রফিকুল আলম
ধুনট (বগুড়া):সুতা আর কুরুশকাঁটার বুনন দিয়ে তৈরি হচ্ছে বাহারি সব টুপি। এসব টুপি রপ্তানি হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে।
প্রায় চার দশক আগে বগুড়ার ধুনট উপজেলার নিমগাছী গ্রামে কয়েকজন গৃহবধূ কুরুশকাঁটা দিয়ে টুপি তৈরি শুরু করেন। প্রথম দিকে টুপিগুলো শুধু বাড়ির পুরুষ সদস্যদের ব্যবহারের জন্য তৈরি হলেও নব্বই দশকের শুরুতে তা বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি হয়।
সংসারের কাজের পাশাপাশি এই জালি টুপি তৈরিতে যুক্ত প্রায় আড়াই লাখ নারী, এমন দাবি সংশ্লিষ্টদের। তারা প্রতিদিন গড়ে ২০ লাখ টুপি তৈরি করেন। ব্যবসায়ীদের ভাষ্যমতে, শুধু বগুড়ায় বছরে অন্তত ২০০ কোটি টাকার টুপি তৈরি হয়।
বাংলাদেশ জালি টুপি ব্যবসায়ী অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জুয়েল আকন্দ বলেন, ‘দেশের গণ্ডি পেরিয়ে অনেক আগে থেকেই টুপি রপ্তানি হচ্ছে। আমরা বতর্মানে সৌদি আরব, ইরাক, ইরান, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভারত, পাকিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে টুপি রপ্তানি করি। এই টুপি-ব্যবসাকে কেন্দ্র করে বগুড়ায় ব্যাপক বাজারও গড়ে উঠেছে।’
বগুড়ায় ৮ থেকে ১০ জন ব্যবসায়ী টুপি রপ্তানি করেন। তাদের মধ্যে জুয়েল আকন্দের জুয়েল ক্যাপ ডিপো অন্যতম। এ ছাড়া রিপন ক্যাপ প্রোডাকটস, মাহফুজ ক্যাপ ডিপো, ইলিয়াস ক্যাপ প্রোডাক্টস, হক ট্রেডার্স, জাহিদ ক্যাপ ডিপো, এসএস ক্যাপ, আবদুল্লাহ অ্যান্ড ব্রাদার্সের নাম রয়েছে বাংলাদেশ জালি টুপি ব্যবসায়ী অ্যাসোসিয়েশনের তালিকায়।
টুপির কর্মযজ্ঞ ঘিরে কুটির শিল্পের আদলে নানামুখী কারখানাও গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে কেউ টুপি রপ্তানির প্রক্রিয়াজাত কারখানা গড়ে তুলেছেন। কেউবা টুপির উপযোগী সুতা তৈরির কারখানা স্থাপন করেন। আবার অনেকে টুপি ধোলাইয়ের জন্য কারখানা গড়ে তুলেছেন।
ব্যবসায়ী ও কারিগররা জানান, টুপি তৈরি করতে বেশি পুঁজির দরকার হয় না। এ জন্য সুতা কিনতে হয়। সুতা পাওয়া যায় ববিন আকারে। প্রতি ববিন সুতার দাম ৭০ থেকে ৭৫ টাকা।
এক ববিন সুতায় ১৫ থেকে ২২টি টুপি হয়। একটি টুপি তৈরি করে হাতে আসে গড়ে ৩৫ টাকা। একজন নারী বা কারিগর সংসারের কাজ করে দিনে ১০টি পর্যন্ত টুপি তৈরি করতে পারেন।
গড়ে প্রতিদিন তাদের আয় হয় সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। আর প্রতিটি টুপি বাইরে ৪০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হয়।
বর্তমানে শুধু ধুনট নয়, জেলার সদর, শেরপুর, শাজাহানপুর, শিবগঞ্জ, কাহালু, নন্দীগ্রামের বিভিন্ন গ্রামে টুপি তৈরি করছেন নারীরা। গৃহবধূদের পাশাপাশি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও কিশোরীরাও টুপি তৈরি করছেন। টুপি তৈরি করে অনেক নারী সংসারের হাল ধরেছেন। কেউবা দারিদ্র্য ঘুচিয়েছেন।
