তিয়াষ মুখোপাধ্যায়
২২ বছরের সঞ্জয় মণ্ডলের (নাম পরিবর্তিত) যৌনাঙ্গের বাইরের দিকে ফুলে ওঠা একটি মাংসপিণ্ড। ক্রমেই সেটি বেড়ে উঠতে থাকে। ডাক্তারের দ্বারস্থ হয় সন্তুর পরিবার। কিন্তু ততদিনে চার সেন্টিমিটার হয়েছে আয়তন।
এটি ‘স্কোয়ামাশ কার্সিনোমা’ বলে মনে করা হয় প্রাথমিক পরীক্ষায়। অর্থাৎ যৌনাঙ্গের চামড়ায় হওয়া এক ধরনের স্কিন ক্যানসার।
সব রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরে সেটি অস্ত্রোপচার করা হয় নেতাজি সুভাষ ক্যানসার হসপিটালে। অঙ্কোসার্জেন ডক্টর সৌমেন দাস করেন এই অস্ত্রোপচার।
কিন্তু তখনও কেউ জানতেন না, এটা একটি ম্যালিগন্যান্ট গ্রোথ হলেও তা আর পাঁচটা ম্যালিগন্যান্ট টিউমারের মতো নয়। এটা আদতে বিরল থেকে বিরলতম এক জটিল সমস্যা, ‘ইউয়িং সারকোমা’ (ewing sarcoma)।
কেন বিরল? কারণ যৌনাঙ্গে এই সারকোমার সমস্যা এর আগে গোটা বিশ্বে মোট ৬ জন রোগীর শরীরে ধরা পড়েছে। সঞ্জয়ের ক্ষেত্রে এমনটা প্রথমে ভাবতে পারেননি কেউ। কিন্তু অস্ত্রোপারের পরে স্পেসিমেন দেখে সবার প্রথমে এই সন্দেহ যিনি করেন, তিনি ডক্টর নির্মাল্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
এর পরে ডক্টর নির্মাল্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে কলকাতার নেতাজি সুভাষ হাসপাতালের অঙ্কো-প্যাথলজি ডিপার্টমেন্টে গভীর পরীক্ষানিরীক্ষা করা হয়। নির্মাল্যবাবুর সঙ্গে ছিলেন ডক্টর অমিতাভ দত্ত। তখনই পরীক্ষায় দেখা যায়, এটি আদৌ কোনও ক্যানসার নয়, এটি ইউয়িং সারকোমা!
কী এই সারকোমা?
এক ধরনের বিরল ম্যালিগন্যান্ট টিউমার বলা যেতে পারে সারকোমাকে। সারা বিশ্বে ১ শতাংশ শিশুর এই অসুখ দেখা যায়। ভারতে যত রকম ক্যানসার দেখা যায়, তার ০.২ শতাংশ হল এই সারকোমা। সাধারণত খুব বেশি হলে ১৫ বছর পর্যন্ত এই অসুখ হয়। তবে এক্ষেত্রে সঞ্জয়ের প্রথম উপসর্গ দেখা দেয় ২২ বছর বয়সে, যা বলতে গেলে খুবই অস্বাভাবিক।
শুধু তাই নয়, এটি মূলত শরীরের বিভিন্ন অংশের হাড়, মাংসপেশি, নার্ভ, রক্তনালী ইত্যাদি স্থান থেকে উৎপত্তি হয়। সারকোমা মূলত হাড়ে এবং নরম টিস্যুর ম্যালিগন্যান্ট টিউমার। এক্ষেত্রে সঞ্জয় মণ্ডলের হয়েছিল নরম টিস্যুর ম্যালিগন্যান্ট টিউমার। তাঁর যৌনাঙ্গে বাসা বেঁধে ছিল এই ভয়ানক টিউমার। যৌনাঙ্গের চামড়ায় সারকোমা বলতে গেলে বিরল থেকে বিরলতম।
সারকোমা বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন আশপাশের মাংসপেশি বা নার্ভকে চাপ দেয়, তখনই অস্বস্তি বা ব্যথার সৃষ্টি হয়। তাই লক্ষণ প্রকাশ না পাওয়া পর্যন্ত একে শনাক্ত করা কঠিন। ঠিক যে কারণে দেরি হয়ে যায় অনেক সময়। হাড়ে বা সফ্ট টিস্যুতে সারকোমা বাসা বাঁধলে তেমনটাই হয়ে থাকে। কিন্তু সঞ্জয়ের ক্ষেত্রে এটি যেহেতু পেনিসে হয়েছিল, তাই গোড়াতেই সমস্যা বুঝতে পেরে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন সঞ্জয় ও তাঁর পরিবার।
তথ্য বলছে, ১৯৮০ সাল থেকে ২০২১ পর্যন্ত এরকম সারকোমা মাত্র ৬টা হয়েছে বিশ্বে। সঞ্জয় মণ্ডলের এই কেসটি ছিল সাত নম্বর। সেটিও হয়তো ধরা পড়ত না, যদি না হিস্টোপ্যাথলজিস্ট ডক্টর নির্মাল্য বন্দ্যোপাধ্যায় (ডিএনবি, ডিএম) এই ডায়াগনসিসের ক্ষেত্রে অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দিতেন।
মাস দেড়েক হল, অস্ত্রোপচার হয়েছে সঞ্জয় মণ্ডলের। তিনি এখন ভাল আছেন। তাঁর পোস্ট অপারেটিভ চিকিৎসা চলছে। এমন একটি বিরলতম অসুখকে চিহ্নিত করতে পেরে এবং সফল চিকিৎসা করতে পেরে খুশি কলকাতার চিকিৎসক মহল। হিস্টোপ্যাথলজির ক্ষেত্রে এটি একটি বড় সাফল্য বলেই দেখা হচ্ছে এ দেশের চিকিৎসাক্ষেত্রে।
-সূত্র: দি ওয়াল