Home অন্যান্য বাস্তবায়নের ওপর নির্ভরশীল বাজেটের সুফল

বাস্তবায়নের ওপর নির্ভরশীল বাজেটের সুফল

প্র্রফেসর ড. মো. সেলিমউদ্দিন

বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি

ঢাকা: বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইনান্স কর্পোরেশন ও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ড. মো. সেলিম উদ্দিন প্রস্তাবিত বাজেট প্রসঙ্গে বলেছেন যে মোটামুটি বড় ধরনের নতুন কোন কর আরোপ ছাড়াই এই বাজেট প্রণীত হয়েছে। সব পক্ষকে মোটামুটি স্বস্তি দিয়ে এই বাজেট বাস্তবায়নের যে পরিকল্পনা রচিত হয়েছে সেটি সঠিক অর্থে দক্ষতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে এবং সময়মত বাস্তবায়নের সব কর্মকৌশল গ্রহণ ব্যতীত সফলতা দূরহ হবে।

বিশ্বব্যাপী মহামারী কোভিড-১৯-এর প্রভাবে বিগত বছর থেকে আমাদের জীবন তথা স্বাস্থ্য এবং জীবিকা তথা অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে এক অস্বাভাবিক, অসাধারণ, অস্থির, অনিশ্চিত, বিপদজনক ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, যেটি এখনও অনেকটা চলমান। বিদ্যমান এই পরিস্থিতিতে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটটি জীবনকে সুরক্ষা অর্থাৎ স্বাস্থ্য ঝুঁকিকে ন্যূনতম রাখার কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে জীবিকা তথা অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে গতি সঞ্চারের উদ্দেশ্যকে প্রাধান্য দিয়ে প্রণয়ন ও ঘোষিত হয়েছে।

সার্বিক পর্যালোচনায় বলা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটটিতে জীবন ও জীবিকার মধ্যে অত্যন্ত চমৎকার সমন্বয়ের বিভিন্ন দিক প্রতিফলিত হয়েছে। যেমন : স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, কৃষি এবং অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে গতিশীলতা আনয়ন, নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ, নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি ইত্যাদির জন্য বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি, কর অবকাশসহ নানা ধরনের কর ছাড় ও কর মওকুফের বিষয়গুলো অগ্রাধিকার পেয়েছে। কিন্তু বিগত বছরগুলোর বাজেট বাস্তবায়ন পর্যালোচনা করলে এই ধারণা স্পষ্টত যে, বাজেট পুরোপুরি বাস্তবায়িত হচ্ছে না এবং প্রস্তাবিত ব্যয় বরাদ্দ অব্যয়িত থেকে যাচ্ছে যার কারণে প্রস্তাবিত স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা এবং অবকাঠামোসহ অন্যান্য বরাদ্দের আওতায় পরিকল্পিত কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হচ্ছে না।

উদাহরণস্বরূপ চলতি অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে সংশোধিত এডিপিতে প্রায় ১৩,৮৬৫ কোটি টাকা বরাদ্দের অনুকূলে জুলাই ২০২০ থেকে এপ্রিল ২০২১ দশ মাসে ব্যয় হয়েছে ৪০০০ কোটি টাকার মতো, যেটি বরাদ্দের ২৯ শতাংশ।

এই বাজেটের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সামাজিক সুরক্ষা খাতে মোট ১,০৭,৬১৪ কোটি টাকার বরাদ্দ যেটি বাজেটের ১৭.৮৩ শতাংশ এবং জিডিপির ৩.১১ শতাংশ। এই সরকার ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে ১৩,৮৪৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল, যেটি চলতি বাজেট ২০২০-২১-এ প্রায় ৭ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৯৫,৫৭৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। কুটির, অতিক্ষুদ্র, অতি ছোট, মাঝারি (সিএমএসএমই)-এর সহায়তা, স্বাস্থ্য খাতে নানা কর্মসূচি, কৃষিতে গুরুত্ব এবং সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাজেটে অতি দরিদ্রের হার ১২.৩ শতাংশ থেকে ২০২৩-২৪-এর মধ্যে ৪-৫ শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন। এই চিন্তা চেতনা বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য দিক বলে আমি মনে করি।

গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করার জন্য এবং গ্রাম থেকে শহরের মাইগ্রেশন থামানোর লক্ষ্যে ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ গ্রামীণ রাস্তাঘাট উন্নয়ন ও সংস্কার, যোগাযোগহীন গ্রামের মধ্যে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ, একটি বাড়ি একটি খামার ইত্যাদিসহ নানা প্রকার কর্মসূচি সম্পাদনে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে ৪১,০১০ কোটি টাকা বরাদ্দ ঈপ্সিত অতি দরিদ্রের হার কমানোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।

প্রস্তাবিত বাজেটে দেশি শিল্পকে সুরক্ষা, করোনাজনিত কারণে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য নতুন শিল্প স্থাপনে ও বর্তমান শিল্প সম্প্রসারণে এবং সর্বোপরি শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি সঞ্চারের লক্ষ্যে অনেক ধরনের কর ছাড়, রাজস্ব সংস্কার ও রাজস্ব সহজীকরণ করা হয়েছে। কর ছাড়, কর অব্যাহতি, কর অবকাশ এবং কর কৌশলগুলোর মধ্যে অন্যতম- টার্নওভার কর ০.৫ শতাংশ থেকে ০.২৫ শতাংশ, পাবলিক ও প্রাইভেট কোম্পানির জন্য ২.৫ শতাংশ কর ছাড়, একক ব্যক্তি কোম্পানির ক্ষেত্রে ৩২.৫ শতাংশ হতে ২৫ শতাংশ কর হার, আয়শূন্য সম্পদের ওপর সারচার্জ বাতিল, ন্যূনতম সারচার্জ বিলুপ্ত, আমদানি পর্যায়ে শিল্পের কাঁচামালের ওপর অগ্রিম কর ৪ শতাংশ হতে ৩ শতাংশ, সিমেন্ট ও লৌহজাত শিল্পের ক্ষেত্রে আমদানিকৃত কাঁচামালের ওপর ৩ শতাংশ হতে ২ শতাংশে হ্রাস, ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠায় মেগা শিল্পে ২০ বছর কর অবকাশ, হোম অ্যাপলায়েন্স ও আইটি সংযোজন শিল্পের জন্য ১০ বছরের কর ছাড়, মানবসম্পদ উন্নয়নে পেশাগত প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান স্থাপনে ১০ বৎসরের কর মওকুফ, পেরি-আরবান এলাকায় (ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ ছাড়া) হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ১০ বছরের কর অব্যহতি, অটোমোবাইল, থ্রি-হুইলার, ফোর-হুইলার ও হালকা প্রকৌশল শিল্পের জন্য কর ছাড়, এসএমই ও নারী উদ্যেক্তাদের জন্য ৭০ লাখ টার্নওভার করমুক্ত রাখাসহ নানা ধরনের কর প্রণোদনা দেয়া হয়েছে।

উল্লেখিত বিষয়সমূহকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে ‘জীবন জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’ শিরোনামের প্রস্তাবিত ২০২১-২২ বাজেটটি ৩ জুন, ২০২১ মহান জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেন। এই সরকারের প্রতিটি বাজেটই রেকর্ড ভেঙেছে। এবার তৃতীয় মেয়াদের তৃতীয় বাজেটও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বাজেট ২০২১-২২-এ মোট ব্যয় প্রাক্কলন হয়েছে ৬,০৩,৬৮১ কোটি টাকা। যেটি সংশোধিত ২০২০-২১ থেকে ৬৪,৬৯৮ কোটি টাকা বা ১২ শতাংশ বেশি। একইভাবে মোট রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৩,৮৯,০০০ কোটি টাকা যেটি সংশোধিত ২০২০-২১ অর্থসাল থেকে ৩৭,৪৬৮ কোটি টাকা বা ১১ শতাংশ বেশি। মোট ব্যয় এবং রাজস্ব প্রাক্কলনের সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণে বলা যায় যে, মোট ব্যয় ও রাজস্ব প্রবৃদ্ধি প্রায় সমান এবং মোট বাজেট ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২,১৪,৬৮১ কোটি টাকা, যেটি জিডিপির ৬.২০ শতাংশ।

