বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সক্রিয় বিপ্লবীদের মধ্যে এক স্মরণীয় নাম যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত । একাধারে আইনজীবি, রাজনীতিবিদ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে পাঁচবার কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধীকে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করেন তিনি। বার্মা অয়েল কোম্পানির ধর্মঘটের সময় ধর্মঘটীদের চল্লিশ হাজার টাকা করে সাহায্য করায় ‘দেশপ্রিয়’ উপাধিতে ভূষিত হন যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত। আজীবন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে জড়িত যতীন্দ্রমোহন চট্টগ্রামের মানুষদের কাছে ছিলেন চট্টগ্রামের ‘মুকুটহীন রাজা’।
১৮৮৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি চট্রগ্রামের বরমা গ্রামে যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের জন্ম হয়। তাঁর বাবা যাত্রামোহন সেনগুপ্ত একজন প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী হওয়ার সুবাদে ‘বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল’ (Bengal Legislative Council)-এর সদস্য ছিলেন। এছাড়াও জাতীয় কংগ্রেসের অবিসংবাদি নেতা হিসেবে তাঁর পরিচিতি ছিল। যতীন্দ্রমোহনের মায়ের নাম বিনোদিনী দেবী। যতীন্দ্রমোহনের ছোটবেলা কেটেছে চট্টগ্রামে। শৈশব থেকেই তিনি সুস্বাস্থ্য ও বুদ্ধিমত্তার অধিকারী ছিলেন।
মাত্র নয় বছর বয়সে চট্টগ্রামের ‘হাজারী স্কুল’-এ যতীন্দ্রমোহনের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। এর দুই বছর পরে তিনি ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে। এরপর তাঁর বাবা তাঁকে উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতার ‘সাউথ সুবার্বন স্কুল’-এ ভর্তি করে দেন। ১৯০২ সালে হেয়ার স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করে যতীন্দ্রমোহন প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। প্রেসিডেন্সিতে তাঁর সহপাঠী ছিলেন ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ, দেবীপ্রসাদ খৈতান প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তি। এঁদের সাহচর্যে যতীন্দ্রমোহন উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে ওঠেন। উচ্চশিক্ষার জন্য ১৯০৪ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাউনিং কলেজে ভর্তি হন তিনি। ১৯০৮ সালে ডাউনিং কলেজ থেকে স্নাতক উত্তীর্ণ হন এবং ঠিক এর পরের বছর ১৯০৯ সালে আইন বিষয়ে ডিগ্রি লাভ করেন যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত । ইংল্যান্ডে খেলাধূলা আর নানাবিধ সামাজিক কাজকর্মে তিনি যুক্ত থাকতেন। নৌকা চালানো, টেনিস, ক্রিকেট ইত্যাদি খেলায় অসাধারণ প্রতিনিধিত্বের জন্য এবং তাঁর প্রগাঢ় বুদ্ধি ও অসামান্য ব্যক্তিত্বের জন্য তিনি ইংল্যাণ্ডের ‘ইণ্ডিয়ান মজলিশ’ এবং ‘ইস্ট আ্যণ্ড ওয়েস্ট সোসাইটি’র সভাপতি নির্বাচিত হন। এখানে তিনি বন্ধু হিসেবে পান গুরুসদয় দত্তকে যিনি পরবর্তীতে বাংলায় ব্রতচারী শিক্ষার প্রবর্তন করেন। ১৯০৭ সালে কেমব্রিজে যতীন্দ্রমোহনের আলাপ হয় জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ঢেউ তখন সুদূর ইংল্যাণ্ডকেও স্পর্শ করেছিল। যতীন্দ্রমোহন এবং জওহরলাল ইংল্যাণ্ডে থাকাকালীনই স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ইংল্যাণ্ডে থাকাকালীনই তাঁর পরিচয় হয় নেলি গ্রে’র সঙ্গে এবং পরিবারের আপত্তি সত্ত্বেও ১৯০৯ সালের ১ আগস্ট বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন তাঁরা। পরবর্তীতে যতীন্দ্রমোহনের বিদেশিনী স্ত্রী নেলি সেনগুপ্তা পরিচয়ে ভারতীয় রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
