২০১০ সালের ধসের পর নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও দেশের পুঁজিবাজার কোনোভাবেই স্বাভাবিক হয়নি। উল্টো দিন যত যাচ্ছে পরিস্থিতি ততই খারাপের দিকে যাচ্ছে। মূল্যসূচক কমছেই। লেনদেন নেমে এসেছে তলানিতে। তিন বছর আগেও ডিএসইএক্স ৬০০০ পয়েন্ট অতিক্রম করেছিল। লেনদেন ছাড়িয়েছিল ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। সেই সূচক এখন ৪ হাজার ৬০০ পয়েন্টের ঘরে। লেনদেন নেমে এসেছে মাত্র ৪০০ কোটি টাকার ঘরে। অর্থাৎ গত এক বছরে সূচক কমেছে ১ হাজার ৩০০ পয়েন্ট। মূলত নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো থেকে নানা ধরনের প্রণোদনা দেয়ার পরও বাজার পরিস্থিতির উন্নয়ন হচ্ছে না। গত চার মাসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো বাজার মূলধন খুইয়েছে ৪৩ হাজার কোটি টাকা।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি বছরের ২৭ জুলাই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের মূলধনের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ কোটি টাকা। অব্যাহত দরপতনের কারণে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪৩ হাজার কোটি টাকার বাজার মূলধন কমে ৩ লাখ ৫২ হাজার কোটি টাকায় নেমেছে। সামগ্রিক বিবেচনায় দেখা গেছে, অধিকাংশ মৌলভিত্তি উপেক্ষা করে অতিমূল্যায়িত হয়ে এসব কোম্পানি বাজারে এসেছিল। কোম্পানিগুলো ইস্যু ম্যানেজারকেন্দ্রিক একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজারে আসে। বাজার থেকে বেশি টাকা নেয়ার জন্য শুরুতে প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করে। এরপর মূলধন বাড়িয়ে বাজার থেকে বেশি টাকা নেয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেয়া হয় মাত্রাতিরিক্ত প্রিমিয়াম। নিয়ম অনুসারে তালিকাভুক্তির পর প্লেসমেন্ট শেয়ারে এক বছরে লকইন (বিক্রি নিষিদ্ধ) দেয়া থাকে। এ সময়ের মধ্যে প্লেসমেন্টের শেয়ার বিক্রি করা যায় না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ইস্যু ম্যানেজার সাধারণত কিছু ব্রোকারেজের সঙ্গে চুক্তি করে অন্তত এক বছর শেয়ারটির দাম ধরে রাখতে হবে। এর পর লকইনের সময় শেষে শেয়ার ফ্রি হলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে সিন্ডিকেট সরে পড়ে। এভাবে দুর্বল কোম্পানির মাধ্যমে বাজার থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। এ ছাড়া ব্যাংক ও আর্থিক খাতের নেতিবাচক অবস্থা শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে বিভিন্ন কারণে সৃষ্ট দূরত্বের প্রভাব পড়েছে বাজারে।
জানা গেছে, দরপতনই শেয়ারবাজারের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর ধস নামার পর মাঝে কিছুদিন ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও কখনো স্বস্তিতে ছিলেন না বিনিয়োগকারীরা। আওয়ামী লীগ সরকার নতুন মেয়াদে দায়িত্ব নেয়ার পর অর্থমন্ত্রীর ঘোষণায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়। বিশেষত জানুয়ারির পর টানা কয়েক মাসের দরপতনের প্রেক্ষাপটে তিনি বাজেটে প্রণোদনা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ওই ঘোষণায় অনেক বিনিয়োগকারী আশ্বস্ত ছিলেন। কিন্তু বাজেট ঘোষণার পর হতাশ হয়েছেন তারা। ফলে ফের দরপতন শুরু হয়েছে। বাজেট পাসের পর দরপতনের মাত্রা বেড়েছে। অব্যাহত এ পতনে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে হতাশা। পতন ঠেকাতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে তারা করছে মানববন্ধন।
