Home অন্যান্য সিডও: নারীর প্রতি বৈষম্য বিলোপ সনদ

সিডও: নারীর প্রতি বৈষম্য বিলোপ সনদ

নাসিমুনআরা হক ( মিনু ) 

নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ সিডও (CEDAW) । সিডও হলো একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার দলিল। নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জাতিসংঘ সনদ। ইংরেজিতে Convention on the Elimination of All forms of Discrimination Against Women। এটি জাতিসংঘের একটি মৌলিক মানবাধিকার দলিল। ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে এই সনদ গৃহীত হয়। ১৯৮১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে এটি কার্যকর হয়। সে হিসাবে ৩ সেপ্টেম্বর সারাবিশ্বে সিডও দিবস হিসেবে পালিত হয়ে থাকে।
জাতিসংঘ গৃহীত সিডও সনদ জীবনের সকল ক্ষেত্রে নারীর সমানাধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে নারীর পক্ষে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। বলা যায়, এটি এক মাইল ফলক। আমরা জানি সমাজে নারী ও পুরুষের মধ্যে চরম বৈষম্য বিরাজমান। সেই বৈষম্য অবসানের লক্ষেই নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদটি গৃহীত হয়েছে। জাতিসংঘের নারীর মর্যাদা বিষয়ক কমিশন, বিভিন্ন ওয়াকিং গ্রুপ ৫(পাঁচ) বছর ধরে এই সনদ প্রণয়নের জন্য কাজ করে।
এই সনদে স্বাক্ষরকারী জাতিসংঘ সদস্য দেশগুলো এই সনদের ধারাগুলো নিজ নিজ দেশে কার্যকর করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। সিডও সনদের মূল কথা হচ্ছে সমাজ ও সভ্যতার ক্রম বিকাশে যুগ যুগ ধরে নারী যে গঠনমূলক ভুমিকা পালন করে আসছে তার যথাযথ স্বীকৃতি। সার্বিকভাবে গোটা বিশ্বের শান্তি ও উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সকল ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন, প্রচলিত আইনের সংস্কার, আইন প্রয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি।
এই সকল বিষয়েই স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলো প্রতীজ্ঞাবদ্ধ। এদেশে নারী আন্দোলনের দাবির ফলে বাংলাদেশ ১৯৮৪ সালের ৬ নভেম্বর সিডও সনদে সই করেছে সে হিসেবে বাংলাদেশ সিডও (CEDAW) সনদ বাস্তবায়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
তবে বাংলাদেশ তখন সিডওর ১৬টি ধারার মধ্যে ৪টি ধারা বাদ রেখে সিডওতে অনুমোদন দিয়েছিল। তখন থেকে বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের পক্ষ থেকে সিডওতে পূর্ণ অনুমোদন দেয়ার জন্য দাবি জানানো হচ্ছে। এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৭ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তৎকালীন সরকার ৪টির মধ্যে ২টি ধারা থেকে আপত্তি প্রত্যাহার করে নেয়, দুটিতে আপত্তি বহাল থাকে। এই দুটি ধারা হচ্ছে সিডও-র ২নং ধারা ও ১৬ (১) (গ) । ইংরেজিতে Article -২ ও ১৬ (১) (প)।
আগেই বলেছি সিডওতে মোট ৩০টি ধারার মধ্যে প্রথম ১৬টি ধারা হচ্ছে নারীর সমঅধিকার সংক্রান্ত বা সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য করণীয় বিষয় সম্পর্কিত। আর ১৭ থেকে ৩০নং ধারা হচ্ছে, জাতিসংঘ কীভাবে সিডও কে কার্যকর করবে সে সম্পর্কে। যেমন, সিডও কমিটি কীভাবে গঠিত হবে, সিডও কমিটি কীভাবে কাজ করবে এ সম্পর্কিত বিষয়ে। এই সনদের ১নং ধারায় নারীর প্রতি বৈষম্য বলতে কী বোঝায় তা সুস্পস্ট করে বলা হয়েছে।
এই প্রথম কোনো একটি জাতিসংঘ সনদে নারী-পুরুষের বৈষম্যের বিষয়টি সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। পুরুষ-নারী ভিত্তিতে যেকোনো পার্থক্য, বঞ্চনা বা নারীর ওপর কোনো বিধি নিষেধ আরোপ করা হলে তাকেই বৈষম্য বলে গণ্য করা হবে। নারীর মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতা কোনো অবস্থায় ক্ষুণ্ণ করা যাবে না। এমনকি, সিডও সনদে এ-ও বলা হয়েছে, কোনো ঐতিহ্য, ধর্ম বা সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে নারীর মৌলিক অধিকার বা মানবাধিকারকে কোনো অবস্থায় খর্ব করা বা বিঘ্নিত করা যাবে না। সিডও সনদের ৫নং ধারায় নারীর মাতৃত্বকে সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সমাজের প্রতি নারীর এই গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান অবদানকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