দেশে ফিরে এসে, ১৯০৯ সালে চট্টগ্রাম জেলা আদালতে আইনজীবি হিসেবে যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত কর্মজীবন শুরু করেন। এর পরের বছর অর্থাৎ ১৯১০ সালে তিনি কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবি হিসেবে নিযুক্ত হন। এই সময়ে তিনি বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীকে নিশ্চিত শাস্তি থেকে মুক্ত করে আনেন। আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলায় তিনি পুলিশের সমস্ত সাক্ষীকে মিথ্যা প্রমাণ করে সাতজন অভিযুক্তকে কারাবাস থেকে মুক্ত করেন। দক্ষ আইনজীবি হিসেবে এটি ছিল তাঁর অন্যতম সাফল্য। কিন্তু আইনজীবি হিসেবে প্রথমদিকে তাঁর উপার্জন কম হওয়ায় তিনি সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত ‘রিপন কলেজ’-এ অধ্যাপনা শুরু করেন। রিপন কলেজে তিনি স্বয়ং সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কেই সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলেন।
যতীন্দ্রমোহন আইনজীবি হিসেবে অসাধারণ বাগ্মী ছিলেন। সাক্ষীকে জেরা করে অনায়াসে মামলার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারতেন তিনি। ফৌজদারী মামলায় তাঁর সমকক্ষ আইনজ্ঞ ভারতে তখন কমই ছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি তাঁর ছিল প্রগাঢ় শ্রদ্ধা আর সেই শ্রদ্ধা থেকেই তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের যে কোনো মামলা সম্পূর্ণ বিনা পয়সায় লড়তেন। নাগরখানা খন্ডযুদ্ধে ও সরকারি টাকা লুটের মামলায় মাস্টারদা সূর্য সেন, অনন্ত সিংহ, অম্বিকা চক্রবর্তীদের খালাস করে এনেছিলেন যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত। ইন্সপেক্টর প্রফুল্ল রায় হত্যা মামলায় তিনি বিপ্লবী প্রেমানন্দ দত্তকে বেকসুর খালাস প্রমাণ করেন।
রাজনীতির জগতে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের প্রেরণায় তাঁর কর্মজীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হয়। ১৯১১ সালে কংগ্রেসের ডাকে সাড়া দিয়ে প্রথম সারির স্বেচ্ছাসেবক হয়ে তিনি কারাবরণ করেছিলেন। স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে তিনি চট্টগ্রামে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকে সংঘবদ্ধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। যতীন্দ্রমোহনের ভূমিকা নিয়ে গান্ধীজিও ভূয়সী প্রশংসা করেছেন তাঁর ‘ইয়ং ইণ্ডিয়া’ পত্রিকায়। ১৯১৮ সালের ১৮ জুন চিত্তরঞ্জন দাশ চট্টগ্রামে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন এবং এই ঐতিহাসিক ভাষণে উবুদ্ধ চট্টগ্রামবাসীদের একত্রিত করে যতীন্দ্রমোহনের সভাপতিত্বে চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেস একটি কমিটি তৈরি করে। চট্টগ্রামে যুব বিদ্রোহের পাশাপাশি বিভিন্ন আন্দোলনকে পরিচালনা ও আইনের সাহায্য নিয়ে দেশনেতাদের মুক্ত করে যতীন্দ্রমোহন তাঁর দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছেন বারংবার। জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সারা দেশব্যাপী শুরু হয় মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন। ১৯২১ সালে আন্দোলন তীব্রতর হলে যতীন্দ্রমোহন ওকালতি ছেড়ে সরাসরি এই আন্দোলনে যুক্ত হন। এই বছরেই বার্মা অয়েল কোম্পানির মজদুরদের মধ্যে বেতন বৃদ্ধি ও কর্মব্যবস্হার উন্নতির দাবিতে অসন্তোষ বাড়তে থাকলে যতীন্দ্রমোহন এই আন্দোলনে মজুরদের সপক্ষে দাঁড়িয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমঝোতা করেন। ১৯২১ সালে আসামের চা বাগানের কুলিদের উপর অমানুষিক নির্যাতন ও নিপীড়নের প্রতিবাদে ‘আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে ধর্মঘট’-এর ডাক দেন কুলিরা যার নেতৃত্বে ছিলেন যতীন্দ্রমোহন। মহাত্মা গান্ধীকে তিনি আমন্ত্রণ জানান চট্টগ্রামে এসে এই ধর্মঘটকে কংগ্রেসের জাতীয় কর্মসূচির অন্তর্গত করার জন্য। যতীন্দ্রমোহনের ডাকে মহাত্মা গান্ধী চট্টগ্রামে এসে ধর্মঘটীদের ধৈর্য্যের ও যতীন্দ্রমোহনের সুসংগঠিত নেতৃত্বের প্রশংসা করেন এবং ‘আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে ধর্মঘট’কে কংগ্রেসের জাতীয় কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করেন। এই আন্দোলন কংগ্রেসের অহিংসবাদী আন্দোলনের শক্তি বৃদ্ধি করেছে বলেও মহাত্মা গান্ধী পরবর্তীতে জানান। এই ধর্মঘট পরিচালনা করার জন্য যতীন্দ্রমোহন নিজের ভিটেমাটি বন্ধক রাখেন। বহুবার এই আন্দোলন পরিচালনা করার জন্য ইংরেজ সরকার তাঁকে সস্ত্রীক গ্রেফতার করেছে।