যদিও শেয়ারবাজারে গতি ফেরাতে সম্প্রতি বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ বাড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। তারল্য বাড়াতে রেপোর মাধ্যমে অর্থ সরবরাহের সুযোগ দিয়েছে বাাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু শেয়ারবাজারে এর কোনো ইতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। উল্টো বেড়েছে তারল্য সংকটের মাত্রা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, নগদ লভ্যাংশ দিতে উদ্বুদ্ধ করতে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ওপর করের চাপ বাড়িয়ে অর্থমন্ত্রী যে প্রণোদনা দেয়ার দাবি করেছেন তা ভালোভাবে নেননি বিনিয়োগকারীরা। অর্থমন্ত্রী প্রণোদনার আশ্বাস দিয়ে শেষ পর্যন্ত কোনো প্রণোদনা না দিলে বিনিয়োগকারীরা যতটা অসন্তুষ্ট হতেন, প্রণোদনার নামে করারোপে তার বেশি অসন্তুষ্ট, হতাশ ও আস্থাহীন হয়ে পড়েছেন।
জানা যায়, শেয়ারবাজারে প্রতিনিয়ত দরপতনের কবলে পড়ে পুঁজি হারাচ্ছেন লাখ লাখ বিনিয়োগকারী। এতে দিশেহারা বিনিয়োগকারীদের আর্তনাদ বেড়েই চলছে। পতনের ধকলে অনেকটা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা। বাজার বিনিয়োগকারীরা বলছেন, শেয়ারের দর বাড়ছে না। এ সময়ে নতুন যে কোম্পানিগুলো তালিকাভুক্ত হয়েছে, সেগুলো থেকেও ভালো মুনাফা পাওয়া যাচ্ছে না। বরং লেনদেনের প্রথম দিকে যে দাম থাকে সপ্তাহ পার হলেই শেয়ারপ্রতি লোকসান হয় ১০ থেকে ১৫ টাকা। আর বাজার বিশ্লেষকদের বক্তব্য, নির্বাচনের আগে পুঁজিবাজারে এমন মন্দাবস্থা সবসময় হয়। এ নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিনিয়োগ করা নিয়ে অস্থিতিশীলতা দেখা যায়। তবে এমন মন্দাবস্থা যেন দীর্ঘায়িত না হয়, সেদিকে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে নজর দিতে হবে।
পুঁজিবাজারের রাজ্জাক সিকিউরিটিজের বিনিয়োগকারী মোজাম্মেল হক জানান, সাত দিন আগে যে কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছিলাম, সে কোম্পানির শেয়ারের দর এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, শেয়ার বিক্রি করে টাকা উত্তোলন করলে বিনিয়োগ ফিরে পাওয়ার সুযোগ নেই। আবার নতুন বিনিয়োগ করে দাম সমন্বয় করলেও যে শেয়ার থেকে মুনাফা পাওয়া যাবে, সেটিও নিশ্চিত নয়। তিনি বলেন, পুঁজিবাজারের এমন অবস্থায় মিউচুয়াল ফান্ডগুলো সক্রিয় থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে তারাও পুঁজিবাজার স্থিতিশীল রাখতে ভ‚মিকা রাখছে না। নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে এ সময়ে বাজার পর্যবেক্ষণসহ লেনদেন বাড়ানোর বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া জরুরি। আরেক বিনিয়োগকারী শাহেদুল ইসলাম বলেন, এক মাসে যে বিনিয়োগ করেছি, সেটি থেকে এখনও মুনাফা উত্তোলন করা সম্ভব হয়নি। মুনাফা তো দূরে থাক, যা বিনিয়োগ করেছি প্রতিদিনই তা কমছে। ফলে এ সময়ে নতুন বিনিয়োগ করা প্রায় অসম্ভব। তিনি বলেন, এভাবে চলতে থাকলে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগ অন্য খাতে চলে যাবে। এতে সার্বিক বাজার যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনি বাজারের অস্থিতিশীলতা আরও বাড়বে। বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্যপরিষদের সভাপতি মিজানুর রশীদ চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, ‘খুবই খারাপ অবস্থা। গত এক–দেড় বছরে বাজার থেকে কেউ লাভ করেছে এমন বিনিয়োগকারী খুঁজে পাওয়া যাবে না। সবাই লোকসানে। এভাবে বাজার চলতে পারে না। কারো কোনো নজর নেই বাজারে। বাজার বাঁচাতে আমরা ২১ দফা দিয়েছিলাম। তারও কোনো খবর নেই। আমরা সবাই হতাশ–ক্ষুব্ধ।’ জানতে চাইলে সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন থেকে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা সংকট তৈরি হয়েছে। আর আস্থা সংকট না কাটলে বাজার ইতিবাচক হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। তিনি বলেন, প্রণোদনা দিলে বাজার সাময়িকভাবে উপকৃত হয়। এটি স্থায়ী কোনো সমাধান নয়।’
আস্থাহীনতার কারণে চাহিদার ৭০ শতাংশেই এখন জুয়াখেলা হচ্ছে: অধ্যাপক আবু আহমেদ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেছেন, পুঁজিবাজারে আস্থাহীনতার কারণে চাহিদার ৭০ শতাংশেই এখন জুয়াখেলা হচ্ছে। বাকি ৩০ শতাংশ সঠিক লেনদেন হচ্ছে। এ জন্য মূলত দায়ী হচ্ছে তারাই, যারা প্রতারণা করে মার্কেট থেকে টাকা তুলে নিয়ে গেছে। এ ছাড়া ২০১০ সালের ধসের পর কোনো ভালো শেয়ার আসেনি। ভালো কোম্পানি আনার ক্ষেত্রে কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগও নেয়া হয়নি।
বিএসইসির বর্তমান পর্ষদ কিছু নিয়ম-কানুনের পরিবর্তন করেছে, যা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থের বিরুদ্ধে চলে গেছে। যেমন গত তিন-চার বছর আগেও মিউচুয়াল ফান্ডের প্রতি মানুষের আগ্রহ ছিল। বিএসইসির নির্দেশে সেগুলো লিকুডিশনে চলে গেছে। বর্তমানে যেগুলো আছে তার ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেই। এ ছাড়া বিএসইসি সম্প্রতি খারাপ কোম্পানিগুলোর মেয়াদ বাড়িয়েছে ইউনিট হোল্ডারদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই। এরপর আইপিও কোটাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোটা কমিয়ে দিয়েছে। এতকিছুর পর কতগুলো ব্রোকার একত্র হয়ে সরকারের কাছে টাকা চাচ্ছে। অবশ্য তারা একটি একশন প্ল্যান দিয়েছে মন্ত্রণালয়ে, ভালো ভালো কোম্পানির শেয়ার তারা কিনবে, যেটা কিনবে তা হবে জামানত। এতে তো সাধারণ বিনিয়োগকারীরা লাভবান হবে না। আমি মনে করি, এসব না করে ভালো কোম্পানির শেয়ার মার্কেটে আনার চেষ্টা করতে হবে।
আবার গত সেপ্টেম্বর কোয়ার্টারের আর্থিক প্রতিবেদনে প্রায় প্রতিটি কোম্পানি খারাপ দেখিয়েছে। এ প্রভাব আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও পড়েছে। পাশাপাশি গ্রামীণফোন ইস্যুতে বাজার আরো খারাপ করেছে। এখন এই বাজারকে তুলতে হলে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) মাধ্যমে হোক অথবা অন্যকোনো মাধ্যমে হোক, অবশ্যই বাজারে বিনিয়োগ করতে হবে। আবার কয়েকটি আন্তর্জাতিক কোম্পানি ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে চলে যাওয়াটাও অনেক বড় প্রভাব পড়েছে।
বর্তমান বাজারে তারল্য সংকট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এই তারল্য সংকট কাটাতে হলে নতুন করে টাকা দিতে হবে। তবে অন্যভাবেও বাজার ঠিক হতে পারে, সেটা হলো পতনের সুযোগ দিতে হবে। নিচের দিকে নামতে নামতে একসময় গিয়ে আর নিচে নামবে না। সেখান থেকে আপনা আপনিই ঠিক হয়ে যাবে।