Home অন্যান্য ভ্যালেরি টেইলর বাংলাদেশের প্রেমে পড়ে কাটিয়ে দিলেন ৫০ বছর

ভ্যালেরি টেইলর বাংলাদেশের প্রেমে পড়ে কাটিয়ে দিলেন ৫০ বছর

ভ্যালেরি অ্যান টেইলর, সিআরপির প্রতিষ্ঠাতা

 

“বিমান থেকে নেমেই আমি চন্দ্রঘোনার দারুণ সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে যাই। একদিন নদীতে ঘন কুয়াশা ছিলো। আশেপাশে আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ একটি সাম্পান আমার চোখে পড়ে, মাঝি দাঁড় বাইছে, আর মনে হচ্ছে সাম্পানটি পানির দুই তিন ফুট উপরে ভেসে চলছে। কারণ চারপাশে কুয়াশার মধ্যে শুধু সাম্পানটি দেখা যাচ্ছিলো। সে দৃশ্য এখনো পরিস্কারভাবে আমার মনে ভাসে।”

১৯৬৯ সালে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) আসার পরের সময়ের কথা আমার কাছে এভাবেই বর্ণনা করছিলেন ৭৫ বছর বয়সী ভ্যালেরি অ্যান টেইলর।

পক্ষাঘাতগ্রস্থ কিংবা নানা আঘাতপ্রাপ্ত মানুষজন যারা ঢাকার কাছে সিআরপি নামের দাতব্য প্রতিষ্ঠানটিতে পুনর্বাসনের জন্য যান, তাদের অনেকের কাছেই পরিচিত এবং প্রিয়মুখ মিজ টেইলর।

তার নিজের হাতে গড়া সেই সিআরপি প্রতিষ্ঠার ৪০ বছর হয়ে গেল। আর মিজ টেইলরের বাংলাদেশে আগমনের হলো আধা শতাব্দী। অথচ তিনি মোটে ১৫ মাসের জন্য স্রেফ অভিজ্ঞতা আহরণে এসেছিলেন চট্টগ্রামের চন্দ্রঘোনায়।

১৯৬৭ সাল, লন্ডনের সেন্ট টমাস হাসপাতাল থেকে ফিজিওথেরাপির উপর পড়াশোনা করে সদ্য পাশ করেছেন মিজ টেইলর। ইচ্ছা মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার।

ব্রিটিশ সরকারের ভলান্টারি সার্ভিস ওভারসিজে ( ভিএসও) আবেদনও করে ফেলেন তিনি। কিন্তু ন্যুনতম দুই বছরের কাজের অভিজ্ঞতা না থাকলে কাউকে ভিএসও-তে নেওয়া হয় না।

সুতরাং তিনি আবার ফিরে যান সেন্ট থমাসে দুই বছরের কাজের অভিজ্ঞতা নিতে। এরই মাঝে চেন্নাইয়ের ক্রিশ্চান মেডিকেল কলেজের (সিএমসি) দুই ডাক্তারের কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে বই পড়ে ফেলেন তিনি, এবং সিদ্ধান্ত নেন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করলে দক্ষিণ এশিয়াতেই করবেন।

আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকায় কাজের সুযোগ থাকলেও অটল থাকেন ভারতীয় উ মহাদেশের কোথাও কাজ করবেন।

১৯৬৯ সালের মাঝামাঝি সুযোগ এসে যায়, চন্দ্রঘোনার খ্রিস্টান হাসপাতালের জন্য একজন ফিজিওথেরাপিস্টের দরকার হলে ডাক পড়ে মিজ টেইলরের।

তবে শর্ত ছিল কমপক্ষে ১৫ মাস অথবা দুই বছর চন্দ্রঘোনায় কাজ করতে হবে।

“আমি ভাবছিলাম- মনে হয় পূর্ব পাকিস্তান আমার ভালো লাগবে না। ভাবলাম যখন আমি ১৫ মাসের জন্য যেতে পারবো তাহলে কেন দুই বছরের জন্য চুক্তি করবো? সুতরাং আমি ১৫ মাসের জন্যই চুক্তি করেছিলাম। ৫০ বছর পর এসে এখন মনে হচ্ছে আমি মনে হয় পরিকল্পনায় খুব একটা ভালো না।”