১৯২২ সালে যতীন্দ্রমোহন কংগ্রেসের কার্যকরী সমিতির সদস্য হন। ১৯২৩ সালের ১ জানুয়ারি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ‘স্বরাজ’ দল প্রতিষ্ঠা করলে যতীন্দ্রমোহন তাতে যোগ দেন। চিত্তরঞ্জন দাশের সুযোগ্য শিষ্য যতীন্দ্রমোহন চিত্তরঞ্জনের আর্দশ ও প্রদর্শিত পথেই সারাজীবন চলেছেন। তিনি বাংলার সশস্ত্র আন্দোলনকেও গভীরভাবে সমর্থন করতেন। চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর বাংলা প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সভাপতির দায়িত্ব, ‘ফরওয়ার্ড’ পত্রিকার দায়িত্বভার এবং সর্বোপরি কলকাতার মেয়রের দায়িত্বও কাঁধে তুলে নেন যতীন্দ্রমোহন। মেয়র নির্বাচিত হয়ে তিনি মেয়েদের জন্য অনেকগুলি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্হাপন সহ চিকিৎসা, স্বাস্থ্য, জল সরবরাহ ও শৌচপ্রণালী ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি করেন। মোট পাঁচবার কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন যতীন্দ্রমোহন। মেয়র থাকাকালীন ১৯২৬ সালে কলকাতার নৃশংস হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা তিনি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করেন। ১৯২৮ সালে কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনের অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন যতীন্দ্রমোহন। ১৯৩১ সালে চট্টগ্রামের ভয়াবহ বন্যায় ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ত্রাণকার্যের দায়িত্ব নেন তিনি।
১৯৩০ সালে রেঙ্গুনে ভারত থেকে বার্মাকে পৃথক করার প্রতিবাদে অনুষ্ঠিত কর্মসূচিতে রাজদ্রোহী বক্তৃতা দেওয়ায় পুনরায় গ্রেফতার হন তিনি। পরে মুক্তি পেয়ে ইংল্যাণ্ডে গিয়ে চট্টগ্রাম পুলিশের বিরুদ্ধে ছবি ও তথ্য-প্রমাণ পেশ করলে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার নেলসন পদচ্যুত হন। এরই ফলস্বরূপ জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট ক্রেগ অবসর নিতে বাধ্য হন এবং হান্টার সাহেব চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিলেতে চলে যান। এরপর অদ্ভুতভাবে পুলিশ সুপার সুট্যার আত্মহত্যা করলে যতীন্দ্রমোহনের বিরুদ্ধে পুলিশের ক্ষোভ জমা হয়। কমিশনার টেগার্ট ইংরেজ সরকারকে জানান যতীন্দ্রমোহন সশস্ত্র বিপ্লবের সঙ্গে যুক্ত। টেগার্টের এই অভিযোগের ভিত্তিতে ১৯৩৩ সালে যতীন্দ্রমোহন দেশে ফেরার পরে বোম্বাই বন্দরে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পরে তাঁকে প্রথমে যারবেদা জেলে রাখা হয় এবং সেখান থেকে দার্জিলিংয়ে পাঠানো হয়। দার্জিলিংয়ে থাকাকালীন তিনি গুরুতর অসুস্হ হয়ে পড়লে তাঁকে উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে দেওয়া হয়নি। অবস্থার আরও অবনতি হলে তাঁকে চিকিৎসার জন্য রাঁচি পাঠানো হলেও তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি ক্রমশ হতেই থাকে।
যতীন্দ্রমোহন নিজে ‘অ্যাডভান্স’ নামে একটি ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। দেশের কাজে নিজের সারাজীবন উৎসর্গ করেছিলেন তিনি। বার্মা অয়েল কোম্পানিতে শ্রমিকদের ধর্মঘটের সময় তিনি ধর্মঘটীদের পরিবার প্রতিপালনের জন্য চল্লিশ হাজার টাকা ধার করেন। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই যতীন্দ্রমোহনকে ‘দেশপ্রিয়’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়, চট্টগ্রামের মানুষ তাঁকে ‘মুকুটহীন রাজা’ নামে অভিহিত করেন। তাঁর স্মৃতিতে দক্ষিণ কলকাতার একটি পার্ক নামাঙ্কিত রয়েছে ‘দেশপ্রিয় পার্ক’ নামে। পার্কের ভেতরে যে যুগলমূর্তিটি রয়েছে তা যতীন্দ্রমোহন ও নেলী সেনগুপ্তের। যতীন্দ্রমোহনের স্মরণে রাঁচীতে কাঁকে রোডের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন রোড’।