ঢাকা চেম্বার আয়োজিত ওয়েবিনারে অভিমত
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘বেসরকারীখাতের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ প্রেক্ষিত’ শীর্ষক ওয়েবিনার ৭ আগস্ট অনুষ্ঠিত হয়। পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান প্রধান অতিথি এবং ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ব্যাংক-এর সাবেক গভর্নর প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন সম্মানিত অতিথি হিসেবে ওয়েবিনারে অংশগ্রহণ করেন।
ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ডিসিসিআই সভাপতি রিজওয়ান রাহমান, যেখানে অর্থনীতিতে কোভিড-১৯’র প্রভাব, এলডিসি উত্তর সময়ে আমাদের অর্থনীতির পর্যালোচনা, মুদ্রানীতি, মাইক্রো অর্থনীতি, কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াকরণ সহ শিল্প এবং সার্ভিস খাত প্রভৃতির উপর বিস্তারিত আলোকপাত করেন। তিনি বলেন, কোভিড-১৯ মহামারীর নানাবিধ চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতি গত ৬ মাসে মোটামুটি সঠিক পথেই পরিচালিত হচ্ছে এবং ২০২৬ ও ২০৪১ সালের প্রাক্কলিত লক্ষমাত্রা অর্জনে আমাদের সরকারী ও বেসারকারীখাতকে একযোগে কাজ করতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন, মাহামারীর কারণে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রার ৩৭৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হতে ৩৬৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে, দারিদ্রের হার ৯% বৃদ্ধি পেয়ে ২৯.৫% উন্নীত হয়েছে এবং ইতোমধ্যে প্রায় ২.২৬ মিলিয়ন জনগন কর্মসংস্থানের সুযোগ হারিয়েছেন। ঢাকা চেম্বারের সভাপতি বলেন, ২০২৬ সালে স্বল্পন্নোত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের আমাদের রপ্তানি প্রায় ৪-৬ বিলিয়ন কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, এমতাবস্থায় অর্থনৈতিক পুনঃরুদ্ধারের বিষয়টিকে আমাদের সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। রিজওয়ান রাহমান জানান, জিডিপিতে করের অবদান বাড়ানোর পাশাপাশি করের হার বৃদ্ধি করতে হলে, দেশের শুল্ক ও ভ্যাট আহরণ ব্যবস্থার সম্পূর্ণ অটোমেশন খুবই জরুরী। ডিসিসিআই সভাপতি মনে করেন, দেশে বেসরকারী বিনিয়োগ বাড়াতে প্রতিযোগিতার সক্ষমতার সূচকে উন্নয়ন, স্থানীয় বেকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পের উন্নতি, বাণিজ্য বিরোধ নিষ্পত্তিতে এডিআর ব্যবস্থার ব্যবহার বাড়ানো এবং পুঁজিবাজারে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ নিশ্চিতকরণ একান্ত অপরিহার্য। সেই সাথে রপ্তানির বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কীম ও রপ্তানি উন্নয়ন ফান্ড’র যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স প্রক্রিয়ার সহজীকরণ, বাংলাদেশের বাণিজ্য সহযোগি দেশগুলোর সাথে দ্রুততার সহিত পিটিএ ও এফটিএ স্বাক্ষরের উপর জোরারোপ করেন ঢাকা চেম্বারের সভাপতি। তিনি আরোও বলেন, করোনা মহামারীর কারণে আমাদের সিএমএসএমই খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এখাতের উদ্যোক্তাদের টিকে থাকার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা সহায়তা পাওয়া নিশ্চিতকরণ, সহায়ক নীতি সহায়তা প্রদান, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন এবং ঋণ প্রদানের সময়সীমা অন্তত ৩ বছর নির্ধারনের প্রস্তাব করেন তিনি। একই সাথে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এখাতের উদ্যোক্তাদের ঋণ আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্নের আহ্বান জানান। দেশের মানুষকে আরো উন্নত স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে সরকারকে আরো বেশি হারে বিনিয়োগ করার পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাত সম্পর্কিত গবেষণা ও উন্নয়ন, বায়োটেকনোলজি ও মহামারী নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি খাতে আরো বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করেন ঢাকা চেম্বারের সভাপতি।