আসলে বাংলাদেশের প্রেমে পড়ে ৫০ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি। এত বছর পরে এসেও তিনি প্রথমদিন বাংলাদেশে আসার মুহুর্তটি মনে করতে পারেন।

 

চন্দ্রঘোনার সৌন্দর্য অবাক করলেও মিজ টেইলর কষ্ট পেতে থাকেন, যখন দেখেন ওই হাসপাতালে একটি হুইলচেয়ারও নেই। অথচ তাকে পঙ্গুদেরই চিকিৎসা করতে হয়। ভ্যালেরি বড় হয়েছেন ইংল্যান্ডের আলসবেরিতে, যেখানে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ইনজুরি সেন্টারটি অবস্থিত।

“ছোটবেলায় আমি আমি দেখেছি, লোকজন ওখানকার স্পোর্টস সেন্টারে খেলাধুলা করছে। হুইলচেয়ারে করে আশপাশের দোকানে লোকজন ঘুরছে। কিন্তু চন্দ্রঘোনায় আমি কোন হুইলচেয়ার দেখিনি। ওখানে কোন কারিগরি শিক্ষা ছিলো না। সেখানে কোন অকুপেশনাল থেরাপির ব্যবস্থা ছিলো না। সুতরাং আমি বুঝতে পেরেছি কী পরিমাণ পিছিয়ে আছে এখানে।”

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার কারণে তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে বাধ্য হন।

একই বছর সেপ্টেম্বর মাসে তিনি পুনরায় বাংলাদেশে ফিরে আসেন। তখনো যুদ্ধ শেষ হতে দুই মাস বাকি।

এ সময় তাঁর কাজ আরো বেড়ে যায়। কারণ, যুদ্ধের কারণে পঙ্গুত্বের হার বেড়ে গিয়েছিল কয়েকগুণ। তিনি সফলভাবেই সেই কাজ করতে সমর্থ হন।

বাংলাদেশে একটি সার্থক পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য উপযুক্ত অর্থ ও অন্যান্য সাহায্যের ব্যবস্থা করার উদ্দেশে ১৯৭৩ সালে তিনি আবার ইংল্যান্ডে ফিরে যান। ১৯৭৫ সালে তিনি পুনরায় বাংলাদেশে ফিরে আসেন।

এইসময় তিনি ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৯ সালে এই হাসপাতালের দুটি পরিত্যক্ত গুদামঘরে ৩-৪জন রোগী নিয়ে শুরু করেন সিআরপি।

“আমরা একটা বাস্কেটবল কোর্টের জন্য কিছু টাকা তুলতে পেরেছিলাম। যখন প্রতিবন্ধি লোকজন বাস্কেটবল খেলতো, উল্লাস করতো তখন লোকজন থেমে উঁকি দিয়ে দেখতো। আমরা যেটা চেয়েছি, লোকজন দুর্ঘটনার আগে যেভাবে স্বাভাবিক কাজকর্ম করতো হুইলচেয়ারে বসেও যেন তারা সেটি চালিয়ে যেতে পারে এবং মানুষও যেন তাতে অভ্যস্ত হয়। আমার মনে হয় এটাই সবচেয়ে বড় বিষয় যে এখন সবার মানসিকতা পাল্টেছে।”

১৯৯০ সালে ঢাকার কাছে সাভারে ৫ একর জায়গা কিনে সিআরপির স্থায়ী ঠিকানা গড়ে তোলেন মিজ টেইলর। যেটি এখন ১০০ বেডের হাসপাতাল।

এই একশ জন স্পাইনাল ইনজুরি রোগীকে সেবা দেওয়া সম্ভব। এছাড়া দেশের ৫টি বিভাগে ১৩টি শাখা রয়েছে সিআরপির। যেখানে বছরে প্রায় ৮০,০০০ রোগী সেবা নিতে পারে।

এই প্রতিষ্ঠান চালাতে গিয়ে বাধাও পেতে হয়েছে, বলছিলেন মিজ টেইলর। নামে বেনামে তাঁর বিরুদ্ধে গোয়েন্দা সংস্থার কাছেও নালিশ করা হয়েছিলো বিভিন্ন সময়ে।

