Home কলকাতা নিভে গেল ‘গীতশ্রী’ সন্ধ্যাদীপের শিখা

নিভে গেল ‘গীতশ্রী’ সন্ধ্যাদীপের শিখা

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়

বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক

মারা গেলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। আজ, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কলকাতার অ্যাপোলো হাসপাতালে জীবনাবসান হয় তাঁর। সকাল থেকেই অবনতি হয়েছিল তাঁর শারীরিক অবস্থার, সন্ধ্যায় চলে গেলেন গীতশ্রী। তাঁর মৃত্যুর খবরে শোকের ছায়া নেমেছে সঙ্গীতজগতে।

প্রবাদপ্রতিম সংগীতশিল্পী ‘গীতশ্রী’ সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।মঙ্গলবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) এক শোকবার্তায় তিনি বলেন, উপমহাদেশে গানের মুগ্ধতা ছড়ানোর পাশাপাশি মহান মুক্তিযুদ্ধে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

 পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর বঙ্গবন্ধু যখন দেশে ফিরে আসেন, সেই সময় স্বাধীন বাংলাদেশের দেশনায়কের উদ্দেশ্যে তিনি গান, “বঙ্গবন্ধু তুমি ফিরে এলে” গানটি।

Senco-Jan28-2022

গত ৬ ফেব্রুয়ারি  চিরবিদায় নিয়েছেন সঙ্গীতের সরস্বতী লতা মঙ্গেশকর। তাঁর কিছুদিনের মধ্যেই থামল গীতশ্রীর সুরও। ৯০ বছর বয়সে অন্য সুরলোকে চলে গেলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।

 

এদিন সন্ধ্যায় ফের সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছিল। আবারও আইসিইউতে নিতে হয়েছিল তাঁকে। হাসপাতাল সূত্রের খবর ছিল, পেটের যন্ত্রণায় তীব্র কষ্ট পাচ্ছেন গীতশ্রী। আজ সকালে তাঁর রক্তচাপের মাত্রাও দ্রুত ওঠা-নামা করছিল। ভেসোপ্রেসার সাপোর্টে রাখা হয়েছিল বর্ষীয়ান শিল্পীকে। পেটে ব্যথার জন্যও চিকিৎসা চলছিল তাঁর। তার মাঝেই এল দুঃসংবাদ, হাসপাতালেই থেমে গেল তাঁর দীর্ঘ লড়াই।

গত মাসের ২৭ তারিখে এসএসকেএমে ভর্তি হয়েছিলেন সন্ধ্যা। তাঁর পায়ের হাড় ভেঙে গেছিল এবং ফুসফুসে গভীর সংক্রমণ ছিল। করোনার রিপোর্টও পজিটিভ আসে তাঁর। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় অ্যাপোলো হাসপাতালে। সেখানেই কোভিড আইসোলেশন বিভাগে ছিলেন গায়িকা। চিকিৎসার পরে করোনা নেগেটিভ হন তিনি। সামান্য উন্নতিও হয় শারীরিক অবস্থার। কিন্তু আজ ফের অবনতি হওয়ায় বেড়েছিল উদ্বেগ।

অ্যাপোলোর কার্ডিওথোরাটিক সার্জারি বিভাগের ডিরেক্টর ডক্টর সুশান মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ৬ সদস্যের একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে চিকিৎসা চলছিল সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের। কার্ডিওলজি বিভাগের এইচওডি ডক্টর প্রকাশ চন্দ্র মণ্ডল ছাড়াও পালমোনোলজিস্ট দেবরাজ জশ ও সিনিয়র অর্থোপেডিক সার্জেন রঞ্জন কামিলিয়া ছিলেন তাঁর চিকিৎসার দায়িত্বে।

