নাসিমুন আরা হক মিনু। বীর মুক্তিযোদ্ধা। সাংবাদিক। রাজনীতিক। বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি। নারী আন্দোলনের এই নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্কুল জীবনের বন্ধু। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে এইচএসসি পর্যন্ত সহপাঠী ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ব্যাচমেট ছিলেন তারা। প্রধানমন্ত্রীর ৭৫তম জন্মদিন উপলক্ষে সহপাঠীকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন মহান একাত্তরের গেরিলা বাহিনীর এই যোদ্ধা। তার ভাষায়- আমি আজিমপুর গার্লস স্কুলে ভর্তি হই ক্লাস ফোরে। আর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভর্তি হয়েছিলেন ক্লাস সিক্সে এসে। তার আগে শেখ হাসিনা ছিলেন নারী শিক্ষা মন্দিরে আর আমি ছিলাম সিদ্ধেশ্বরী স্কুলে। আজিমপুর গার্লস স্কুল থেকেই আমরা একসঙ্গে এসএসসি পাস করেছি। পুরো সময়টা আমাদের একসঙ্গে কেটেছে। স্কুল জীবনটা অত্যন্ত আনন্দে কেটেছে আমাদের। বর্ণিল বাল্যজীবনে রয়েছে অত্যন্ত মজার মজার স্মৃতি। এটি আমাদের অত্যন্ত গর্বের যে, আমাদের স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী, আমাদের ছেলেবেলার সাথী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের চার বারের প্রধানমন্ত্রী। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের বিষয়। আমরা যারা বন্ধুরা রয়েছি প্রত্যেকে অত্যন্ত গর্ববোধ করি। দেশে এবং দেশের বাইরে যারা রয়েছি আমরা যখন একসঙ্গে হই তখন আমরা সবাই খুব আনন্দিত হই এবং শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়টি নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি এবং শিক্ষা জীবনের স্মৃতিচারণ করি।
আজো হাজারো স্মৃতির সঙ্গে ভিড় করে আমার স্কুল আজিমপুর স্কুল (বর্তমানে আজিমপুর গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুল এন্ড কলেজ) ও স্কুলের বন্ধুদের স্মৃতি। স্কুল কাছে হওয়ায় আমরা কখনো দলবেঁধে, কখনো একা হেঁটেই স্কুলে চলে যেতাম। স্কুলের সামনে বিশাল মাঠ। সেটা ছিল আমাদের আকর্ষণ। অবশ্য আজিমপুরে সব বাড়ির সামনেই ছিল বড় বড় মাঠ। স্কুলের দিনগুলো আমাদের কেটেছে পড়াশোনার পাশাপাশি গল্পের বই পড়ে, আড্ডা দিয়ে আর দুষ্টুমি করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছোটবেলায় খুব দুরন্ত ছিলেন। খুব উচ্ছল ছিলেন। খুব মিশুক ছিলেন। আর ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। টিফিনের সময় স্কুলের মাঠে বসে দল বেঁধে আড্ডা দেয়া ছিল আমাদের কাজ।
স্কুল জীবন থেকেই আমরা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম। আমার বোনেরা ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। অন্যদিকে শেখ হাসিনাও পারিবারিকভাবেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ছাত্রজীবন থেকেই নেতৃত্ব দিতে পছন্দ করতেন শেখ হাসিনা। কাউকে ভয় পেতেন না। স্কুল জীবনের রাজনীতির স্মরণীয় ঘটনা, যা আজো আমাকে নাড়া দেয়, তা হলো- ’৬২ সালে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ডাকে আমরা একদিন স্কুল থেকে বেরিয়ে মিছিলে চলে গিয়েছিলাম। ১৯৬৪ সালে আমাদের ওপর দায়িত্ব পড়েছিল স্কুলে ধর্মঘট করানোর ও পিকেটিং করার। আমরা স্কুলের সামনে পিকেটিং করেছিলাম। ছাত্রীদের বলেছিলাম আজ স্কুলে ধর্মঘট, তোমরা ফিরে যাও। ছাত্রীরা অবশ্য আমাদের কথা শোনেনি। আমরা সফল হইনি। তবে স্কুল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি। শেখ হাসিনা, আমি নাসিমুন আরা হক (মিনু), সুলতানা কামাল (লুলু), কাজল, হোসনে আরা বেগম (হেলেন)-সহ আমাদের মোট ১০ জনকে স্কুল কর্তৃপক্ষ শোকজ করেছিল। বাকিদের সবার নাম এখন আর মনে নেই।
