বট একটি ফলের নাম। তবে এই ফল মানুষে খায় না।বট গাছের ফল কাক, শালিক ও বাদুড়ের প্রিয় খাদ্য। বটগাছ শকুন ও পাখির নিরাপদ আশ্রয়স্থল।প্রাচীনকাল থেকেই বটবৃক্ষের ছায়ায় হাট-বাজার বসে, মেলা হয়, লোকগানের আসর বসে, জনসভারও আয়োজন হতো। কারণ হিসেবে বলা যায়, বাংলার গ্রামাঞ্চলে বড় বড় সুশীতল হলরুম ছিল না। আর তাই বড় বড় অনুষ্ঠান ও জনসভাগুলো ছায়াসুনিবিড় বটতলায় অনুষ্ঠিত হতো।
বাংলাদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বী লোকেরা শিবের (মহাদেব) ছায়াবৃক্ষ হিসেবে মান্য করে থাকে৷ যার কারণে এই বট গাছ ভারত ও বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষেরা কাটেও না,বট গাছের লাকড়ি পোড়ায়ও না। এখনো হিন্দু ঘনবসতি এলাকায় এই বট গাছের বা নিকটে মন্দির স্থাপন করে পূজা অর্চনা দিতে দেখা যায়। আর বট গাছের নিছে শিবের (মহাদেব) হাতের একটা অস্ত্র(ত্রিশুল) গাড়া থাকবেই।
বট গাছকে ঘিরে বাংলায় রয়েছে শত সহস্র বছরের ঐতিহ্য৷ আর এই ঐতিহ্য বহনকারী একটি বট গাছ ছিল চট্টগ্রামের মোগলটুলিতে। উষ্ণ আবহাওয়ায় বিশাল আয়তনের এই ছায়াবৃক্ষটির নীচে মানুষ শীতল বাতাস গারেয় মেখে সস্তি নিতো। চট্টগ্রাম নগরীর বট তলা এখন কাটা বটগাছ নামে পরিচিত বট গাছ মানে নিছক একটা গাছ নয়, ঐতিহ্যও বটে। বটগাছ চিনেনা এমন কেউ নেই। আবার কোনো দেশের জাতীয় গাছ। এক সময় সন্ধ্যার দিকে গাছের মাথায় হাজারো পাখির ডাক শোনা যেত, দেখা যেত গাছের কোটরে কাঠবেড়ালি, বেঁজি। গরমে দুপুরে গাছ তলায় চলত মাদুর বিছিয়ে ঘুম। সময়ের সাথে সাথে তা হারিয়ে গেছে। গ্রামের পাশাপাশি শহরেও ছোখে পড়ে না। ইমারত উঠবে কিংবা চওড়া রাস্তার জন্য কেটে ফেলা হয়েছে।
নগরীর ২৮নং ওয়ার্ডের কাটা বট গাছের কথা বলছিলাম। শতবর্ষীয় গাছটির কারণে জায়গাটি মোগলটুলি বটতলা নামে পরিচিতি ছিলো। ৮০’র দশকের পর তৎকালীন প্রয়াত এরশাদ সরকারের আমলে রাস্তা প্রশস্তকরণসহ বিদ্যুতের এগার হাজার ভোল্টের তামার তারের পরিবর্তে এ্যালমুনিয়াম তারের লাইন টানা হয়। একই সাথে গাছের তৈরি বিদ্যুতের খুঁটির পরিবর্তে বসানো হয় সিমেন্টের পিলার। তারের সংযোগে বাঁধা এবং রাস্তা প্রশস্ত করার কারণে কাটা পড়ে গাছটিও।
জানা গেছে, বট গাছ সাধারণত কমপক্ষে চারশ বছর বাঁচে। বসন্ত ও শরতে বট গাছে নতুন পাতা গজানোর দিন। এ সময় কচি পাতার রং উজ্জল সবুজ থাকে। গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীত হলো ফল পাকার সময়। বট ও বট জাতীয় গাছের বংশ বৃদ্ধির পদ্ধতি ও কৌশল প্রধানত অভিন্ন। মঞ্জরির গর্ভে ফুলগুলো লুকানো থাকে। ফুলগুলো খুবই ছোট এবং ফলের মতোই গোলাকার। একলিঙ্গিক এই ফুলগুলো পরাগায়ণের জন্য বিশেষ জাতের পতঙ্গের উপর নির্ভরশীল। পাখিরা ফল খেয়ে বীজ ছড়িয়ে দেয়৷ পাখিবাহিত এই বীজ দালানের কার্নিস, পুরানো দালানের ফাটল ও অন্য কোনো গাছের কোটরে সহজেই অঙ্কুরিত হয় এবং আশ্রয়কে গ্রাস করে ফেলে। এ কারণে উপগাছা বা পরগাছা হিসেবেও বটের বেশ খ্যাতি আছে।
এই বট এমনই একটা গাছ তার ফল হতে বীজ সংগ্রহ করে বপন করলে গাছ জন্মায় না। আবার কোনো দালানের কার্নিস হতে তৈরি গাছ উঠিয়ে এনে রোপণ করলে হয়। মোগলটুলি কাটা বট গাছ এলাকায় স্থানীর বাসিন্দা মোহাম্মদ সরোয়ার বিজনেসটুডে২৪ কে বলেন, বর্তমানে বট গাছের চিহ্নটিও নেই। ওখানে গড়ে উঠেছে পাকা ভবন। মগ পুকুর পাড়, পাকা পুকুর পাড় নাম আছে কিন্ত পুকুর নেই। বর্তমানে এই এলাকায় ষাট হাজার ভোটারসহ আনুমানিক এক লাখ বিশ হাজার লোকের বসবাস। এক সময় মোগলটুলি বটতলার মোড় বললে সবাই চিনত। এখন আর সেই নামে চিনে না। গাছ কেটে ফেলার পর এখন কাটা বট গাছের মোড় বললে সবাই এক নামে চিনে।
উল্লেখ্য, বট গাছ (ইংরেজী:Indian banyan), (বৈজ্ঞানিক নাম:Ficus benghalensis) ফাইকাস বা (ডুমুর জাতীয়) গোত্রের ইউরোস্টিগ্মা উপগোত্রের সদস্য৷ এর আধি নিবাস বঙ্গভূমি (বাংলাভাষী) অঞ্চল৷ এটি একটি বৃহদাকার বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ৷ বট গাছ সাধারণত দুই প্রকারই বেশি দেখা যায়, কাঁঠালি বট ও জিরা বট৷ বট গাছ খুব বড় জায়গা জুড়ে জমির উপর সমান্তরাল শাখা প্রশাখা বিস্তার করে যারা স্তম্ভমূলের উপর ভর দিয়ে থাকে। স্তম্ভমূল প্রথমে সরু সরু ঝুরি হিসেবে বাতাসে ঝুলে। পরে মাটিতে প্রোথিত হলে স্তম্ভমূলের মাটির উপরের অংশ বিটপে পরিবর্তিত হয়। বটের কুঁড়ি পাংশুটে হলুদ এবং এর দুটি স্বল্পায়ু উপপত্র পাতা গজানোর পরই ঝরে পড়ে৷ খুব অল্প বয়স থেকেই বট গাছের ঝুরি নামতে শুরু করে। মাটির সমান্তরালে বাড়তে থাকা ডালপালার ঝুরিগুলো একসময় মাটিতে গেঁথে গিয়ে নিজেরাই একেকটা কাণ্ডে পরিণত হয়ে ধীরে ধীরে চারপাশে বাড়তে থাকে এবং একসময় মহীরুহে পরিণত হয়।
-সুমন চৌধুরী