শফিকুল ইসলাম শামীম, রাজবাড়ী: দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস। তবে ভাল ছাত্রী। দরিদ্রতার কারণে ভাল ছাত্রী হওয়ার পরও বাল্যবিয়ের শিকার। নবম শ্রেণীতে পড়ালেখাকালীন বিয়ে হয়। অভাবী বাবা-মা গ্রামের একটি বখাটে ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেয়। বিয়ের কারণে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু যৌতুক লোভী ও মাদকসেবী স্বামী শাহেদ আলীর সঙ্গে সংসার বেশি দিন করা হয়নি। বছর না ঘুরতে সংসার ভেঙ্গে যায়। অনেক চেষ্টা করেও সংসার টিকাতে পারিনি। এই যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে বাবা হার্ড স্ট্রোকে অকালে মারা যায়।
রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ উপজেলার দেবগ্রাম ইউনিয়ন এলাকায় মৃত তোফাজ্জেল হোসেন মোল্লার মেয়ে রাহেলা। বাবা-মায়ের চার সন্তানের মধ্যে রাহেলাই বড়। সেই হিসেবে অকালে পুরো সংসারের ভার পড়ে রাহেলার ঘারে। অকালে সংসার হারা রাহেলা সেদিন ভেঙ্গে পড়েনি। শোক শক্তিতে রূপান্তর করে ঘুরে দাঁড়ায় রাহেলা। পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার জন্য উন্মুক্ত স্কুলে ভর্তি হয়।
আবারও উন্মুক্ত কলেজে ডিগ্রীতে ভর্তি হয়ে কাজ চালিয়ে যায়। শত প্রতিকূলতার মাঝেও ডিগ্রী পাস করেন। ডিগ্রী পাস করে চাকরির পেছনে রাহেলা ঘোরেনি। রাহেলা বলেন, চাকরির জন্য মানুষের পেছনে সময় কাটানোর চেয়ে কর্ম করে জীবনযাপন করা অনেক ভাল। তাই আমি চাকরির জন্য এক দিনও সময় ব্যয় করিনি। সরকারীভাবে কম্পিউটারের কাজ শিখে উদ্যোক্তা হয়ে কর্মজীবন শুরু করি। ২০১৪ সালের প্রথম থেকে রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ উপজেলার দেবগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদে কর্মজীবন। প্রথমে এই পেশায় কোন আয় ছিল না। যারা সেবা নেবে তারা বুঝতে পারত না।
গ্রামের সাধারণ মানুষের ডিজিটাল সেবা সম্পর্কে ধারণা ছিল না। তবে দিন দিন গ্রামের এই সাধারণ মানুষ ডিজিটাল সেবা সম্পর্কে বুঝতে পারছেন। আমাদের আয়ও ভাল হচ্ছে। বর্তমানে মাসে গড়ে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা আয় করতে পারি। এখন আর সংসারে অভাব অনাটন নেই। তিন বেলা বোনদের নিয়ে ভাল খেতে পারি। ভাল চলতে পারি।
অন্য এক নারী উদ্যোক্তা মুক্তা আক্তার (৩৫) সঙ্গে কথা হয়। মুক্তা আক্তার জানান, বাবা আমিনুল ইসলাম আমিন একজন দিনমজুর। মাসিক আয় মাত্র ৬ হাজার টাকা। এই আয়ের ওপর পরিবারের সকল প্রকার ব্যয়। যে কারণে কতদিন যে অনাহারে থাকতে হয়েছে বলে শেষ করতে পারব না। এরই মধ্যে পদ্মা নদীর ভাঙ্গন। পদ্মা নদীর ভাঙ্গনে বসতবাড়িসহ আবাদী জমি ভেঙ্গে যায়। আশ্রয়ের মতো কোন জায়গা না পেয়ে রাজবাড়ী জেলা গোয়ালন্দ উপজেলা দৌলতদিয়া রেল স্টেশনের পাশে বসবাস শুরু করি।
