Home Third Lead ডাকঘরে চিঠি আসে, চিঠি ভাসে অশ্রুজলে

ডাকঘরে চিঠি আসে, চিঠি ভাসে অশ্রুজলে


ভাগ্যধন বড়ুয়া
মন্ত্র বা মন্ত্রণা দিয়ে হয়তো যন্ত্র চলতে পারে কিন্তু পুঁথির ধারামতো মন তো চলে না; কাশবনে ঢেউ তোলা, সূর্যাস্তে রংখেলা, প্রিয়জনের নজরলাগা টান কি শাস্ত্রমতো চলে?
শরতের রৌদ্র আর মৃদু সমীরণ কেবল বাহিরে ডাকে; নিয়ে যায় দূর প্রান্তে- পৃথিবীর পথে পথে, তৃণ ঘাসে যেখানে বারো মাসে তেরো পার্বণ আর কানে বাজে সারাক্ষণ ঘুমপাড়ানিয়া গান; ঘুম যারে দুধের বাছা… আয় আয় চাঁদ মামা। উঠোনে নিয়ে যাও, উঠোনে যেতে চাই, ভরা উঠোন যেখানে কাঠবিড়ালি রোদ হয়ে দৌড়ে প্রান্ত থেকে সীমান্তে…
বোবা আকাশ হাতছানি দেয় বুকের ভাষা বোঝাতে; যাদের মনে শব্দ-সুর অনুনাদ তোলে তারা শুধু বুঝে শিলাপাহাড়ের গান, জোনাকির কান্না আর যারা পুঁথি নিয়ে পড়ে থাকে দিনে রাতে তাদের কোনো খবর নেই আলোয় ভরা দুপুরের ধারাভাষ্য… তাদের কথা বাদই দিলাম।
কাজ খুঁজতে খুঁজতে বহুদূর যেতে হয়, কেউ পাহাড়ের চূঁড়ায়, কেউ সমুদ্রের পাড়ে, কেউ বা খাল-বিল-ঢালুপথ- উপত্যকা পার হয়ে আরো দূরে অজানায়… তারপর আর ফেরে না। সেখানে ঝরনার জলে পা ভেজায়, জলের ঢেউ দেখে; ছলছল কলকল ঢেউ, কেন্দ্র থেকে পরিধি বরাবর ঢেউ, সরে যায় দূরে যায়, পাড়ে গিয়ে হারিয়ে যায়…। কোনো কোনো প্রিয়জন যেমন চোখের সন্মুখ থেকে চিরদিনের জন্য দূরে হারিয়ে যায় ডুমুরের ছায়ায়…
আমি তো যেতে চাই দিগন্তে, চেয়ে থাকি চাতক চোখে, কৃষ্ণচূড়া ডাকে চৌম্বকীয় টানে, জারুল জানায় নববার্তা রঙের গালিচায়…। কেমনে ধরি প্রাণ অন্তপুরে অন্ধ প্রকোষ্ঠে; আলোহীন, বায়ুহীন নিঃসঙ্গ বাসগৃহে?