প্রধান অতিথি’র বক্তব্যে পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দারিদ্র বিমোচন এবং প্রবৃদ্ধি’র লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকার ও বেসরকারীখাত একযোগে নিরলসভাবে কাজ করছে। অর্থনীতিতে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকরণ একান্ত অপরিহার্য বলে, মত প্রকাশ করেন তিনি। তিনি জানান, বর্তমান সরকার অর্থনীতির পাশাপাশি সমাজের সকল স্তরের জনগনের সার্বিক উন্নয়নের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করছে। পরিকল্পনা মন্ত্রী বলেন, কর ও শুল্কসহ অন্যান্য নীতিতে সংষ্কার ও যুগোপযোগীকরণে ক্ষেত্রে দেশের বেসরকারীখাতের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে সরকার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
সম্মানিত অতিথি’র বক্তব্যে প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, বিবিএস’র তথ্য মতে, করোনা মহামারীর কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩.৫১%, তবে ২০২১ সালে যা ৫.৪৭% এসে দাঁড়িয়েছে। তিনি জিডিপিতে করের অবদান বাড়ানোর উপর জোরারোপ করেন এবং বিশেষকরে জিডিপিতে করের অবদান বৃদ্ধি এবং পণ্য রপ্তানি সম্প্রসারণে বাংলাদেশ যথাক্রমে নেপাল ও ভিয়েতনামকে অনুসরণ করে, সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংষ্কার দ্রুততম সময়ে সম্পন্ন করার আহ্বান জানান। এছাড়াও তিনি ক্ষুদ্র এবং মাঝারী উদ্যোক্তাদের জন্য আর্থিক সহায়তা নিশ্চিতকল্পে কার্যকর উদোগ গ্রহণের পরামর্শ প্রদান করেন। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষনে বাই বেক সিস্টেম প্রবর্তন, কৃষিখাত এবং স্থানীয় বাজারের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রস্তাব করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এ গভর্নর।
এছাড়াও বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)’র মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন, পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট (পিআরআই)’র চেয়ারম্যান ড. জায়েদী সাত্তার, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অফ বিজনেস এ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ)’র পরিচালক প্রফেসর মোহাম্মদ আব্দুল মোমেন এবং ইউএনডিপি বাংলাদেশ-এর প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ প্রমুখ ওয়েবিনারের নির্ধারিত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন।
পিআরআই’র চেয়ারম্যান ড. জায়েদী সাত্তার বলেন, সরকার ও বেসরকারীখাতের সমন্বয়ের ফলেই আমাদের অর্থনীতি আজকে এ পর্যায়ে এসেছে পৌঁছেছে। তবে বিনিয়োগকারী ও উৎপাদনকারীদের স্বার্থ বিবেচনার পাশাপাশি ভোক্তাদের বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি, যা অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত হয়ে থাকে। তিনি বলেন, টেকসই সামষ্টিক অর্থনীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যার ফলে করোনা মহামারী সত্বেও আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েনি, যদিও কিছুটা স্থবিরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। পণ্য রপ্তানি বাড়াতে পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং সম্ভাবনাময় দেশগুলোর সাথে এফটিএ, পিটিএ আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তিসহ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের উপর জোরারোপের আহ্বান জানান। তৈরি পোষাক ছাড়াও অন্যান্য রপ্তানিমুখী পণের ক্ষেত্রেও তৈরি পোষাকের ন্যায় নীতি-সহায়তার পাশাপাশি প্রণোদনার উপর তিনি জোরারোপ করেন। তিনি, দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭-৯% উন্নীত করার লক্ষ্যে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষন ও বৈশি^ক বাণিজ্য সম্প্রসারণের উপর গুরুত্বারোপের আহ্বান জানান।