৪ অক্টোবর ১৯৩১ সালে কলকাতার ঢাকুরিয়াতে জন্মেছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। বাবা নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় চাকরি করতেন রেলের বড় পোস্টে। মা হেমপ্রভা দেবী গৃহবধূ। তাঁদের ছয় সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিলেন সন্ধ্যা। অবশ্য ছয় ভাইবোনের এক ভাই আর এক বোন খুব ছোট বয়সেই মারা যায়। বাকি চার ভাইবোন বরাবরই একে অন্যের ঘনিষ্টজ ছিল। তবে সন্ধ্যায় সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলেন তাঁর বড়দা রবীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। বড়দার উদ্যোগ আর ইচ্ছেতেই উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নিতে শুরু করেছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।

Senco-Jan28-2022

খুব যে গানবাজনার পরিবারে জন্মেছিলেন সন্ধ্যা, তেমনটাও নয়। তবে তাঁর মা হেমপ্রভা দেবী গান গাইতেন। কলকাতায় সে সময় রেডিও বা রেকর্ড প্লেয়ার কেনার সামর্থ্যও ছিল না সব মধ্যবিত্ত পরিবারের। বালিকা সন্ধ্যা ছেলেবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে বসে ঠাকুর দেবতার গান গাইতে ভালোবাসতেন। গানের প্রতি টান তাঁর কিশোরীবেলা থেকেই। পাড়ার কোনও বাড়ি থেকে রেডিওতে গানের সুর ভেসে এলে ছুটে যেতেন সন্ধ্যা।মায়ের কাছেই খুব ছোটবেলাতেই সরগম শেখার হাতেখড়ি হয়ে গেছিল তাঁর। বাড়িতে আত্মীয়স্বজন এলেও তাঁর ডাক পড়ত গান শোনানোর জন্য।

 

বোনের মধ্যে ভবিষ্যতের গায়িকা হওয়ার সম্ভাবনার আভাস পেয়েছিলেন দাদা রবীন্দ্রনাথ। দুবেণি দোলানো কিশোরী বোকে তিনিই নিয়ে যান গানের শিক্ষক যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে। সেই প্রথম শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের স্বাদ পেলেন সন্ধ্যা। অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্স বা অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্সের কিশোর বিভাগে তখন থেকে অংশ নিতে শুরু করেছেন সন্ধ্যা। তাঁর কণ্ঠের মাধুরী চমকে দিচ্ছে তখনকার স্বনামধন্য সুরকারদের, দৃষ্টি আকর্ষণ করছে প্রথিতযশা শিল্পীদের। এরই মধ্যে ১৯৪৪ সাল নাগাদ প্রথম বেসিক গানের রেকর্ড প্রকাশ পেল সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের। তাঁর বয়স তখন মাত্র ১৩ বছর। ওই বয়সেই গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে প্রকাশিত রেকর্ডে গেয়ে ফেললেন “তোমারো আকাশে ঝিলমিল করে চাঁদের আলো”।১৯৪৬ সালে গীতশ্রী পরীক্ষায় প্রথম স্থান পেলেন সন্ধ্যা। পাশাপাশি চলছিল ক্লাসিকাল গানের চর্চাও। সেসময় উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খাঁ সাহেবের কাছে গান শেখার ইচ্ছে ছিল সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের। বোনের সেই ইচ্ছে নিয়েই দাদা রবীন্দ্রনাথ ছুটে গেলেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের বাড়ি। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের মধ্যস্থতা কাজে লেগেছিল। তরুণী সন্ধ্যাকে গান শেখাতে রাজি হয়ে যান উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি। পণ্ডিতজীর ডিকসন লেনের বাড়িতেই তাঁর কাছে নাড়া বাঁধেন কিশোরী সন্ধ্যা। তারপর দীর্ঘ দিন, মাস, বছর ধরে চলে উস্তাদ বড়ে গুলাম আলির খাঁ সাহেবের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শিক্ষা ও অনুশীলন। দিনরাত কেটে যেত রাগচর্চায়, ঠুংরি, দাদরার সুরের সাধনায়। পাতিয়ালা ঘরানার সুরের ভাঁড়ার উজার করে দিয়েছিলেন উস্তাদজি তাঁর এই অসাধারণ ছাত্রীর কাছে। উস্তাদ বড়ে গুলাম আলির প্রয়াণের পরেও গান থামেনি সন্ধ্যার। উস্তাদ বড়ে গুলাম আলির পুত্র উস্তাদ মুনাওয়ার আলি খাঁর কাছে তালিম চালিয়ে গেছেন তিনি।১৯৪৮ সালে প্রথমবার ‘অঞ্জনগড়’ ছবির জন্য প্লেব্যাক গাইতে শোনা যায় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে। গান রেকর্ডিংয়ের আগে এক মাস ধরে সুরকার রাইচাঁদ বড়ালের তত্ত্বাবধানে অনুশীলন করতে হয়েছিল তাঁকে। সেটাই ছিল সেই সময়ের দস্তুর। ছবির সাথে যুক্ত সব শিল্পী, কলাকুশলীরা এসে হাজির হতেন রেকর্ডিংয়ের সময়। ‘সমাপিকা’ ছবির জন্য প্লেব্যাক করার সময় নায়িকা সুনন্দা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সন্দেহ ছিল এত অল্পবয়সী শিল্পীর গান তাঁর গলায় মানাবে কি না। শেষমেশ রেকর্ডিংয়ে হাজির থেকে নিশ্চিন্ত হয়ে গেছিলেন তিনি।

