Home আন্তর্জাতিক শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক সংকটের নেপথ্যে

শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক সংকটের নেপথ্যে

বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক

দীর্ঘ ২৬ বছরের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে গত এক দশক ধরে ক্রমশ ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় ছিল দেশটা। ভারতের দক্ষিণে সেই দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা ফের তলিয়ে গেল অস্থিরতায়। কিন্তু কেন?

প্রবল জনরোষের মুখে পড়ে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া রাজাপক্ষে বুধবার দেশ ছেড়ে মালে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তার পর সর্বশেষ খবর হল, বৃহস্পতিবার দুপুরে সস্ত্রীক গোটাবায়া সিঙ্গাপুরে নেমেছেন। সংসদের স্পিকারকে পাঠিয়েছেন পদত্যাগপত্র।  সিঙ্গাপুর অবশ্য স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা কাউকে আশ্রয় দিচ্ছে না। শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি ব্যক্তিগত সফরে আসতে চেয়েছিলেন। সেই অনুমতি দিয়েছে মাত্র।

Sri Lanka Crisis Explained

তবে গোটাবায়া পালিয়ে গেলেও শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বো শান্ত হয়নি । পরিস্থিতি এতটাই অগ্নিগর্ভ যে বিক্ষোভকারীরা সিংহলের প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমসিঙ্ঘের অফিসও ঘিরে ফেলেছিল। তার পর সামরিক বাহিনীকে প্রধানমন্ত্রী স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে যা যা করতে হয় তা সেনা করতে পারে। বস্তুত বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে শুক্রবার সন্ধে পর্যন্ত কলম্বোয় কার্ফু জারি করা হয়েছে। তার মেয়াদ আরও বাড়ানো হবে বলেই মনে করা হচ্ছে।

শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক সংকটের পরিস্থিতি তৈরি হল কেন?

শ্রীলঙ্কার সরকারের বক্তব্য ছিল, পরপর দু’বছর কোভিডের কারণে দেশে পর্যটন শিল্প ভীষণভাবে মার খেয়েছে। তার ফলে বিদেশি মুদ্রার আমদানি ধাক্কা খেয়েছে। আর তাতেই মাজা ভেঙে গিয়েছে অর্থনীতির।

পর্যটন মার খাওয়ার আরও একটা বড় কারণ ছিল। ২০১৯ সালে কলম্বোয় উপর্যুপরি বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সে ঘটনা বিদেশি পর্যটকদের মনে প্রভাব ফেলে। ফলে তার পর থেকেই শ্রীলঙ্কায় বিদেশি পর্যটক আসা কমতে শুরু করে দেয়।

Sri Lanka Crisis Explained

অনেক বিশেষজ্ঞের মতে অবশ্য প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপক্ষের অর্থনৈতিক অব্যবস্থার জন্যই দেশটা ডুবেছে। শ্রীলঙ্কায় এলটিটিই সমস্যা তথা গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটেছিল ২০০৯ সালে। তার পর থেকে শ্রীলঙ্কা বৈদেশিক বাণিজ্যের তুলনায় ঘরোয়া বাজারে জোগান সামলানোতেই ফোকাস করেছিল। অর্থাৎ আমদানি বাণিজ্য ছিল বেশি, রফতানি বাণিজ্য ছিল প্রতিবেশী আর সব দেশের তুলনায় অনেকটাই কম। বর্তমানে প্রতি বছর শ্রীলঙ্কা ৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করে। কোভিডের পর দেশের বৈদেশিক মুদ্রা ভাণ্ডার তলানিতে এসে ঠেকে। ২০১৯ সালের শেষ দিকেও কলম্বোর কাছে ৭ বিলিয়ন ডলার বিদেশি মুদ্রা ছিল, যা এখন আড়াই মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। অর্থাৎ আমদানির জন্য পর্যাপ্ত অর্থ ছিল না। তাতেই মুখ থুবড়ে পড়েছে অর্থনীতি।

