Home অন্যান্য ‘ডিভাইন কমেডি’র রহস্যময়ী বাস্তবে কে?

‘ডিভাইন কমেডি’র রহস্যময়ী বাস্তবে কে?

বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক

একপলকের দেখা, আর তাকে ঘিরেই কিংবদন্তি। আনমনা হয়ে পথ চলছিল ৭-৮ বছরের এক কিশোরী। খেয়ালই করেনি, পথের একপাশে দাঁড়িয়ে তার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে বয়সে সামান্য বড় এক কিশোর। দুএক মুহূর্তের এই দেখা। অথচ তা থেকেই এই পৃথিবীর বুকে জন্ম নিয়েছিল এক আশ্চর্য দাস্তান… অনন্য এক রূপকথা। তারপর তো বাকিটা ইতিহাস…হ্যাঁ, প্রথম দর্শনেই এক প্রতিভাবান বালক ভালোবেসেছিল একটি স্নিগ্ধ বালিকাকে। ভবিষ্যতের মহাকবি দান্তে দেখেছিলেন ডিভাইন কমেডির আগামীকালের এক কিংবদন্তি-চরিত্র বিয়াত্রিচেকে। তারপর আর কয়েকবার মাত্র দেখা হয়েছিল তাঁদের। কথা হয় নি কোনও। কথা হবার প্রয়োজনও ছিল না। যার সঙ্গে মনের লুকোনো মণিকোঠায় কথা হয় রোজ, তাকে প্রকাশ্যে আর কী-ই বা বলার ছিল কিশোর-কবি দান্তের?

ক্রমে দিন যায়, রাত আসে। মিসা, কঙ্কা, রেনো, সান-মারিনো আর রুবিকনের বুকে বয়ে যায় অজস্র জলধারা। বিয়াত্রিচের বিয়ে হয়ে গেল অন্য এক পুরুষের সঙ্গে। তরুণ কবি দান্তেও বিয়ে করলেন তাঁর বাগদত্তা জেম্মাকে। কবিদের বিবাহিত জীবন আর মনোজীবন অনেক সময় দুটি সমান্তরাল ধারায় বয়ে যায় জগতের অগোচরে। ‘তুমি তো জানো না কিছু, না জানিলে, আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ করে’ ।

বিয়াত্রিচে কখনও জানতেই পারে নি, তাকে নিয়ে লেখা অসংখ্য কবিতায় ভরে উঠছে এক মুগ্ধ যুবকের কবিতার খাতা। এই প্রসঙ্গে অনেকেরই মনে পড়ে যেতে পারে বিনয় মজুমদার আর গায়ত্রীর কথা। পার্থক্য একটাই, দান্তে বিয়ে করেছিলেন, বাচ্চা-কাচ্চাও হয়েছিল, আর বিনয় বিয়ে করেন নি। খামোখা পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। না, প্রভেদ আরও আছে। গায়ত্রীর মতো দীর্ঘজীবী মেধাবিনী নয়, বিয়াত্রিচের আয়ু ছিল বড়ই কম। মাত্র ২৪ বছর বয়সে মারা যায় সে।

বাংলা কবিতার বহুচর্চিত প্রেম, বিনয় গায়ত্রী

বিয়াত্রিচের মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় দান্তের কাব্যগ্রন্থ লা ভিটা নোভা (নতুন জীবন)। ছোটো-বড় সমস্ত কবিতার মধ্যে থেকে বেছে নেওয়া একটি সংকলন, যার অধিকাংশই বিয়াত্রিচে-কেন্দ্রিক।

দান্তের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে প্রবল ঝড় বয়ে যায় এর পরের কয়েক বছরে। তছ-নছ হয়ে যায় তাঁর জীবন। বেড়ে ওঠে শত্রু-সংখ্যা। নির্বাসিতও থাকেন কিছুকাল। তারই মধ্যে প্রস্তুতি চলে সেই বহু-কাঙ্ক্ষিত মহাকাব্য লেখার । ১৩০৮-এ শুরু করা ডিভাইনা কোম্মেদিয়া (ডিভাইন কমেডি) শেষ হয় কবির মৃত্যুর এক বছর আগে ১৩২০ সালে । দীর্ঘ ১২ বছর সময় লেগেছিল এই ১৪২৩৩ পংক্তির স্বর্গীয় মহামিলনের অমর মহাকাব্য রচনা করতে ।

