ড. লিপন মুস্তাফিজ:
শ্রীলঙ্কা স্বাধীন হওয়ার পরও দেশটিতে ছিল ব্রিটিশ আধিপত্য। ইউরোপীয়, বিশেষ করে ব্রিটিশরাই শ্রীলঙ্কার বাণিজ্য ও বাজার নিয়ন্ত্রণ করেছে সত্তর দশক পর্যন্ত। সেই সময় প্রায় চল্লিশ হাজারেরও বেশি ইউরোপিয়ান নাগরিক শ্রীলঙ্কায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেছে। এমনকি প্রশাসনেও ছিল তাদের যথেষ্ট প্রভাব। বিশ্লেষকের মতে, উপমহাদেশ থেকে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা চলে গেলেও পরে ভারত নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। রাতারাতি একটি নতুন ভারতীয় অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজ তথা রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে ওঠে। কিন্তু শ্রীলঙ্কায় ১৯৭২ সাল পর্যন্ত এই ইউরোপীয় তথা ব্রিটিশ ছায়া-রাজ থাকার ফলে দেশটি ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যেতে থাকে।
শ্রীলঙ্কা নানা সময় খবরের কাগজের শিরোনাম হয়েছে। ছোটবেলায় রাজীব গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যখন ভারতে দেখেছি, তখন অন্য এক শ্রীলঙ্কাকে পাই। আবার যুবক বয়সে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, তখন অর্জুনা রানাতুঙ্গার নেতৃত্বে ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয় করে। তখন আবার খেলুড়ে দেশ হিসেবে একটু করে এ দেশের প্রেমে পড়ি। প্রায় পাঁচ বছর আগে আমি শ্রীলঙ্কায় বেড়াতেও গিয়েছিলাম। প্রথমেই আমাকে যে বিষয়টা মুগ্ধ করেছিল, তা হলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এক শহর কলম্বো। আরও একটা বিষয় নজরে পড়েছিল তা হলো স্থানীয় লোকজন অনেক নম্র ও ভদ্র। ছেলেবেলায় তামিলদের খবর পত্রপত্রিকায় পড়ে মনে হতো পুরো দেশ বুঝি উগ্র। সবকিছুকে ছাপিয়ে দেশটি আবারও পত্রিকার শিরোনামে। দেশটি এখন দেউলিয়া হওয়ার পথে। অথচ সামাজিক সূচকে একসময় দেশটা ছিল দক্ষিণ এশিয়ার সেরা। বলার অপেক্ষা রাখে না এই দেশটির হাত ধরেই এই অঞ্চলে পোশাকশিল্পের পথচলা। শ্রীলঙ্কা ক্রমেই পেছাতে শুরু করে, এমনকি আশির দশকে বাংলাদেশে যে তৈরি পোশাকশিল্পগুলো সরে আসে তা মূলত গৃহযুদ্ধের কারণে। ক্রেতারা দেশটিতে যেতে ভীতবোধ করার কারণেই, পরে চেষ্টা করেও শ্রীলঙ্কা সেই জায়গায় ফিরতে পারেনি। ফলে একটা সময় অসংখ্য শ্রীলঙ্কান বায়িং হাউজ বাংলাদেশে এসে কাজ শুরু করে। ধীরে ধীরে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পে শ্রীলঙ্কানদের উপস্থিতি বাড়তে থাকে।
মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রথম পা রাখা শ্রীলঙ্কা মূলত নির্ভরশীল ছিল পর্যটন খাতের ওপর। পর্যটন খাত থেকে দেশটির আয় ৫ থেকে ৬ বিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া দেশটির বিরাটসংখ্যক প্রবাসী বছরে ৩ থেকে ৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠায়। দেশটির মাথাপিছু আয় ৩ হাজার ৮১৯ ডলার ছিল, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। এমনকি দেশটি উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। অথচ বর্তমানে শ্রীলঙ্কায় আর্থিক ও মানবিক সংকট গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। আমদানি করা পণ্যের ক্রমবর্ধমান ঘাটতি সে দেশের জনজীবনকে পর্যুদস্ত করে তুলেছে। পুরো ব্যবস্থা ধসের আশঙ্কায়। সরকার বাধ্য হয়েই ‘অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা’ জারি করেছে। কয়েক মাস ধরে দেশটিতে চলছে ভয়াবহ খাদ্য সংকট। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে পৌঁছে যাওয়ার কারণে বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করে সংকট মোকাবিলার সামর্থ্যও হারিয়েছে শ্রীলঙ্কান সরকার। বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুরুতর এ সংকট এবং অস্বাভাবিক মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির কারণে ২০২২ সালে দেশটি অর্থনৈতিক দেউলিয়া হওয়ার দিকে যাচ্ছে।