তা ছাড়া কর ছাড় ঘোষণার জন্যও গোটাবায়ার সমালোচনা করেছিলেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। ২০১৯ সালে গোটাবায়ার ঘোষণা করা ওই নীতির কারণেই সরকারের ১.৪ বিলিয়ন ডলার আর্থিক ক্ষতি হয়।

Sri Lanka Crisis Explained

সার্বিক এই অবস্থায় গত বছরের শেষ দিক থেকে শ্রীলঙ্কায় জ্বালানির সংকট তৈরি হয়। মাসের পর মাস নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল না, ওষুধের দোকানে ওষুধ পাওয়া যাচ্ছিল না। দেশে জ্বালানির বিপুল ঘাটতি তৈরি হচ্ছিল। লোকে পেট্রল, ডিজেল রান্নার গ্যাস পাচ্ছিল না। এই অবস্থায় এপ্রিল মাস থেকে শ্রীলঙ্কার রাস্তায় বিক্ষোভ আছড়ে পড়তে শুরু করে। তার পর সেটাই পুঞ্জীভূত বিস্ফোরণ ঘটায়।

শ্রীলঙ্কায় মুদ্রাস্ফীতির হার

শ্রীলঙ্কায় মুদ্রাস্ফীতির হার এখন ৫০ শতাংশেরও বেশি। মূলত জ্বালানি ও নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর চাহিদার তুলনায় জোগানের অভাবে গত জানুয়ারি মাস থেকেই শ্রীলঙ্কায় মুদ্রাস্ফীতির হার বাড়তে শুরু করে। জানুয়ারি মাসে তা ছিল ১০ শতাংশের বেশি। তা এপ্রিলে পৌঁছে যায় ৩০ শতাংশে। আর জুনে তা ৫৪ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়।

Sri Lanka Crisis Explained

এই মুহূর্তে শ্রীলঙ্কায় বাস, ট্রেন, হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স চালানোর মতোও পর্যাপ্ত জ্বালানি নেই। এমনকি সরকার তথা দেশের কাছে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ও এতটাই তলানিতে ঠেকেছে যে জ্বালানি আমদানি করার মতো অর্থও নেই। গত বছরের শেষ থেকেই শ্রীলঙ্কায় পেট্রল, ডিজেলের দাম বাড়া শুরু হয়েছিল। সেই সংকট ক্রমশই তীব্রতর হয়েছে। জুনের শেষে বাধ্য হয়ে সরকার জানিয়ে দেয়, অত্যাবশ্যকীয় পরিবহণ ছাড়া ২ সপ্তাহ কাউকে পেট্রল, ডিজেল দেওয়া হবে না। এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এমনকি স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়। সবাইকে বলা হয় যথাসম্ভব বাড়িতে বসে কাজ করতে।

শ্রীলঙ্কার মুদ্রার নাম কী? কোনও দেশে টাকা কমে এলে কী অবস্থা হয়?

Sri Lanka Crisis Explained

শ্রীলঙ্কার মুদ্রার নাম হল শ্রীলঙ্কান রুপি। দেশে মুদ্রা সংকট এতটা তীব্র হয়ে গিয়েছে যে মে মাসে বিদেশি ঋণের উপর বকেয়া সুদ পর্যন্ত দিতে পারেনি শ্রীলঙ্কা। দ্বীপরাষ্ট্রের ইতিহাসে এই প্রথম এ ঘটনা ঘটেছে। সুদ বাবদ দেয় ৭৮ মিলিয়ন ডলার মেটানোর জন্য ৩০ দিন সময় দেওয়া হয়েছিল শ্রীলঙ্কাকে। কিন্তু দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের গভর্নর পি নন্দলাল বীরাসিঙ্ঘে জানিয়ে দিয়েছেন, তা সম্ভব নয়।

পৃথিবীর সবথেকে বড় দুই ক্রেডিট রেটিং সংস্থাও জানিয়ে দিয়েছে, শ্রীলঙ্কা আর ঋণশোধ করার মতো অবস্থাতেই নেই। শ্রীলঙ্কার এই দেউলিয়া অবস্থা ভবিষ্যতের জন্য অশনি সংকেত বয়ে আনতে পারে। কারণ এই পরিস্থিতিতে কেউই শ্রীলঙ্কায় বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করবে না। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজার থেকে নতুন ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রেও সমস্যা হতে পারে।

Sri Lanka Crisis Explained

সংকটমোচনের পথ কী হতে পারে?