ডিভাইন কমেডি ও দান্তে

কী লেখা আছে সেই অমর মহাকাব্যে?  কাহিনীটি এই রকম : এক গভীর অরণ্যের পথে দান্তের সঙ্গে দেখা হয় সুপ্রাচীন খ্রিস্টপূর্বাব্দের মহাকবি ভার্জিলের। স্বর্গ থেকে অপেক্ষমান বিয়াত্রিচে ওই সময় ভার্জিলকে সেখানে পাঠিয়েছেন, তিনি যেন দান্তেকে মৃত্যু-পরবর্তী ভুবনে পথ দেখিয়ে স্বর্গে নিয়ে আসেন। ওই মহাযাত্রার বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথাই দান্তে এই মহাকাব্যে বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে ইনফারনো, পার্গেটরিয়ো এবং প্যারাডাইসের (নরক, প্রেতভূমি এবং স্বর্গ ) বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। যেসব আত্মা শেষ পর্যন্ত ত্রাণ লাভ করে স্বর্গে যাবে, পার্গেটরি বা প্রেতভূমিতে কঠোর প্রায়শ্চিত্তের মধ্যে দিয়ে সমস্ত পাপ ধুয়ে-মুছে তাদের পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করে তোলা হয়।

নরকের পথে হেঁটে যাওয়া দুই কবি ভার্জিল আর দান্তে

এই মহাকাব্যে বিয়াত্রিচের প্রসঙ্গ থাকলেও এর বিষয়বস্তু শুধু প্রেম নয়। এখানে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে দান্তের গভীর দার্শনিক চিন্তার অসামান্য সুন্দর প্রকাশ ঘটেছে। ভার্জিল দান্তেকে প্রথমে নরক, তারপর পার্গেটরি এবং সব শেষে স্বর্গের দুয়ারে পৌঁছে দেন। সেখানে বিয়াত্রিচে এসে তাঁর হাত ধরে। এই মহাকাব্যটি লেখা হয় আগাগোড়া স্থানীয় ভেনেশিয়ান কথ্যভাষায়। অর্থাৎ তখনকার সাধারণ মানুষ যে ভাষায় কথা বলত সেই ভাষায়। আমাদের মাইকেলের মতো ইরম্মদীয় ভাষায় নয়।

স্বর্গের দুয়ারে এসে দান্তের হাত ধরেন বিয়াত্রিচে

ডিভাইন কমেডি পড়ে আমাদের মনে হয়: এ যেন আমাদের মানব-জীবনেরই এক দীর্ঘ অভিযাত্রা। পাপ-তাপ-দহন-নিপীড়ন ও লেলিহান আগুনের মধ্যে দিয়ে মানুষ যেমন ক্রমাগত এক শুদ্ধতার দিকে এগিয়ে চলে, এও ঠিক তেমনই, মৃত্যু থেকে অমৃতের দিকে যাত্রা। তমসা থেকে আলোর দিকে এক নিরন্তর পথচলা।

আনুমানিক ১২৬৫— ১৩২১ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি কোনও এক সময়ে ইতালির ফ্লোরেন্সে জন্মগ্রহণ করেছিলেন দান্তে। আশ্চর্য জীবন তাঁর। তিনি ছিলেন একাধারে মহাকবি, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক আবার যোদ্ধাও।  পুরো নাম Durante degli Alighieri । আর বিয়াত্রিচের কুমারী জীবনের পুরো নাম ছিল Beatrice Portinari।

ডিভাইন কমেডি পড়তে পড়তে ভাবি: এই বাংলাদেশের পথে ঘাটে কখনও কোনও বিয়াত্রিচে কি হেঁটে যায় নি? স্কুলের পথে, অথবা অন্য কোনও তুচ্ছ প্রয়োজনে? হয়তো গেছে, কিন্তু সেই যাওয়া চোখে পড়েনি কোনও বাঙালি মহাকবির। যে তিনটি বাংলা মহাকাব্য নিয়ে আমাদের গর্বের শেষ নেই, সেখানে সব আছে, শুধু বিয়াত্রিচে নেই। বিয়াত্রিচের মতো কেউ নেই। নরকের আগুন ও বিষ থেকে আমাদের মতো মর্তবাসী মানুষদের হাত ধরে অমরাবতীতে পৌঁছে দেবার জন্য কেউ আর পাঠাবে না ব্যাস বাল্মীকি অথবা কালিদাসকে। যেন এই চকচকে নরকই আমাদের নিয়তি।