বিশ্বব্যাংক মনে করছে, করোনা শুরুর পর থেকে শ্রীলঙ্কার পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। খাদ্য-মুদ্রাস্ফীতি ২১ দশমিক ৫ শতাংশ, সুপার মার্কেটের তাকগুলো খালি পড়ে রয়েছে। রেস্তোরাঁগুলোতে খাবার পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত ডিসেম্বরে সেখানে পণ্যের দাম ১৪ শতাংশ বেড়েছে, যা তার আগের মাসের চেয়ে ১১ দশমিক ১ গুণ। আদমশুমারি ও পরিসংখ্যান বিভাগ বলছে, ২০১৫ থেকে গত বছরের শেষ সময়ের মধ্যে গত ডিসেম্বরে মুদ্রাস্ফীতি সবচেয়ে বেশি হয়েছে। করোনা দেশটির পর্যটনশিল্পকে একেবারে তছনছ করে হাজারো মানুষকে চাকরি হারা করেছে। অথচ এ দেশের শিক্ষিতের হার উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের তুলনায় ছিল অনেকটাই বেশি। দেশটির চলমান অবস্থাকে ১৯৭০-এর দশকের দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করছেন অনেকেই। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনার পাশাপাশি এমন দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির প্রধান কারণ শ্রীলঙ্কান সরকারের উচ্চব্যয় এবং ট্যাক্স হ্রাস, যা রাজস্ব খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তা ছাড়া বিপর্যয়কর পরিকল্পনা ও নীতি প্রণয়ন শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সম্প্রতি সরকার আকস্মিকভাবে সার ও কীটনাশক নিষিদ্ধ করে অর্গানিক পদ্ধতি অনুসরণের জন্য কৃষকদের বাধ্য করে। এতে খাদ্য উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে আসে। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের আরেকটি কারণ বৈদেশিক ঋণ। শুধু চীনের কাছ থেকেই ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ নিয়েছে দেশটি। গত বছর সংকটের মধ্যে আরও এক বিলিয়ন ডলার ধার নেয়। এখন এসব ঋণ কিস্তিতে তাদের শোধ করতে হচ্ছে। শুধু চীন নয়; ভারত ও জাপানের কাছ থেকে উচ্চসুদে ঋণ নিয়েছে তারা।
শুধু অর্থনৈতিক না রাজনৈতিক দক্ষতার অভাবও লক্ষ করা যায়। ২০১৯ সালে নতুন সরকার গঠন হওয়ার পর গৃহীত অনেক নীতি আসলে সে দেশের জন্য হুমকি ছিল। আবার একই সালের বোমা বিস্ফোরণের ফলে ২৫৩ জনের মৃত্যুর ঘটনা, দেশটিতে পর্যটনশিল্পকে রহিত করেছে। বর্তমানে সেখানে প্রতি কেজি চাল বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকায়, চিনি কেজি ৪০০ টাকা, আর এক কাপ চা খেতে গুনতে হচ্ছে ১০০ টাকা। ভোজ্য তেলের অভাবে মাছ-মাংস খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। মানুষ যে নিরামিষ বা শাকসবজি খাবে তা রান্না করার জন্য সিলিন্ডার গ্যাস পাচ্ছে না। অন্যদিকে জ্বালানি তেলের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে পাবলিক বাস সার্ভিসগুলোও। তেলের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে গত মার্চের ২০ তারিখে মানুষের ধাক্কাধাক্কিতে দুজন বৃদ্ধ মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছে। এমনকি কাগজের অভাবে শ্রীলঙ্কার স্কুল-কলেজগুলোতে বন্ধ হয়ে গেছে পরীক্ষা। এসব খবরা-খবর সে দেশের পত্রপত্রিকাগুলো প্রচার করতে পারছে না। কারণ কাগজের অভাবে তাদের নিজেদের প্রকাশনা বন্ধ হয়ে আছে।
ভারত মহাসাগরের ছোট্ট দ্বীপটিতে জ্বালানি তেলের জন্য হাহাকার এতটা শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে পেট্রল পাম্পের নিরাপত্তার জন্য সেখানে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। অর্থনৈতিক মন্দায় হু-হু করে নেমে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কান রুপির দাম। আগে যেখানে ৮০ রুপিতে ১ ডলার পাওয়া যেত, এখন সেখানে প্রতি ডলার ২৯৫ রুপি। আগে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মুদ্রার মান সমান থাকলেও বর্তমানে তিন লাখ শ্রীলঙ্কান রুপি পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশের ১ লাখ টাকায়। সব মিলিয়ে দেশটির মানুষ কষ্টে দিন পার করছে। লোডশেডিংয়ের কারণে অন্ধকারে দিন গুনতে হচ্ছে। যাদের