বস্তুত প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপক্ষে বুধবার তথা ১৩ জুলাই ইস্তফা দেবেন বলে ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু তার আগে বিক্ষোভকারীরা (Sri Lanka protests )তাঁর সরকারি বাসভবনে ঢুকে পড়ে। এই অবস্থায় আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও ইস্তফাপত্র না দিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান গোটাবায়া। প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমসিঙ্ঘেকে তিনি কার্যনির্বাহী রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব দিয়ে যান।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রীরও অসহায় অবস্থা। সমূহ কী করা উচিত তা স্থির করতে না পেরে আপাতত দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে দিয়েছেন তিনি। পশ্চিম প্রদেশে কার্ফু ঘোষণা করা হয়েছে।

এবার নিয়ে মোট ৬ বার শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন বিক্রমসিঙ্ঘে। তবে এখন তাঁর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব এতটাই দুর্বল যে তিনি কতটা সংকট মেটাতে পারবেন তা নিয়েই সংশয় তৈরি হয়েছে। কারণ, পর্যবেক্ষকদের মতে, শ্রীলঙ্কায় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এই সংকট থেকে বেরোনোর জন্য রাজনৈতিকভাবে মজবুত একটি কার্যকরী সরকার প্রয়োজন।

বর্তমানে শ্রীলঙ্কার উপর ৫১ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি ঋণের বোঝা রয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে ৬ বিলিয়ন ঋণ দিয়েছে চিন। পরিস্থিতি বুঝে বেজিং ইতিমধ্যে ঋণের পুনর্গঠনের কথা বলতে শুরু করে দিয়েছে। যা শ্রীলঙ্কার জন্য সুখকর নয়। তবে ইতিবাচক হল, শ্রীলঙ্কাকে ঋণের জট থেকে বের করে আনতে জি-সেভেন গোষ্ঠীভুক্ত রাষ্ট্রগুলি সাহায্যের ইঙ্গিত দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইটালি, জাপান, ব্রিটেন ও আমেরিকা। তা ছাড়া বিশ্ব ব্যাঙ্কও ৬০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে রাজি হয়েছে। ভারত জানিয়েছে, ১.৯ বিলিয়ন ডলার দিতে নয়াদিল্লি প্রস্তুত। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারও ৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে আলোচনা শুরু করেছে।

তবে বড় বিষয় হল, এই ঋণের টাকা ব্যবহার করে অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড় করানোর জন্যও একটা মজবুত সরকার প্রয়োজন। যার সম্ভাবনা এখনও দেখা যাচ্ছে না।

টাকা ছাপাবে সরকার

প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমসিঙ্ঘে ইতিমধ্যে জানিয়েছেন যে কর্মচারীদের বেতন দিতে সরকার টাকা ছাপাবে। তবে তিনি এও সতর্ক করেছেন যে এতে মুদ্রাস্ফীতির হার বাড়তে পারে এবং কিছু সামগ্রীর আরও দাম বাড়তে পারে। সেই সঙ্গে তিনি এও জানিয়েছেন. শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান সংস্থার বেসরকারিকরণও করা হতে পারে।

এ ছাড়া পেট্রোপণ্য সরবরাহের জন্য রাশিয়া ও কাতারকে এরই মধ্যে অনুরোধ করেছেন রনিল বিক্রমসিঙ্ঘে। যাতে পেট্রল, ডিজেলের দাম কিছুটা অন্তত কমানো সম্ভব হয়।