শিল্পীর কল্পনায় বিয়াত্রিচের মতো কেউ

শেকসপিয়রের হ্যামলেট বলেছিল : ‘There are more things in heaven and earth, Horatio, than are dreamt of in your philosophy. ‘

বিখ্যাত মনীষীদের ব্যক্তিজীবনকে ঘিরে গড়ে ওঠে এরকম নানা অলৌকিক কিংবদন্তি। কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দের একটি শ্লোক নাকি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ অথবা অন্য কোনও রহস্যময় শক্তি এসে লিখে দিয়েছিলেন। কাব্যের ওই অংশটি শেষ না করে তিনি নদীতে স্নান করতে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে দেখেন তাঁর পাণ্ডুলিপিতে অন্য কারও হস্তাক্ষরে লেখা আছে : ‘স্মরগরল খণ্ডনং মম শিরসি মণ্ডনং/ দেহি পদপল্লবমুদারম।’ এই অসামান্য শ্লোকটি নিয়ে ভক্তবাঙালি সমজে লোকশ্রুতির অভাব নেই। তবে কিংবদন্তি কিংবদন্তিই হয়। তাকে যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে যাওয়া মূর্খামি।

দান্তের ডিভাইন কমেডি নিয়েও এমনই একটি কিংবদন্তি প্রচলিত আছে, যাকে যুক্তির মানদণ্ডে বিচার করা চলে না।

দান্তে মারা যান ১৩২১ সালে। লোকশ্রুতি আছে, তাঁর মৃত্যুর পর জানা গেল ডিভাইন কমেডির পাণ্ডুলিপির শেষ অংশটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কে বা কারা সেই অংশটুকু সরিয়ে নিয়েছে মূল পাণ্ডুলিপি থেকে! দান্তের দুই পুত্র জ্যাকোপো ও পিয়েত্রে দীর্ঘদিন ধরে সরোজমিনে অনুসন্ধান করেও খুঁজে পাননি সেই হারিয়ে যাওয়া পাণ্ডুলিপি। বাবার লেখালেখির সমস্ত কাগজপত্র তন্ন তন্ন করে পিয়েত্রে আর জ্যাকোপো একসময় হাল ছেড়ে দেন। হাজার অনুসন্ধান করেও পাণ্ডুলিপির হারানো অংশটুকু খুঁজে পেলেন না তাঁরা।

তারপর অতিবাহিত হয়ে যায় বেশ কিছুদিন। একদিন হঠাৎ এক অলৌকিক রাত্রিতে পিয়েত্রে স্বপ্নের মধ্যে দেখতে পান তাঁর পিতা দান্তেকে। দুধের মতো ধবধবে সাদা পোশাক পরা দান্তে যেন নরম আলোর মধ্যে ডুব দিয়ে এসে উঠে দাঁড়ালেন ছেলে পিয়েত্রের মাথার কাছে। বিস্মিত পিয়েত্রে তাঁর বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন ডিভাইন কমেডির শেষ অংশটুকুর রহস্যময় অন্তর্ধানের কথা। বললেন- ‘বাবা! আপনি কি এই অসামান্য মহাকাব্যটি অসম্পূর্ণ রেখেই মৃত্যু বরণ করেছিলেন, অথবা অন্য কেউ এই কাব্যের শেষ অংশটুকু চুরি করে নিয়ে গেছে?’

দুধের মতো ধবধবে সাদা পোশাক পরা দান্তে

স্বপ্নের মধ্যেই মহাকবি দান্তে তাঁর প্রিয় পুত্রকে জানালেন, তিনি ভেবেছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর এই অতি শ্রম ও যত্নে লেখা মহাকাব্যটি চুরি হয়ে যেতে পারে, তাই তিনি পাণ্ডুলিপির শেষ অংশটুকু সন্তর্পণে গোপন করে রেখেছেন পাশের ঘরের ঘুলঘুলির ভিতরে।

পরেরদিন সকালবেলা বিছানা থেকে উঠে পিয়েত্রে রাত্রির সেই অলৌকিক স্বপ্নের কথা জানালেন সকলকে। কিন্তু শ্রোতারা কেউ বিশ্বাস করল না তাঁর কথা। কেউ একটিবারের জন্যেও প্রয়োজন মনে করল না পাণ্ডুলিপিটি আবার খুঁজে দেখার ।