২০২০-২১ সংশোধিত বাজেটে ঘাটতি দাঁড়াবে ১,৮৭,৪৫১ কোটি টাকা, যেটি জিডিপির ৬.১ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে বহিঃ উৎস হতে ১,০১,২২৮ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস হতে ১,১৩,৪৫৩ কোটি টাকা যার মধ্যে ব্যাংক ঋণ ৭৬,৪৫২ কোটি টাকা ঘাটতি অর্থায়নের প্রাক্কলন করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, ২০২০-২১ সংশোধিত বাজেট বহিঃ উৎস হতে ৭২,৩৯৯ কোটি এবং অভ্যন্তরীণ উৎস হতে ১,১৫,০৫২ কোটি টাকা, যার মধ্যে ব্যাংক ঋণ ৭৯,৭৪৯ কোটি টাকার অর্থায়ন পুনঃপ্রাক্কলন করা হয়েছে।

ঘাটতি অর্থায়ন বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে যে, বহিঃ উৎস হতে অর্থায়ন টার্গেট অনুযায়ী না হওয়ায় এবং রাজস্ব আদায় ঘাটতির কারণে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে বাজেটের টার্গেট অতিরিক্ত ঋণ নিয়ে ঘাটতি অর্থায়নের ব্যবস্থা করতে হয়, তাই বাজেট ২০২১-২২ এ ঘাটতি অর্থায়ন ২,১৪,৬৮১ কোটি টাকা একটি বিরাট চ্যালেঞ্জিং। কেননা অভ্যন্তরীণ উৎস বিশেষ করে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে বাজেট অতিরিক্ত ঋণ নিলে বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাপ্রাপ্তসহ তারল্য সংকট এবং মুদ্রাস্ফিতিতে বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। বিগত তিন বছরে ২০১৬-১৭ থেকে ২০১৮-১৯ পর্যন্ত যথাক্রমে ৭.২৮,৭.৮৬ এবং ৮.১৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল এবং সামষ্ঠিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার আলোকে ২০১৯-২০ বছরে প্রবৃদ্ধি ৮.২ শতাংশ লক্ষ্য মাত্রার বিপরীতে বিশ্বব্যাপী করোনার প্রভাবে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে আগ্রাসী আক্রান্তে ৫.২ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। বাজেট ২০২০-২১ এ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৮.২ শতাংশ এবং সংশোধিত হার ৬.২ শতাংশ। বাজেট ২০২১-২২ এ জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭.২ শতাংশ ধরা হয়েছে। বাজার চাহিদাসহ অর্থনৈতিক কর্মকান্ড কোভিড-১৯ পূর্ববর্তী অবস্থায় পুনর্বাসন হলে হয়তো এই প্রবৃদ্ধি অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য বর্তমান বিনিয়োগ যথেষ্ট নয়। সক্ষমতার অভাবে এডিপি বাস্তবায়ন পুরোপুরি না হওয়ায় সরকারি বিনিয়োগ কাঙ্খিত মাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছে না।

আবার বছর বছর সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়, এর গুণগতমান বৃদ্ধি এবং অর্থবছর শেষ তিন মাসে বা শেষ প্রান্তিক অত্যাধিক ব্যয় প্রবণতার কারণে সরকারি অর্থের অপচয়, কাজে নিম্নমান ও গুণগতমান হ্রাস, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্য দেখা দেয়। অন্যদিকে নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ গত কয়েক বছর ধরে ২৩-২৪ শতাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।

নিম্ন আয়ের ব্যক্তিবর্গ, কুটির শিল্প, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প ও ব্যবসায়ীদের কোভিড-১৯-এর ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য কর হার হ্রাস, কৃষি ও কৃষি উপখাতে নিয়োজিত কৃষি যন্ত্রপাতিতে শুল্ক হ্রাস, ভ্যাট রেয়াত, কাস্টমের হয়রানি রোধে বিভিন্ন কর্মকৌশল, রপ্তানিমুখী দেশীয় এবং আমদানি পরিপূরক শিল্প ও ব্যবসাকে সুরক্ষায় বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনার প্রবর্তন, শুল্ক হ্রাস, কর হার হ্রাস, রাজস্ব প্রণোদনাসহ বিভিন্ন নীতি কৌশলের সহায়তা বাজেটে পরিস্ফুটিত হয়েছে।