এরই মাঝে বেশ কিছু হিন্দি ছবির জন্য গান রেকর্ড করেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ১৯৫০ সালে ‘পহেলা আদমি’, ১৯৫১ সালে শচীন দেববর্মণের সুরে ‘সাজা’, সেই বছরেই অনিল বিশ্বাসের সুরে লতা মঙ্গেশকরের সাথে ডুয়েট “বোল পপিহে বোল”, ১৯৫৩ সালে মদনমোহনের সুরে ‘বাগী’, অনিল বিশ্বাসের সুরে ‘ফরেব’ তাঁকে এনে দেয় দেশজোড়া খ্যাতি। এমনই কোনও এক রেকর্ডিংয়ে তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হয়ে অভিনেতা, পরিচালক রাজ কাপুর তাঁকে অনুরোধ করেন তাঁর ডাবল ভার্সন ছবি ‘জাগতে রাহে’তে গাওয়ার জন্য।

জাগতে রাহো ছবিতে সলিল চৌধুরীর সুরে তাঁর গাওয়া “ম্যায়নে জো লি অঙ্গরায়ি” আজও অমলিন গানপাগল মানুষের স্মৃতিতে। রাইচাঁদ বড়াল থেকে শুরু করে রবিন চট্টোপাধ্যায়, অনুপম ঘটক, সলিল চৌধুরী, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, নচিকেতা ঘোষ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় – সমসাময়িক প্রায় সব দিকপাল সুরকারের সঙ্গেই সেসময় কাজ করেছেন সন্ধ্যা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের জুটি তো অমর হয়ে আছে উত্তম-সুচিত্রার লিপে একের পর এক কালজয়ীও গানে…।প্লেব্যাক গানের বাইরে বেসিক গানের দুনিয়াতেও তখন বেকছত্র সম্রাজ্ঞী ছিলেন সন্ধ্যা। “হয়ত কিছুই নাহি পাবো”, “মধুর মধুর বংশী বাজে”, “তারা ঝিলমিল স্বপ্ন মিছিল”, “গুন গুন মন ভ্রমরা”, “আয় বৃষ্টি ঝেপে, ধান দেবো মেপে”র মতো কালজয়ী সব গান। “মায়াবতি মেঘে এলো তন্দ্রা”, “ওগো সিঁদুর রাঙা মেঘ”, “ও বক বক বকুম বকুম পায়রা”, “শঙ্খ বাজিয়ে মাকে ঘরে এনেছি”,  “কি মিষ্টি দেখো মিষ্টি”, “কে তুমি আমারে ডাকো”, “চম্পা চামেলি গোলাপেরই বাগে”- তাঁর কণ্ঠে একের পর এক গানে সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলা গানের ভুবন।