বিয়ের উপযুক্ত ৪ মেয়ে নিয়ে বাবা-মা দুশ্চিন্তা করতে থাকেন। দুই বছর রেলের পাশে বসবাস করার পর এনজিও থেকে টাকা নিয়ে এবং আমাদের ৪ বোনের প্রাইভেট পড়ানো টাকা দিয়ে অন্যের জায়গায় বাড়ি করে থাকেন আমার বাবা-মা। কিছুটা দুশ্চিন্তামুক্ত হয় বাবা-মা। অভাব অনটনের সংসারে আমরা পড়ালেখা বন্ধ করিনি।
৪ বোনের স্কুলের খরচ বাবা-মা বহন করতে পারতেন না। অভাবী সংসার হওয়ায় আমরা ৪ বোন প্রাইভেট পড়িয়ে সংসারে কিছু সহযোগিতা করতে থাকি এবং আমাদের সব প্রকার খরচ করতে থাকি। বাবার অনেক সহযোগিতা হতে লাগল। কিন্তু বাবা আমাদের নিয়ে অন্য চিন্তা করতে থাকেন। আমরা ৪ বোন বিয়ের উপযুক্ত। চেহারাও ভাল নয়। যে কারণে বিয়ের বাজারে আমাদের চাহিদা মন্দা। তবে এতে আমাদের মন খারাপ হয় না। কিন্তু বাবা-মা আমাদের নিয়ে দিন-রাত চিন্তা করতে থাকেন। আমরা বাবা-মায়ের চিন্তার কারণ বুঝি। আমরা ৪ বোন, বাবা মায়ের সান্ত¦না দেই। এভাবে চলতে থাকে আমাদের জীবনযাপন।
মুক্তা বলেন, দারিদ্র্যতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে পড়ালেখা শেষ করি। তবে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করার পরও চাকরির দেখা মেলেনি। যেখানে যাই শুধুই টাকা আর টাকা। একটি সময় চাকরির পেছনে ঘোরা বন্ধ করে দেই। কম্পিউটারের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে দৌলতদিয়া ইউনিয়নে উদ্যোক্তার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করি ২০১৩ সালে। কর্মজীবন শুরু করে প্রথমে হতাশ হয়েছিলাম। টানা এক বছর আয় রোজগার করতে পারিনি। এমন দিন গিয়েছে খালি হাতে বাড়ি গিয়েছি। তবে এখন গ্রামের সাধারণ মানুষও ডিজিটাল সেবা সম্পর্কে অনেক ধারণা নিয়েছে।
এখন প্রতিদিন ভাল আয় হয়। সংসারের অভাবও চলে গেছে। সুখের মুখ দেখতে পেরেছি। অভাবের সংসারের দুই বোন স্বামী-সংসারের ভাল আছেন। একজন গৃহিণী অন্যজন সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করেন। আয়ও ভাল করেন। তারা স্বামীর সংসারে খুব সুখে-শান্তিতে আছে। ছোট বোন আমার কাজের সহযোগিতা করে। সে নিজেও আয় করতে শিখেছে। অসুস্থ বাবার ওপর আর চলতে হয় না। বরং অসুস্থ বাবাকে সহযোগিতা করতে পারি। আমার বিয়ে হয়েছে। স্বামীও একজন উদ্যোক্তা। তিনিও সপ্তম শ্রেণীতে পড়ালেখাকালীন বাবাকে হারান।
সেই থেকে মুরগির হ্যাচারিতে এবং অন্যের বাড়িতে দিনমজুরের কাজ করে পড়াশোনা এবং সংসার চালাতে থাকেন। এখন আমরা স্বামী-স্ত্রী মিলে উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করি। দুজনে মিলে গড়ে মাসে ৩৫/৪০ হাজার টাকা আয় করি। এখন খুব ভাল আছি। অসুস্থ বাবা-মাকে সহযোগিতা করতে পারি। মুক্তা আরও বলেন, এই কর্ম না থাকেেলও চাকরির পেছনে ছুটতে হবে না। কারণ যে কোন জায়গায় ডিজিটাল সেবামূলক কাজ করে চলতে পারব। কারণ ডিজিটাল যুগে ডিজিটাল সেবার কোন বিকল্প নেই।