Home Third Lead অদক্ষতা অসচেতনতাই দায়ী

অদক্ষতা অসচেতনতাই দায়ী

মোজাম্মেল হক চৌধুরী

 মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী:বিগত সরকারের সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ওবায়দুল কাদের। পরিবহনে বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা, ভাড়া নৈরাজ্য, সড়কে চাঁদাবাজি, যাত্রীসাধারণের দুর্ভোগ লাঘব, মানসম্মত গণপরিবহন নামানো, অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে চরমভাবে ব্যর্থ ছিলেন তিনি। রাজনীতিবিদ হিসেবে সফল হলেও মন্ত্রী হিসেবে সড়ক পরিবহন সেক্টর পরিচালনার কলাকৌশল, সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর মতো কারিগরি জ্ঞান, যানজট নিরসনের মতো প্রকৌশলগত প্রখর অভিজ্ঞতা তার ছিল না। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণবিপ্লবের মধ্য দিয়ে সরকার পরিবর্তনের পরও সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএতে দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগেনি। এখনো সড়কে গণহত্যা বন্ধে, যানজট ও দুর্ঘটনা কমাতে, সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ৫ আগস্টের পর সড়কের চাঁদাবাজরা পালিয়েছে, দফায় দফায় জ্বালানি তেলের দাম কমেছে কিন্তু পরিবহন ভাড়া কমেনি। ফলে পণ্যমূল্যও কমছে না। জরুরিভিত্তিতে পরিবহন খাত জঞ্জালমুক্ত করতে হলে এ খাতের আপাদমস্তক সংস্কার প্রয়োজন। তাই অন্যান্য খাতের মতো পরিবহন খাত সংস্কার কমিশন গঠন করা জরুরি।

দুই দশকের জনগণের অধিকারের বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে আমরা বাস্তব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি। এই সেক্টরে বিশেষ করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ অথবা সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে যেসব আমলা বা কর্মকর্তারা কাজ করছেন তারা কেউই মূলত সড়ক নিরাপত্তার বিষয়ে অভিজ্ঞ বা বিশেষজ্ঞ নন। পরিবহন সেক্টর পরিচালনার মতো সম্যক জ্ঞান তাদের নেই। এখানে সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের কোনো প্যানেলও নেই। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে কয়েক বছর কাজ করে তাদের মধ্যে পরিবহন সংক্রান্ত কিছু ধারণা বা অভিজ্ঞতা তৈরি হওয়ার পর তারা পদোন্নতি নিয়ে অথবা বদলি হয়ে অন্য মন্ত্রণালয়ে বা সংস্থায় চলে যান। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএতে আজ থেকে ৫ বছর আগেও রোড সেফটি কোনো ইউনিট ছিল না। আমরা বারবার দাবি দিয়ে বিআরটিএতে একটি রোড সেফটি ইউনিট গঠন করাতে পারলেও সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে এখনো কোনো রোড সেফটি ইউনিট নেই। এই মন্ত্রণালয়ে নানা খাতে অর্থ বরাদ্দ থাকলেও রোড সেফটি খাতে কোনো অর্থ বরাদ্দের অর্থনৈতিক কোড নেই।