বছরের অন্য সময়ের চেয়ে পবিত্র রমজান মাসে টুপির চাহিদা বেশি থাকে। এ কারণে শবেবরাতের পর থেকে পরবর্তী এক মাসে দ্বিগুণের বেশি উৎপাদন হয় টুপি। এই সময়ে আয়ও বেড়ে যায় নারীদের। এবার করোনার প্রভাব টুপিশিল্পেও পড়ে। তবে করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় ফের কর্মচঞ্চলতা বেড়েছে টুপি তৈরির গ্রামগুলোতে।
ধুনট উপজেলার পূর্ব ভরনশাহী গ্রামের রঞ্জনা বেগম। প্রায় ১৫ বছর ধরে টুপি তৈরি করছেন। ভ্যানচালক স্বামী ও দুই সন্তানের জননী রঞ্জনা বাড়ির উঠানে টুপি তৈরি করছিলেন। কাজ করতে করতে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনার কারণে পাইকারি ব্যবসায়ীরা টুপি কেনা বন্ধ রেখেছিলেন। কিন্তু এখন ঈদ সামনে রেখে টুপি ব্যবসায় কিছুটা জোয়ার এসেছে। ব্যবসায়ীরা যোগাযোগ করছেন আমাদের সাথে।’
একই গ্রামের বাসিন্দা লতা বেগম। টুপি তৈরি করেন স্কুলশিক্ষার্থী থাকা অবস্থায়। তিনি বলেন, ‘সংসারের পাশাপাশি টুপি তৈরি করে ভালো আয় করা যায়। দিনে সাত থেকে আটটা টুপি বানাই। এতে প্রতি মাসে ৮-৯ হাজার টাকা আয় হয়।’
কলেজ বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থী আনিকা খাতুন বাড়ি এসে টুপি তৈরি করছেন। তিনি বলেন, ‘ঈদের আগে এই ব্যবসা জমজমাট হবে। টুপি তৈরি করে মাসে প্রায় ১০ হাজার টাকা আয় করছি। এতে আগামী কয়েক মাস আমার পড়াশোনার খরচ চলবে।’
১০ বছর আগে স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে টুপি তৈরি করে সংসারের হাল ধরেছেন শেরপুরের চৌবাড়িয়া গ্রামের আয়েলা বেগম। তিনি বলেন, ‘এই টুপি তৈরি করে এক সন্তানকে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করিয়েছি। আমার সংসারের অভাব ঘুচিয়েছে এই টুপির কাজ।’
জালি টুপি ব্যবসায়ী অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মুকুল হোসেন বলেন, শুধু বগুড়ায় বছরে অন্তত ২০০ কোটি টাকার টুপি তৈরি হয়। অধিকাংশই রপ্তানি করা হয়। তবে গত বছর করোনার কারণে টুপি ব্যবসায় কিছুটা ভাটা পড়ে।
তিনি বলেন, ঈদ সামনে রেখে আবার চাঙা হতে শুরু করেছে এ টুপিশিল্প। নারীদের কুটির শিল্পকে বিকশিত করা গেলে এই শিল্প আরও বিস্তার লাভ করবে।
সভাপতি জুয়েল বলেন, ‘কিশোর বয়স থেকেই টুপি ব্যবসার সঙ্গে আছি। আগে বগুড়ার বিভিন্ন মসজিদে টুপি বিক্রি করতাম। স্কুল জীবনেই ঢাকার চকবাজারে টুপি বিক্রি শুরু করি। এখন দিন পাল্টেছে। দেশের বাইরে প্রতিবছর কয়েক কোটি টাকার টুপি বিক্রি করি।’
‘২০০৪ সালে মেশিন কিনে সুতা প্রক্রিয়াকরণ কারখানা দিলাম। ২০০৫ সালে রপ্তানিযোগ্য টুপি প্যাকেজিংয়ের জন্য ধোলাই কারখানা স্থাপন করি।’
টুপিশিল্পের সঙ্গে যুক্ত নারীদের ঋণ দেয়া হয় কি না জানতে চাইলে বগুড়া বিসিকের উপব্যবস্থাপক জাহেদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রত্যন্ত অঞ্চলে কুটির শিল্পের আদলে গড়ে ওঠা কারখানাগুলো ঋণ সহায়তা নেয়ার জন্য আমাদের কাছে আসে না। এমনকি সরকারি প্রণোদনা দেয়ার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েও লোকজন পাওয়া যায় না। প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও একই। তবে উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে প্রশিক্ষণ দিলে ভালো লাভ হবে বলে মনে হচ্ছে।’