পাখির ডাক… উড়াল পাখির কিংবা ফিরতি পথের আকুতির সুর, দুরন্ত দুপুরে কুহু কাঁদে পাঁজরের পাড়ে পাড়ে। পাঁচমুড়া পাহাড়ের ডাক, শামলী নদীর বানমারা টানমারা, রাঙামাটির লালপথ, জ্ঞাতি বটবৃক্ষের আবেশ চোখ ভরে নিয়ে আসে ঘুম, আমি ঘুমাই, স্বপ্নে আসে রাজপুত্র, রাজকন্যা… ধীরে ধীরে রাজপুত্র সেজে নিজেই শাদা গোলার্ধে উড়াল দিই…
দেখি খোলাচোখে; গরু চরে মাঠ ভরে, আলপথে হেঁটে যাই, মাঝে মাঝে ঝিম মেরে ঝিমোই, বাতাসের ছোঁয়া পেলে ধানশীষ দোল খায়। কাঁপে প্রাণ ধাপে ধাপে প্রণয়ের ইশারায়, লালশাড়ি পলি দেহে বীজ বোনে, জল দেয়, চারা হয় বৃক্ষের আদলে। দেখি না বাঁধা চোখে, খোলা চোখ আটকায়, মনোজলে ডুব দিই। একা একা সাধনায় রত হই। চারিদিকে খালিচোখে দেখে যাই অন্তরের আলোছায়া, হারগোঁজা কাঁটা সুঁই, বাদুড়ের দৌড়ঝাপ, বেদনার পাতকুয়া। নিজ কাজে ডুব দিই, সুখ খুঁজি একা মনে, মনের মুকুরে…
প্রহরী, ঘণ্টা বাজাও, বেলা যায়, নিয়ে যাও ভরা রোদে… স্নাত হই অজ্ঞাত বাসনায়, কেউ বলে বয়ে যায় নিরবধি সময়ের ভরা স্রোতে, কেউ বলে বাকি থাকে এখনো প্রহরের বাকি কাল… ঢং ঢং বেজে চলে গির্জার ঘণ্টা বহুদূর বহুকাল ভাবীকালের পাহারায়… কার লাগি বিরহ, কার লাগি প্রহরায় জানে না, জানে নাই, যে জানে সে নেই। পশ্চিমের পথ ধরে শুকতারা হেঁটে যায় একান্ত খেয়ালে…। যদি থাকো ভরে থাকো, নাই মানে ঘর নেই, ভর নেই, স্বর নেই; চারিদিকে খালি খালি শূন্য শূন্য। প্রহরী প্রহর বানায় আর ঘরে ঘরে সাজে রাত, প্রয়োজনে মন মতো রং মাখে, রং আঁকে- সময়ের বাঁকে বাঁকে স্বল্পদৈর্ঘ্য ছায়াছবি।
ডাকঘরে চিঠি আসে, ডাক আসে, চিঠি হাসে, চিঠি ভাসে অশ্রুজলে, চাপা থাকে কত কথা, শত গান, শত প্রেম, বুকভাঙা হার মানা আবেদন… বোবাঘরে পড়ে থাকে নিশিদিন প্রাপকের অপেক্ষায়। আশা রাখি, বুক বাঁধি পাবো হাতে একদিন আরাধ্য উপহার।
রাতের সাধনা ভাঙায় ঢং ঢং কাঁপা বোল, পরতে ভাঁজ খোলে দেহবাঁক ফাগুনের ইশারায়… পাড়ি দিই ঢেউ তুলে জানি না কী হবে আলিঙ্গন কামনায়!
কতোজন দুয়ারে আসে স্বীয় মনোবাসনা নিয়ে অথবা নিজেই আবর্তিত হয়ে দুয়ারে দুয়ারে যাই, বুকে জড়ায় কেউ আবার কেউ কেড়ে নেয় আনন্দের জমা ক্ষণ। ডুব দিয়ে ঘর খুঁজি, পথ খুঁজি- যেতে চাই ভিতরে যেখানে আলোরেখা পথ ধরে নিয়ে যায় ভরহীন শূন্যে; যা শুনি চারিদিকে তাইই জমাই, লিখে রাখি, কারো কানে বলে যাই, নিয়ে যাও ঠিকানায় যেখানে বসে আছে কালের প্রহরী।
দুঃখ নেই। সুখ দেখি চারিধারে। ফুল দেখি, পাখি দেখি, মেঘ দেখি, চাঁদ দেখি জীবনের উঠোনে, সেজে রয় শতাব্দীর শেষে। একদিন পেতে পারি আরাধ্য লগন; তার লাগি আলো মেখে বুক পাতি ধুলোমাখা আঙিনায়। কখনো আঁধার হলে মনে রেখো, ক্ষণকাল মুছে গেলে ভোর হবে! আলো এলে ভালো করে ভুলগুলি ঠিক করে ফিরে যাবো সুন্দরের ঠিকানায়। মঙ্গলের জয়গানে বেদনার অবসান। মাঝে মাঝে ভয় হয়, শরতের ভরা রোদ, বড় বেশি চঞ্চল ঝরনার আবহন। বুক কাঁপে, মনে হয় সবকিছু সাথে করে নিয়ে যাই শূন্যের ওপারে।
সুধা ডাকে, উঠে যাও ঘুম থেকে, হাত ভরে ফুল দেবো, বুক ভরে শ্বাস দেবো, এসেছি ভরা মনে, ফিরে তো যাবো না। বলে যাই তারাদের, তোমাদের বলে যাই, ভুলি নাই কখনো একবিন্দু এক পলক।