কিংসফোর্ডের হত্যা ব্যর্থ হওয়ার পর ক্ষুদিরাম আর প্রফুল্ল চাকী পালিয়ে যান।
তারপর প্রফুল্ল চাকী অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে গ্রেফতার এড়ানোর জন্য ছদ্মবেশে ট্রেনে করে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। ট্রেনে নন্দলাল ব্যানার্জী নামে পুলিশের এক দারোগা সমস্তিপুর (মোকামঘাট রেলস্টেশন) রেল স্টেশনের কাছে প্রফুল্ল চাকীকে দেখে সন্দেহ করে। দারোগা সন্দেহ করায় প্রফুল্ল চাকী পালাবার চেষ্টা করেন। ট্রেন থেকে নেমে দৌড়ে অনেক দূর চলে যান। কিন্তু নন্দলাল দারোগা তাঁর পিছু ছাড়ে না, বরং ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার শুরু করল। তখন স্টেশনে পাহারারত পুলিশ ও জনতা প্রফুল্ল চাকীকে ধরার জন্য পিছু ছুটতে থাকল। প্রফুল্ল চাকী দারোগাকে লক্ষ্য করে একটি গুলি ছুড়লেন। কিন্তু গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। এরপর তিনি আর গুলি ছুড়লেন না। যদি পুলিশের হাতে ধরা পড়েন তাহলে দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাকী গুলি দিয়ে নিজেকে হত্যা করবেন। যার নাম আত্মহত্যা। কারণ ধরা পড়ার পর পুলিশের মারের মুখে বিপ্লবীদের অনেক গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যেতে পারে। দৌড়ানোর এক পর্যায়ে প্রফুল্ল চাকী কোণঠাসা হয়ে পড়েন। দারোগা প্রায় তাঁর কাছাকাছি চলে এলো, কিছুক্ষণের মধ্যেই ধরে ফেলবে তাঁকে। এমন সময় পকেটে রাখা রিভলবার বের করে চিবুকের নীচে ধরে পর পর ২টি গুলি নিজ দেহে বর্ষণ করে আত্মাহুতি দেন প্রফুল্ল চাকী।
প্রফুল্লর শরীরে যে-দু’টি গুলির ক্ষতস্থান দেখা যাচ্ছে, ফরেনসিক ও বিভিন্ন সমীক্ষার প্রেক্ষিতে আত্মহত্যার ক্ষেত্রে খুবই বিরল ঘটনা বলে মনে করা যেতে পারে। কেননা, তিনি ডান-হাতি ছিলেন এবং ওই দু’টি স্থানে অর্থাত্ শরীরের বাঁ দিকে পিস্তলে নল ঘুরিয়ে নিজে-নিজে একটি নয় দু’টি গুলি করা রীতিমতো অসুবিধাজনক শুধু নয়, তা প্রায় অসম্ভবই (not within easy access)। এ ছাড়া গুলির ক্ষতের আকৃতি এবং ব্যাস দেখে মনে হয় না এগুলি near contact অথবা contact shot-এর কারণে ঘটেছে, যা আত্মহত্যার ক্ষেত্রে সব সময় হয়ে থাকে। কালো রঙের ছাপও সেখানে অনুপস্থিত।
ব্রিটিশ পুলিশের রেকর্ডের বয়ান অনুযায়ী, প্রফুল্ল আত্মহত্যা করেছিলেন এই নিশ্চিত-মত এ যাবৎ সকলেই পোষণ করেছেন। অথচ, যে-যে যুক্তিগুলি তাঁর আত্মহত্যার তত্ত্বকে সমর্থন করছে না সেগুলি সংক্ষেপে এইরকম–
১। সুদেহী প্রফুল্লর সঙ্গে গুলিভরা পিস্তল থাকতে বিনা বাধায় তিনি আত্মসমর্পণ করে স্বহননে প্রবৃত্ত হবেন এমন দুর্বল চিত্তের মানুষ তিনি ছিলেন না। কেউ কেউ বলেছেন, তিনি পুলিশের উদ্দেশে গুলি ছুড়েছিলেন, তবে তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। অথচ, অন্য তথ্য থেকে জানা যায়, তিনি পিস্তল ছোড়ায় দক্ষ ছিলেন, গুলি ছোড়ার রীতিমতো অভ্যাস করতেন মুরারিপুকুর-বাগানবাড়িতে। তবে বিপদকালে উত্তেজনাবশে তিনি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিলেন, সেটাও হতে পারে!
২। তাঁর কাঁধে এক কনস্টেবল সজোরে লাঠির আঘাত করেছিল। শুধু একটিই? তা হলে নীচের ঠোঁটের গভীর ক্ষতের কারণ কী? কান-মুখ দিয়ে রক্ত বেরুনোর অস্পষ্ট দাগ? এসব অত্যধিক দৈহিক পীড়নের ফল নয় কী?
৩। দু’টি গুলির ক্ষতের স্থান নির্দেশ করে একজন বাঁ-হাতির পক্ষেই এই স্থানে গুলি করে আত্মহত্যা করা সম্ভব। প্রফুল্ল স্বাভাবিক ডান-হাতি ছিলেন।
৪। vital organ-এ একাধিক গুলিতে আত্মহত্যার ঘটনা বিরল, কেননা প্রথমটির পরে শারীরিক ক্ষমতা তেমন আর থাকে না।
৫। কোনও competent authority কেন, কোনও ডাক্তারের দেওয়া মৃত্যুর সার্টিফিকেটও নেই।
অতএব, প্রফুল্ল চাকী আত্মহত্যা করেছিলেন প্রচলিত এই ‘অতিসরল’ কথাটি মেনে নিতে অনেকের প্রবল আপত্তি রয়েছে। বরং হত্যার লক্ষণগুলিই এখানে প্রকট। প্রফুল্লর পিস্তলটি বাজেয়াপ্ত করে দেখা যায়, সেখানে ৪টি কার্তুজ রয়েছে, অর্থাৎ ৩টি খরচ হয়েছিল। ছবিতে দু’টি গুলির ক্ষত শরীরে দেখা গেছে। তা হলে আর একটি গুলির লক্ষ্য জানা যাচ্ছে না। তো হতে পারে তা পুলিশের উদ্দেশেই, যা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিল, অথবা প্রফুল্লর শরীরের অন্য কোনও অংশে তা আছে, যা ছবিতে দেখা যাচ্ছে না। শুধু ফোটো নেওয়া ছাড়া (দু’টি ছবিরই শুধু সন্ধান মেলে) পুলিশের পক্ষ থেকে অবশ্য-কর্তব্যের কোনওটিই পালিত হয়নি। এবং তাই আসল সত্য নিয়ে এই এত দিন পরেও ধোঁয়াশা রয়ে যায়।