হাতে টাকা আছে তারাও খাবার কিনতে পারছে না। বিক্ষিপ্ত মানুষ নেমে এসেছে রাজপথে। তবে শ্রীলঙ্কার নবনিযুক্ত অর্থমন্ত্রী আলিসাবরি বিষয়টি নিশ্চিত করে জানিয়েছেন, বিশ্বব্যাংক তাৎক্ষণিকভাবে জরুরি ওষুধ কেনার জন্য ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান দিয়েছে। রয়টার্সের খবর থেকে জানা যায়, আগামী ছয় মাসের মধ্যে এ সংকট কাটিয়ে উঠতে দেশটির ৩০০ কোটি ডলার সহায়তা প্রয়োজন। এই অর্থ দিয়ে জ্বালানি, ওষুধসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহের গতি স্বাভাবিক করা সম্ভব হবে বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন আলিসাবরি। ২ কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার এই দ্বীপ রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে ওষুধ, জ্বালানি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ভয়াবহ সংকট তৈরি হয়েছে। ফলে দেশটির প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগের দাবি আরও জোরালো হয়ে উঠছে। বিভিন্ন স্থানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ চলছে।
আন্তর্জাতিক বন্ড পুনর্গঠন করার চেষ্টা করছে শ্রীলঙ্কা। এ ছাড়া অর্থ প্রদানের ওপর একটি স্থগিতাদেশ চাইবে দেশটি এবং জুলাই মাসে আসন্ন ১০০ কোটি ডলার অর্থ প্রদানের জন্য বন্ডহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনার বিষয়েও আত্মবিশ্বাসী তারা। দেশটির সরকার এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, বিশ্বব্যাংক এবং চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অংশীদার দেশগুলোর কাছেও সহায়তা চাইবে বলে জানানো হয়েছে। শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ৭০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে। দেশটিতে মার্চে খাবারের দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশ। পর্যটন খাতের ওপর নির্ভরশীল দেশটিতে জীবনযাত্রার ব্যয় অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। ভারত, চীন ও বাংলাদেশ থেকে ঋণ নিয়েছে নগদ অর্থ সংকটে জর্জরিত শ্রীলঙ্কা। এ ছাড়া ২০২১ সালের জুনে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কাকে ১০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে শ্রীলঙ্কা চীনের কাছে ঋণ পুনর্নির্ধারণের আবেদন জানায়। ফেব্রুয়ারিতে দেশটি ভারতের কাছ থেকে ৫০ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে তেল কেনার জন্য। তা ছাড়া ৮ মার্চ ভারত শ্রীলঙ্কাকে আরও ১০০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা দেয়। এদিকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশটির বৈদেশিক রিজার্ভ ছিল মাত্র ২৩১ কোটি ডলার। চলতি বছরের মার্চে শ্রীলঙ্কায় খাবারে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়ায় ৩০ দশমিক ২ শতাংশে। ২০১৯ সালে দেশটির মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১ দশমিক ৪ শতাংশ।
আমাদের দেশ থেকে শ্রীলঙ্কা খুব বেশি দূরে নয়। উপমহাদেশের কোনো একটি দেশে কোনো নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটলে তার প্রভাব বাকি দেশগুলোতে পড়ে। হোক তা রাজনৈতিক অথবা অর্থনৈতিক। বাংলাদেশ নিয়েও সতর্ক হওয়ার কথা বলছেন অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদরা। পাশাপাশি নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশের বড় কোনো বিপদের সম্ভাবনা নেই সে কথাও বলছেন। মূলত বাংলাদেশের রিজার্ভ, ঋণের পরিমাণ এবং আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ‘শক্ত’ বলে মনে করা হচ্ছে। চলমান মেগা প্রকল্পসমূহ অতি দ্রুত শেষ করে সেগুলোকে লাভজনক করে তুলে বাংলাদেশকে যত দ্রুত ‘ঋণমুক্ত’ করা যায় সেদিকেও নজর দেওয়া দরকার। আবার পাশের দেশে যা যা ঘটেছে তা আগে থেকেই আঁচ করে আমাদের পরিকল্পনা নিতে হবে, যাতে করে আমাদের দেশের অর্থনীতিতে এর কোনো বিরূপ প্রভাব না পড়ে।