অতঃপর পিয়েত্রে তাঁর এক উকিল বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে অনুসন্ধান করে দেখলেন পিতার উল্লিখিত সেই ঘুলঘুলি বা ভেন্টিলেটর। খোলার পর তাঁদের বিস্ময়ের সীমা রইল না। তাঁরা অবাক হয়ে দেখতে পান, একটি পুরু কাপড়ে ভাঁজ করে জড়ানো রয়েছে অনেকগুলি অবিন্যস্ত কাগজপত্র। পাঠ করে বোঝা গেল, সেগুলি দান্তের লেখা ডিভাইন কমেডির পাণ্ডুলিপির শেষ অংশ ছাড়া আর কিছু নয়।

কেমন ছিল মহাকবি দান্তের জীবন?

তিরিশ বছর বয়সে রাজনীতিতে নেমে পোপের বিষ নজরে পড়েন দান্তে। তাঁর ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। তাঁর ফ্লোরেন্সে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। এমনকি তাঁর ছেলেদের হত্যার চেষ্টাও করা হয়। দীর্ঘ কুড়ি বছর তিনি নির্বাসনে কাটিয়েছেন। সেই নির্বাসন থেকে তিনি আর কখনোই তাঁর প্রিয় জন্মশহর ফ্লোরেন্সে ফিরে যেতে পারেননি। বিশ বছরের সেই নির্বাসিত জীবন তাঁকে অতিবাহিত করতে হয়েছিল ছন্নছাড়ার মতো নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে। ত্রেভিজো, লুচ্চা, পাদুয়া, ভেরোনো, রাভেন্না, তাসকানি, ভেনিস, মিলান এবং আরও বহু জায়গায় তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন যাযাবরের মতো। বেঁচে থাকার জন্য নানা জীবিকা বেছে নিতে হয়েছে তাঁকে। কখনও ছাত্র পড়িয়েছেন, কখনও অলঙ্কারশাস্ত্র সম্পর্কে ভাষণ দিয়েছেন, কখনও বড়লোক জমিদারদের মজলিস আলো করেছেন।

নির্বাসিত দান্তে আর কখনও ফিরতে পারেননি তাঁর প্রিয় জন্মশহর ফ্লোরেন্সে 

তাঁকে ক্ষমা চাইতে বলা হয়েছিল। কিন্তু অনমনীয় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন দান্তে ক্ষমার বিনিময়ে ফ্লোরেন্সে ফিরতে চাননি। দারিদ্র‍্য আর জেদকে সঙ্গী করে বেঁচেছিলেন বাকি জীবন। তিনি বলেছিলেন :
‘এই উদার আকাশের নীচে যেকোনো মৃত্তিকায় আমি কি সত্যের ধ্যান করতে পারব না? তা হলে কীসের জন্য ফ্লোরেন্স আর ফ্লোরেন্সবাসীর কাছে মানসম্মান-খ্যাতি সব বিসর্জন দিয়ে আমাকে দেশে ফিরতে হবে?’

কিন্তু দান্তে মারা যাওয়ার পর ফ্লোরেন্সের মানুষ ধীরে ধীরে অনুভব করেছিল, কাকে তারা উপেক্ষায় আর অবহেলায় মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল। গভীর অনুতাপে কয়েক শতাব্দী ধরে তারা রাভেন্না শহরের কাছে আবেদন জানায়- মহাকবি দান্তের পবিত্র কবর তাদের ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। তারা নিজেদের মাটির সন্তানকে নিজেদের দেশে নিয়ে গিয়ে সমাহিত করতে চায়। কিন্তু তাদের আবেদনে কখনই সাড়া দেয়নি রাভেন্নাবাসীরা।

উন্নতশির দান্তে- ভাস্কর্য

দান্তের নশ্বর দেহ এখনও শায়িত আছে বিপন্ন দিনের শেষ আশ্রয় রাভেন্নায়। মহাকবি দান্তের মৃত্যুর দীর্ঘকাল পরেও এখনও সগৌরবে উজ্জ্বল হয়ে আছে তাঁর সাহিত্যসৃষ্টি, বিশেষত তার অবিস্মরণীয় কীর্তি ‘ডিভাইন কমেডি’ ও অবিনশ্বর নারী বিয়াত্রিচে।

-সৌজন্যে দি ওয়াল