সিডওর ধারাগুলিতে এছাড়াও শিক্ষা, কর্মসংস্থান, খেলাধূলা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কৃষিসহ সকল ক্ষেত্রে নারীর সম-অধিকার নিশ্চিতে করণীয় সমূহ বর্ণনা করা হয়েছে। সবকটি ধারা এখানে তুলে ধরার সুযোগ নেই। তাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সম্পর্কে কিছু কথা বলছি।
এখন আমি ২নং ধারার কথায় সিডওর ২নং ধারাকে বলা হয়ে থাকে সিডওর প্রাণ। ২নং ধারা অনুমোদন না করা সিডও অনুমোদন না করারই শামিল। বাংলদেশে এখনো ২নং ধারাতে আপত্তি বহাল রেখেছে। ২নং ধারা হচ্ছে সংবিধানে নারী-পুরুষের সম-অধিকার লেখা এবং এই ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়ন করা এবং প্রয়োজনে দেশের বিদ্যমান আইনের সংষ্কার সাধন সম্পর্কিত। বাংলাদেশের সংবিধানের ১০৯(১); ২৭,২৮ সহ বিভিন্ন ধারায় নারী-পুরুষের পূর্ণ সম-অধিকারের কথা সুস্পষ্ট ভাবে ঘোষণা করা আছে। তারপরও ২ নং ধারায় অনুমোদন দিতে সরকারের দ্বিধা কেন এটা বোধগম্য নয়।
দীর্ঘদিন ধরে দেশের নারী সমাজ সিডও-র ২নং ধারা ও ১৬(১) (গ) ধারা থেকে আপত্তি প্রত্যাহার করে সিডওতে পূর্ণ অনুমোদন দেয়ার দাবি জানিয়ে আসছে। জাতিসংঘ কমিটিও বারবার ২নং ধারা থেকে আপত্তি প্রত্যাহারের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে। সরকারও এ ব্যাপারে বহুবার অঙ্গীকার করেছে। এখানে বলা দরকার, সিডও সনদই এমন একটি সনদ যেখানে রাষ্ট্রগুলোকে জাতিসংঘ সিডও কমিটি তথা জাতিসংঘের কাছের জবাবদিহিতার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রতিটি স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রকে প্রতি চার বছর অন্তর সিডও কমিটির কাছে কার্যক্রমের রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়। সরকার রিপোর্ট পেশ করার পর সিডও কমিটি যা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে, চুলচেরা বিশ্লেষণ করে রাষ্ট্রসমূহের পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে সুপারিশ করে ও দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকে।
বাংলাদেশ ২০১১ সালের ২৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ সিডও-র ৮৪ তম সভায় প্রতিশ্রুতি দেয় যে সরকার সিডও সনদ বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করবে এবং এই লক্ষ্যে সিডও কমিটির সহযোগিতাও কামনা করে। অপর দিকে সিডও কমিটি ২নং ধারা থেকে সংরক্ষণ বা আপত্তি বাতিলের দ্রুত সুপারিশ নিতে বলে। কমিটি দেশে অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রচলন করতে তাগিদ দেয়। কমিটি জোর দিয়ে বলে, বাংলাদেশকে অনতিবিলম্বে দেশের আইনে সিডও সনদের ধারাসমূহ অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। এছাড়াও, সব ধরনের নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে বর্তমান আইনের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারকে তৎপর হতে হবে। সুপারিশে আরও বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদের নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের পরিবর্তে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। কমিটির অনেকগুলো সুপারিশের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সুপারিশ জরুরি বিবেচনায় এখানে তুলে ধরা হলো।
সিডও কমিটির কাছে পরবর্তী রিপোর্টে সরকার বলেছে, ২নং ধারা থেকে সংরক্ষণ প্রত্যাহারে বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এখানে কোনো সময়সীমার কথা সরকার উল্লেখ করেনি। বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ সরকার কালক্ষেপণ করে চলেছে। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, জাজিসংঘ সিডও কমিটির কাছে সর্বশেষ রিপোর্টে বাংলাদেশ সরকার বলেছে সিডওতে পূর্ণ অনুমোদন দেয়ার জন্য সমাজ প্রস্তুত নয়। অর্থাৎ তার পূর্ব প্রতিশ্রুতি থেকে সরকার সরে এসেছে।
এ ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, সরকার তো এভাবে প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসতে পারে না।
সমাজকে প্রস্তুত করার জন্যই তো সিডওতে পূর্ণ অনুমোদন দিয়ে পর্যায়ক্রমে সিডওর বাস্তবায়ন প্রয়োজন। সমাজ তো নিজে নিজে প্রস্তুত হয় না সেজন্য সরকারকে এবং আমাদের সবাইকে কাজ করতে হবে নিরলসভাবে। সেজন্য একদিকে আইন প্রণয়ন করতে হবে অন্যদিকে সারাদেশে ব্যাপক প্রচারাভিযান চালিয়ে দেশের মানুষের চিন্তার পরিবর্তনের জন্য কাজ করতে হবে। এজন্য বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। এছাড়া পাঠ্যসূচিতে অমূল পরিবর্তন আনতে হবে। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য চলচ্চিত্র, নাটক, বিজ্ঞাপনসহ দেশের গণমাধ্যমকে ব্যবহার করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বলা দরকার এই উপ-মহাদেশে এক সময় ধর্মের নামে হিন্দু মেয়েদের স্বামীর চিতায় পুড়িয়ে মারার বর্বর সতীদাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। যখন সতীদাহ বন্ধের আইন হয় তখন সমাজ কি প্রস্তুত ছিলো? না। অনেক বাধা এসেছিল সমাজ থেকে। সতীদাহ বন্ধের দাবিতে আন্দোলন হয়েছে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে। সতিদাহ নিরোধ আইন পাস হয়েছে। সতীদাহও বন্ধ হয়ে গেছে। নৃশংসভাবে মেয়েদের পুড়িয়ে মারা ও বন্ধ হয়েছে। আজ আর ধর্মের নামে এভাবে কোনো মেয়েকে পুড়িয়ে মারা যাবে না। কাজেই আইনটি প্রণয়ন করতে হবে আগে।
দেশে শাসনের দায়িত্বে যারা রয়েছেন তাদের পক্ষ থেকে কখনও কখনও আমরা এমন শুনে থাকি ধর্ম একটা ষ্পর্শকাতর বিষয়। ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত হানে এমন আইন করা যাবে না। কিন্তু মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক রাষ্ট্র। এটি কোনো ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র নয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্র। শরীয়া আইন দ্বারা এই দেশ পরিচালিত হয় না। দেশের কল্যাণ ও উন্নয়নের স্বার্থেই সিডওতে সরকারের অনুমোদন দেয়া প্রয়োজন। লক্ষণীয় যে, সিডও অনুমোদনে মুসলিম দেশগুলোও পিছিয়ে নেই। সিডও পূর্ণ অনুমোদনকারী মুসলিম বা মুসলিম প্রধান দেশের মধ্যে রয়েছে, ইন্দোনেশিয়া, মালি, আজারবাইজান, বেনিন, রুরকিনা কাসো, ক্যামেরুন, গাম্বিয়া, গিবন, গিনি বিসাউ, সেনেগাল, সিয়েরা লিওন, উগান্ডা, ইয়েমেন, বসনিয়া হার্জেগোভিনা এবং সর্বশেষ তিউনিসিয়াসহ মোট ২৬টি দেশ।
১৫টি মুসলিম দেশ বা মুসলিম প্রধান দেশ সিডও সনদের কোনো ধারাই সংরক্ষণ করেনি। এছাড়াও দেখা গেছে যে, যেসব দেশে শরীয়া আইনের অংশ বিশেষ দেশের আইনে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সেসব দেশও সিডও সনদের কোনো ধারা সংরক্ষণ করেনি। যেমন- কুয়েত, ইন্দোনেশিয়া, জর্ডান, ইয়েমেন, তুরস্ক, নাইজেরিয়া, তাঞ্চুনিয়া, সেনেগাল। এমনকি পাকিস্তান, মালদ্বীপ ও সৌদি আরবে পর্যন্ত ২নং ধারায় আপত্তি জানিয়ে তা সংরক্ষণ করা হয়নি। তবে এক্ষেত্রে তারা ঘোষণা করেছে যে, তাদের সংবিধানের স্থান হচ্ছে সর্বোচ্চ।
বর্তমান সরকার নারী উন্নয়নের সপক্ষে ইতোমধ্যে বহু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। জাতিসংঘ সিডও কমিটি সেসব পদক্ষেপের প্রশংসাও করেছে। সরকার সিডও-র ৯নং ধারার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দেশের নাগরিকত্ব আইনে পরিবর্তন এনেছে। সরকার সকল সনদে পিতার নামের পাশাপাশি মাতার নাম অন্তর্ভুক্ত করেছে। নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধির জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে নারীদের নিয়োগ দিয়েছে। এসবই ইতিবাচক পদক্ষেপ। কিন্তু সিডওতে পূর্ণ অনুমোদন না দিলে বা এই সনদ বাস্তবায়ন না কররে সকল ইতিবাচক পদক্ষেপই অসম্পূর্ণ ও অর্থহীন থেকে যাবে।
নারীকে মানুষ হিসেবে পুর্ণ মর্যাদা দিতে না পারলে সমাজে নারী-পুরুষের পূর্ণ সম-অধিকার নিশ্চিত করা যাবে না। আর নারীকে বাদ দিয়ে দেশ সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের অভীষ্টে লক্ষে পৌঁছাতে পারবে না। নারী ও পুরুষ যখন সম-তালে সম-ভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাঁটবে তখনই দেশ এগিয়ে যেতে পারবে। পৌঁছাবে তার অভীষ্ট লক্ষে।