“আমি বুঝতে পেরেছি যে, বাংলাদেশের লোকজন যে কাজ করতে পছন্দ করে না অন্য কেউ যদি সে কাজ করে তবে তাকেও তারা পছন্দ করে না”।

“শিশু পাচারের মতো অভিযোগও আনা হয়েছে। আমাকে এনএসআই ডেকে নিয়ে গিয়েছিল, এক অফিসার আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো পড়ে শোনাচ্ছিলো। এবং জিজ্ঞেস করেছে আপনি কর্মচারীদের বাচ্চাদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করেন? এটা ছিলো আমার বিরুদ্ধে পাঁচ নাম্বার অভিযোগ”।

“আমার মনে পড়ে, তখন আমি কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম এবং বলেছিলাম, হ্যাঁ করি, প্রতি বুধবার! তখন এনএসআই অফিসার হেসে উঠে বলেছিলেন চিন্তা করবেন না, এসব অভিযোগের সবগুলো আমরা বিশ্বাস করি না।”

এতো কিছুর পরেও পঙ্গু মানুষদের সেবা চালিয়ে গেছেন মিজ টেইলর। তিনি বলছেন, “আসলে এটা কোন ব্যাপার না তোমার সাথে কী আচরণ করা হচ্ছে। আমার মা বলতেন, যত বাধা তুমি পাবে তত বেশি শক্ত হতে পারবে তুমি।”

বর্তমানে সিআরপিতে এক হাজারের বেশী কর্মী কাজ করছে। তাদের অনেকে এখানে চিকিৎসা নিতে এসে পুনর্বাসিত হয়েছেন।

সিআরপির নিজস্ব উদ্ভাবনী প্রযুক্তিতে দেশীয় কাঁচামাল দিয়ে তৈরি হয় হয় হুইলচেয়ার।

“এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যখন কেউ গ্রামে ফিরে যাবে তখন হুইলচেয়ারটা নষ্ট হলে সেখানে কেউ যেন সেটা সারাতে পারে। এটির যন্ত্রাংশগুলোও স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য হতে হবে। এজন্য আমরা হুইলচেয়ারগুলোতে সাইকেল এবং রিকশার বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ব্যবহার করি।’

সিআরপির শুরু থেকে বাংলাদেশিদের ফিজিওথেরাপি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করে, বর্তমানে বছরে ৪০০ জনকে ডিপ্লোমা, অনার্স মাষ্টার্সসহ নানামেয়াদী প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

পঙ্গু মানুষদের পুনর্বাসনে অবদানের জন্য ২০০৪ সালে স্বাধীনতা পদক পান মিজ টেইলর। তার আগে ১৯৯৮ সালে তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়।

বিভিন্ন দেশের দাতাগোষ্ঠি ও সংস্থার অনুদানে পরিচালনা করা হয় সিআরপির কার্যক্রম।

মূলত যারা সিআরপিতে বিভিন্ন সময়ে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতে এসেছিলেন পরবর্তীতে তারাই এটিকে পরিচালনার জন্য অর্থের জোগান দিতে থাকেন।

ভ্যালেরি টেইলর চান প্রতিষ্ঠানটির সাথে সম্পৃক্তরা এটিকে এগিয়ে নিবেন। এজন্য চালু করেছেন নতুন স্লোগান, “আমরাই সিআরপি”

“আমার স্বপ্ন এটা- আমরা যেন এই বার্তাটি ছড়িয়ে দিতে পারি যে- এটা শুধুমাত্র ফিজিওথেরাপি বা ভালো সার্জারি বা নার্সিং কেয়ার করা না। আমরা আমাদের এসব রোগীদের সম্মান দিচ্ছি কি না? আমরা কি যেখানে আছি সেখানেই থেমে থাকবো নাকি আরো অগ্রসর হবো? এসব মূল্যবোধের কারণে যে কেউ যেন বলে এই জায়গাটি অন্যদের তুলনায় ভিন্ন”।

“আমার মনেহয় ৪০ বছর, এটা দারুণ সময় নিজেকে এখান থেকে সরিয়ে নেওয়ার। এবং যারা বলে আমিই সিআরপি, তারা এটির মূল্যবোধকে সামনে এগিয়ে নিবে”।