বিআইডিএস’র মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন বলেন, দারিদ্র বিমোচন সহ অর্থনীতির অন্যান্য খাতে হালনাগাদ তথ্যের অপার্যপ্ততার কারণে নীতিমালা প্রণয়নে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে এবং তা নিরসনে তিনি অর্থনীতির সকল স্তরের সমন্বিত তথ্য প্রাপ্তির উপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি উল্লেখ করেন, করোনা মাহামারী মোকাবেলায় লকডাউন আরোপের ফলে সমাজের অনেক মানুষ নতুনভাবে দারিদ্র সীমার নীচে চলে আসতে পারে, তা মোকাবেলায় আমাদের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এছাড়াও প্রণোদনা প্যাকেজ প্রদানের ক্ষেত্রে বিশেষকরে কুটির ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের নিকট কি করে পৌঁছানো যায় তার প্রতি আরো যতœবান হওয়ার আহ্বান জানান। বিনায়ক সেন বলেন, কৃষিখাত, উৎপাদনখাত এবং সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ বিগত বছরগুলোতে উন্নীত করেছে, তবে এলডিসি পরবর্তী সময়ের জন্য দেশের কর ও শুল্ক ব্যবস্থাপনায় আধুনিকায়ন, সংষ্কার, জিডিপিতে করের আনুপাতিক অবদান বৃদ্ধি এবং ব্যাংক খাতের খেলাপী ঋণ হ্রাসকরণ প্রভৃতি বিষয়সমূহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আইবিএ’র পরিচালক প্রফেসর মোহাম্মদ আব্দুল মোমেন বলেন, এলডিসি হতে বাংলাদেশের উত্তোরণ আমাদের রপ্তানির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ, তবে অতীতে অন্যান্য দেশগুলো বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো, রপ্তানি বহুমুখীকরণ এবং এফটিএ ও অন্যান্য বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে তা মোকাবেলা করেছে, তবে এজন্য সরকারকে এখনই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তিনি বলেন, বিদেশি ব্রান্ডগুলোর জন্য তৈরি পোষাক পণ্য উৎপাদন করলেও, নিজস্ব ব্রান্ড ও ব্রান্ডিং কার্যক্রমের অভাবে বিশেষকরে এখাতে কাঙ্খিত মাত্রায় অগ্রগতি ও ইমেজ বৃদ্ধি করা যায়নি এবং এক্ষেত্রে নিজস্ব ব্রান্ডিং সম্প্রসারণে মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানান। একই সাথে দেশি-বিদেশি বিশ^বিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে সহযোগিতা বাড়ানো এবং জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ গঠনের উপর জোরারোপ করেন।
ইউএনডিপি বাংলাদেশের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, কোভিড মহামারী পুনরুদ্ধার এবং এলডিসি গ্রাজুয়েশন মোকাবেলায় আগামী ৫ বছর আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এজন্য নীতিমালা প্রণয়নের পাশাপাশি আমাদেরকে সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। তারল্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারী উদ্যোক্তাদের বেশি প্রাধান্য দেওয়ার পাশাপাশি নারী উদ্যোক্তাদের আরো অধিক হারে ঋণ সহায়তা প্রাপ্তির বিষয়ে নজর দিতে হবে বলে, তিনি মত প্রকাশ করেন। নাজনীন আরো বলেন, দেশের ই-কমার্স প্লাটফর্ম ব্যবহারকারীদের মধ্যে অধিক মাত্রায় বৈষম্য রয়েছে এবং এখাতে গ্রামীণ পর্যায়ের জনগন ও উদ্যোক্তাদেরকে সাথে সম্পৃক্ততা বাড়ানো একান্ত আবশ্যক। তিনি উল্লেখ করেন, এলডিসি উত্তর সময়ের জন্য নেগোশিয়েশন সক্ষমতা বাড়ানো খুবই জরুরী, সেই সাথে গ্রীণ ইনভেস্টমেন্ট এবং গ্রীণ ইনিশিয়েটিভের উপর প্রধান্য দেওয়ার জন্য সরকারী ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রতি আহ্বান জানান।
ডিসিসিআই এর উর্ধ্বতন সহ-সভাপতি এন কে এ মবিন অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। এসময় ডিসিসিআই সহ-সভাপতি মনোয়ার হোসেন, পরিচালনা পর্ষদের সদস্যবৃন্দ এবং প্রাক্তন সভাপতি রাশেদ মাকসুদ খান উক্ত ওয়েবিনারে যোগদান করেন।