আরেকটি বিষয় না বললেই নয়। শেখ হাসিনা ছোট বেলা থেকেই যা বিশ্বাস করতেন, তাই করতেন। সামরিক শাসক আইয়ুব খান দেশে মৌলিক গণতন্ত্র চালু করেছিল। আমাদের ‘সমাজপাঠ’ নামে একটি বইতে এসব পড়তে হতো। ক্লাস নাইনে সমাজপাঠ পরীক্ষার খাতায় প্রশ্নের উত্তর লিখতে গিয়ে হাসিনা ‘মৌলিক গণতন্ত্রে’র কঠোর সমালোচনা করে অনেক কিছু লিখে দিয়েছিলেন। হাসিনা যে খুবই দৃঢ়চেতা ছিলেন এটা তারই প্রমাণ। স্কুল থেকে খবর পেয়ে পরে তার গৃহশিক্ষককে এসে স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলতে হয়েছিল।
শেখ হাসিনা অত্যন্ত বন্ধু বৎসল ছিলেন। ১৯৬৫ সালে এসএসসি পরীক্ষার ফর্ম পূরণ প্রভৃতি কাজে একদিন স্কুলে গিয়েছি। সে সময় শেখ হাসিনা হঠাৎ বললেন- চল্, সবাই আমাদের বাড়িতে যাই। তার ভেতরে এমন স্বতঃস্ফূর্ততা ও আন্তরিকতা ছিল। আমরা সাতজন- হাসি, বেবী, হেলেন, বুড়ি, মর্জিনা ও আমি শেখ হাসিনার সঙ্গে তাদের বাড়ি গেলাম। ৩২ নম্বরে। দুপুরে সেখানে ভাত খেলাম। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব আমাদের পরিবেশন করে খাওয়ালেন। শেখ রাসেল তখন ছোট্ট শিশু। বিছানায় শোয়া ছিল। সেদিন আমরা অনেক আড্ডা দিলাম, ছাদে ও বাগানে বেড়ালাম। ছাদে হাসিনা তার কাকার ক্যামেরায় আমাদের ছবি তুললেন। সে ছবি আমার কাছে এখনো আছে।
এসএসসির পর আমাদের স্কুলপর্ব শেষ হলো। আমরা ভর্তি হলাম বকশীবাজারে গভর্নমেন্ট ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজে (বর্তমান বদরুন্নেসা কলেজ)। এখানে শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেন। আমি ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে। আমরা পুরোপুরি সক্রিয়ভাবে জড়িত হয়ে পড়লাম। তখন ছিল আইয়ুববিরোধী তথা সামরিক শাসনবিরোধী উত্তাল ছাত্র আন্দোলনের সময়। আমি কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সাধারণ সম্পাদক (১৯৬৫-৬৬) নির্বাচিত হই। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ছাত্রলীগের সাঈদা গাফফার। তখন কলেজ ছাত্র ইউনিয়ন খুবই শক্তিশালী ছিল। পরের বছর ১৯৬৬ সাল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা ঘোষণা করেছেন। ৬ দফার পক্ষে সারাদেশে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। কলেজ ছাত্রী সংসদ নির্বাচনে সহসভানেত্রী পদে শেখ হাসিনা নির্বাচন করেন ও বিপুল ভোটে জয়ী হন। হাসিনা ছিলেন অত্যন্ত মিশুক স্বভাবের এবং অত্যন্ত জনপ্রিয়। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল আমাদের শামসুন্নাহার। শেখ হাসিনা দৃঢ়তা ও সাহসিকতার সঙ্গে সহসভানেত্রী হিসেবে ছাত্রী সংসদের কার্যক্রম পরিচালনায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আমাদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো ছিল সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রের জন্য ছাত্রদের সংগ্রামে মুখর।
কলেজ জীবন পেরিয়ে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে আমি ভর্তি হলাম রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আর শেখ হাসিনা বাংলায়। দেখা হতো প্রায়ই। বন্ধুত্ব ছিল আগের মতোই। এখনো, এত বছর পর যখন যেখানেই দেখা হয়, আমরা যেন ফিরে যাই সেই স্কুল জীবনে, আমাদের সেই প্রিয় আজিমপুর গার্লস স্কুলে।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার অনেক অর্জন। অনেক সাফল্য। সন্তানের ফরমে বাবার নামের পাশে মায়ের নাম অন্তর্ভুক্তি করা, মেয়েদের জন্য শিক্ষাবৃত্তি চালু ও অনেক সামাজিক সূচকে ভারত ও পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু, বিস্ময়কর অর্থনৈতিক উন্নয়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন। অর্জন অনেক তবে আরো অনেক পথ হাঁটতে হবে।
প্রিয় সহপাঠী, প্রিয় প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনে তাকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। তিনি যেন তার স্বপ্নের পথ পাড়ি দিয়ে সত্যিকারের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে পারেন- সতত এই শুভকামনা করি।