঝাপটা ঝাপটা খেতে খেতে দলছুট ডলফিনটার মর্মান্তিক পরিণতিই হয়েছে।
নিউ দিঘায় নীল ডলফিনের দেখা মিলেছে খবর পেয়েই পড়িমড়ি করে ছুটে এসেছেন বনকর্মীরা। সামুদ্রিক প্রাণী নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন তাঁরাও ভিড় জমিয়েছেন দিঘার সৈকতে। আর পর্যটকদের উচ্ছ্বাস তো দেখার মতো। টিভির পর্দায় দেখা নীল ডলফিন একেবারে চোখের সামনে। সকাল থেকেই নিউ দিঘার সৈকতে লোকে লোকারণ্য।
স্থানীয় প্রশাসন জানাচ্ছে, এ যাবৎ বহুবারই ডলফিন ভেসে এসেছে সৈকতে। তাদের বেশিরভাগই ছিল অর্ধ মৃত বা মৃত। অথবা ধুঁকতে ধুঁকতে সমুদ্রতটেই মৃত্যু হয়েছে। তবে এমন নীল রঙা ডলফিন আগে কখনও দিঘার সৈকতে দেখা যায়নি। নিউ দিঘা থেকে হলদিয়া পর্যন্ত ৭৮ কিলোমিটার উপকূলে বারে বারেই মৃত ডলভিন ভেসে ওঠার ঘটনা নিয়ে চিন্তিত বিজ্ঞানী, প্রাণীবিদরা। বিরল এই প্রজাতির প্রাণীদের মৃত্যু কীভাবে হচ্ছে, তা জানতে এই ডলফিনটিকে নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করবেন তাঁরা। ভাইরাস সংক্রমণজনিত কারণ নাকি অন্য কারণে মৃত্যু হচ্ছে ডলফিনদের তা পরীক্ষা করে দেখা হবে।
পরিবেশ দূষণ আর জলবায়ু বদলের ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়ছে ডলফিনদের ওপরে। ধীরে ধীরে বিলুপ্তির খাতায় নাম লেখাচ্ছে। পরিষ্কার জলে বাস করা ডলফিনরাও সুরক্ষিত নয়। কয়েকটি প্রজাতিকে তো ইতিমধ্যেই লাল তালিকায় ফেলেছে ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার’ (আইইউসিএন)। কুড়ি সালের বিপজ্জনক তালিকায় থাকা প্রাণীদের তালিকা সামনে এনেছে আইইউসিএন। অন্তত ৩১টি প্রজাতিকে বিলুপ্তপ্রায় ঘোষণা করা হয়েছে। আইসিইউএন জানাচ্ছে, ১ লক্ষ ২৮ হাজার প্রজাতির প্রাণীদের মধ্যে ৩৫ হাজারই বিপজ্জনক ভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে। যার মধ্যে যেমন ডলফিনরা রয়েছে, তেমনি রয়েছে সোনালি লেঙ্গুর, কয়েকটি প্রজাতির পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী, সরীসৃপ ও উভচররা।
২০০৯ সালে ডলফিনকে ‘ন্যাশনাল অ্যাকোয়াটিক অ্যানিম্যাল অব ইন্ডিয়া’র মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। দেখা গেছে, জাহাজ, স্টিমারের চড়া শব্দ, মানুষের কোলাহল, শব্দদানবের অত্যাচারে ডলফিনদের অস্তিত্বই বিপন্ন। জলের দূষণ, জেলের জাল, নদীর বাঁধ ও মানুষের অত্যাচার— এই চারের সাঁড়াশি আক্রমণে বিলুপ্তির খাতায় নাম লিখিয়ে ফেলেছে ডলফিনরা।
গবেষকরা বলছেন, বর্জ্য ও জলজ যানের কর্কশ আওয়াজে নিজেদের মধ্যে তরঙ্গের জাল বিছিয়ে কথোপকথন চালাতে পারছে না ডলফিনরা। তাদের শব্দের তরঙ্গে দাঁত বসাচ্ছে জলজ যানের তীক্ষ্ণ আওয়াজ। ফলে দিক নির্ণয় করতে না পেরে অধিকাংশই পথ হারাচ্ছে। ঠোক্কর খেতে খেতে কেউ ভিড়ছে অজানা চরে, আবার কেউ ধাক্কা খাচ্ছে জাহাজের নোঙরে। দলছুট হয়ে ভাসতে ভাসতে এসে ঠেকছে কোনও না কোনও সৈকতে। ফল ভয়ঙ্কর মৃত্যু।
দক্ষিণবঙ্গের নদীগুলিতেও একটা সময় প্রচুর পরিমাণে গাঙ্গেয় ডলফিনের দেখা মিলত। এখন সেই সংখ্যা হাতে গোনা। নেপাল, বাংলাদেশেও এই প্রজাতির অস্তিত্ব বিপন্ন। এরা মূল আলট্রাসনিক সাউন্ডের সাহায্যে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রেখে চলে। দিক স্থির করে, শিকার ধরে। মাছের ঝাঁকের শব্দ শুনে এরা বুঝতে পারে ঠিক কোন জায়গায় রয়েছে তাদের শিকার। নিজেদের মধ্যে কথা বলার জন্যও শব্দ তরঙ্গের একটা নির্দিষ্ট মাত্রা আছে ডলফিনদের সংসারে। সেই মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে শব্দদূষণের তাণ্ডব। ফলে মর্মান্তিক পরিণতিরই শিকার হচ্ছে ডলফিনরা।