সড়ক পরিবহন সেক্টর একটি জনগুরুত্বপূর্ণ কারিগরি সেক্টর, পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে পরিবহন সেক্টর পরিচালিত হয় কারিগরি পন্থায়। আমাদের দেশে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে, অনভিজ্ঞ লোকজনকে মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ফলে নানাভাবে চেষ্টা করেও তারা জনদুর্ভোগ লাঘবে সফল হয় না। ফলে আমাদের দেশে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি কমে না। অন্যদিকে পরিবহন পরিচালনার কৌশলগত অনভিজ্ঞতার কারণে আমাদের দেশের পরিবহন সেক্টর পরিচালিত হচ্ছে উল্টো নীতিতে। উন্নত বিশ্বে যেসব নগরে ২০ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করে সেখানে একসঙ্গে বেশি মানুষের যাতায়াত নিশ্চিত করার জন্য ম্যাস ট্রানজিট ব্যবহার করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে যেসব নগরীতে ৮০ লাখ থেকে কোটি মানুষ বসবাস করে সেখানে মোটরসাইকেল, ইজিবাইক, অটোরিকশার মতো ছোট ছোট যানজট সৃষ্টিকারী যানবাহন প্রাধিকার পাচ্ছে। মূলত মন্ত্রণালয় ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্তদের অদক্ষতায় এমনটি হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করে। আমাদের রাজধানীতে স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে মাত্র একটি এমআরটি (মেট্রোরেল) চালু করা গেলেও চট্টগ্রামসহ দেশের বড় শহরগুলোতে ম্যাস ট্রানজিট এখনো কল্পনা করা যায় না। অথচ পরিবহন সেক্টর পরিচালনার অদক্ষতায় কোটি কোটি টাকা দুর্নীতি ও অপচয় হচ্ছে। প্রকৌশলগত ত্রুটির কারণে আমাদের পরিবহন সেক্টর যেমন বিশৃঙ্খল, তেমনি যাত্রীরাও অসচেতন। ফুটপাত হকারের দখলে থাকায় অনেক পথচারী রাস্তার মাঝখান দিয়ে যাতায়াত করে থাকে। ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারের পরিবর্তে অনেক পথচারী সড়কের মিডিয়ান টপকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সড়ক পার হচ্ছে। আবার কেউ কেউ জেব্রাক্রসিং ব্যবহার না করে সড়কের যেখানে সেখানে চলমান গাড়ির সামনে হাত তুলে পারাপার হতে গিয়ে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় অসংখ্য প্রাণহানি ঘটছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির ২০২৩ সালের সর্বশেষ বার্ষিক সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন বলছে, সড়কে পথচারী মৃত্যুর হার ৪৮.৩৩ শতাংশ।

কেবল পথচারীরা সচেতন হলে সড়কে দুর্ঘটনা মৃত্যুর হার অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব। এ জন্য প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা তৈরি। মসজিদে জুমার খুতবা, স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে সড়ক নিরাপত্তা সংক্রান্ত শিক্ষা, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে সড়ক নিরাপত্তা সংক্রান্ত ও সড়ক ব্যবহার সংক্রান্ত কৌশলগুলো উপস্থাপন করা এবং আলোচনা করা জরুরি। সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস করা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এখানে যেমন বহুমাত্রিক ব্যবহারকারী রয়েছে, তেমনি সব পক্ষেরই কিছু না কিছু দায়িত্ব রয়েছে। পরিবহন মালিকের দায়িত্ব হচ্ছে, সর্বপ্রথম তার গাড়িটি যান্ত্রিক ত্রুটিমুক্ত রাখা এবং একজন দক্ষ উপযুক্ত লাইসেন্সধারী চালকের হাতে যানবাহন পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করা। তেমনি পরিবহন শ্রমিক সংগঠনগুলোও দুর্ঘটনার দায় থেকে মুক্ত নয়।

একজন চালকের দায়িত্ব হচ্ছে সড়কে গাড়িটি নামানোর আগে গাড়ির ইঞ্জিন, ব্রেক অয়েল, গিয়ার অয়েল, ফুয়েল, ব্রেক, পানিসহ প্রয়োজনীয় সবকিছু সঠিক আছে কি না তা যাচাই করে রাস্তায় নামানো। সড়কে আইন ও বিধিবিধান মেনে গাড়ি চালানো। সময়ে সময়ে ট্রাফিক আইন ও ট্রাফিক নির্দেশনা মেনে গতিসীমার মধ্যে গাড়ি চালানো। সড়কে কর্মরত শ্রমিক সংগঠনগুলোর প্রধান কাজ হবে, চালক-শ্রমিকদের সড়ক আইন সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা। আমরা মূলত আমাদের দেশের চালক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর কাছে এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো দেখতে পাই না। তারা ক্ষমতা জাহির করে সরকার ও জনগণকে জিম্মি করার প্রচেষ্টায় থাকে। এহেন অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে তাদের ইতিবাচক কাজে ফেরানো গেলে সড়কে নিরাপত্তা অনেকখানি এগিয়ে যাবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকারের একা কিছু করার নেই।

লেখক: মহাসচিব বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি