ডক্টর আফতাব খান
(সিনিয়ার কনসালট্যান্ট ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট, অ্যাপোলো)
হার্টের কোনও বিশ্রাম নেই। হার্টের সঙ্গে কোনও রকম আপস করা চলে না জীবনের স্বার্থেই। আর এই জীবনের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে জীবনযাত্রাও। তার মান যত উন্নত হবে, জীবনও ততই সুন্দর হবে। শুধুই রোজগার ও আনন্দ করতে গিয়ে যদি লাইফস্টাইলের মান নেমে যায়, তবে সেই আনন্দও অচিরেই দুঃখে পরিণত হতে পারে। এ নিয়েবিস্তারিত আলোচনায় ডক্টর আফতাব খান।
কোনও মানুষ যখন জন্মায়, ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে তার হার্ট কাজ করতে শুরু করে। বলা ভাল, তারও আগে থেকে কাজ করতে শুরু করে। সেই যে শুরু, শরীরের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এই অঙ্গের বিশ্রাম নেই। শরীরের অন্য সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই কোনও না কোনও সময় থামে, রেস্ট পায়, সে ঘুমের সময় হোক বা বিশ্রামের সময়। কিন্তু হার্টের ছুটি নেই। তাই এই নিরন্তর ছুটে চলা অঙ্গটিও ততটাই গুরুত্ব দাবি করে।
অশুদ্ধি জমছে ধমনীর অন্দরে
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানবশরীরের বয়স যত বাড়ে, সারা শরীরেই ধমনীগুলি একটু অনমনীয় হতে শুরু করে। হার্টের ধমনীও ব্যতিক্রম নয়। এটা হতে শুরু করলে রক্তচাপ বাড়ে স্বাভাবিক ভাবেই। ধমনী মানে তো রক্তের পাইপলাইন বই নয়। কোনও সাধারণ পাইপলাইন শক্ত হয়ে গেলে সেখান দিয়ে জল যেতে অসুবিধা হয়। হার্টেও ঠিক তাই, স্টিফ হয়ে যাওয়া ধমনী দিয়ে রক্ত বইতে অসুবিধা হয়। চাপ বাড়ে হার্টের ভিতরে।
তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটু হলেও স্টিফ হওয়া এড়ানো না গেলেও, সমস্যা আরও একটা আছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হার্টের ধমনী দিয়ে প্রতিমুহূর্ত রক্ত চলাচল করতে করতে ধমনীর ভেতরের গায়ে একটা নোংরা জমতে থাকে। অশুদ্ধি জমতে থাকে। একে বলা হয় ‘আথেরোস্ক্লেরোটিক প্ল্যাক’। আমি বলব, একে রুখতে হবে গোড়া থেকে। গোড়া মানে একেবারে ছোটবেলা।
মোটাসোটা মানেই সুস্বাস্থ্য নয়
বাচ্চা যদি মোটাসোটা হয়, আমরা বলি সে সুস্বাস্থ্যবান। আবার বাচ্চার শরীরের ওজন কম হলেই দাগিয়ে দিই অপুষ্ট, রোগা, রুগ্ন বলে। এটা ঠিক নয়। শৈশবের পর থেকে বাচ্চারা যখন স্বাভাবিক খাবারদাবার খেতে শুরু করে, তখন বাচ্চাদের শরীরের যে ফ্যাট, যেটা মূলত জাঙ্ক ফুড খেয়ে বা পরিশ্রম কম করে জমে, তা কখনওই ‘সুস্বাস্থ্য’-র চিহ্নক নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, ছোটবেলা থেকে এই খারাপ ফ্যাট শরীরে জমতে থাকা মানে কিন্তু হার্টের ভেতরের ধমনীর গায়েও অশুদ্ধি বা প্ল্যাক জমতে থাকা, যা বয়সকালে বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
এখন এই ময়লা জমা যদি কম পরিমাণে হয়, তাহলে তা ওষুধ দিয়ে কমিয়ে ফেলা যায় একটা সময়ে গিয়ে। কিন্তু যদি বেশি হয়ে যায়, ব্লকেজে পরিণত হয়, তখন তা অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করে সরাতে হয়। আমাদের জেনে রাখতে হবে, এই যে ছোটবেলা থেকে ময়লা জমতে শুরু করছে, সেটাই কিন্তু ভবিষ্যতের ব্লকেজের সূচনা ঘটাচ্ছে। এই শুরুটাকেই থামাতে হবে। কারণ আমি বলব, রোগ হওয়ার পরে নয়, রোগ হওয়ার আগে থেকেই নিজের হার্টের যত্ন নিতে হবে।
বয়স কেবলই সংখ্যা নয় কিন্তু
বাচ্চাদের খাওয়া নিয়েই আলাদা সেন্টিমেন্ট রয়েছে বহু পরিবারে। তাদের খাওয়ার মান বা পরিমাণ নিয়ে কথা বলাও যেন বারণ। কয়েক বছর আগেই, বাচ্চারা যাই খাক না কেন, দিনের নির্দিষ্ট সময়ে ঘাম ঝরিয়ে খেলাধুলো করত। এখন সে উপায় এবং সুযোগও বহু ক্ষেত্রেই নেই। ফলে আরও বেশি করে দেখা দরকার, তাদের খাদ্যাভ্যাসের কারণে যাতে হার্টের ক্ষতি না হয়ে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমরা অনেকেই করি তার ঠিক উল্টো। বাচ্চা ভাল কিছু করলে বা পারলে তাকে পিৎজা খাওয়ানো হয়। চিপস-কোল্ডড্রিঙ্ক যেন শহরের বাচ্চাদের ফুড হ্যাবিটে নিউ নর্মাল হয়ে গেছে আজকালকার দিনে। অনেক বাবা-মাই বলেন, আমার বাচ্চা তো ভাত-মুড়ি খায় না, বিরিয়ানি খায়।
ছোটবেলায় হয়তো এগুলো কোনও প্রভাব ফেলবে না চোখে পড়ার মতো। কিন্তু এটা আমাদের জানতে হবে, নিয়মিত এটা ঘটে যাওয়া মানে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তার হার্টের সক্ষমতা কমিয়ে দেওয়া। এখন যা হচ্ছে হোক, পরে অসুখ হলে দেখা যাবে—এই মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে। একবার সমস্যা হয়ে গেলে তখন অনেক কিছুই আর ফেরানো যায় না। আর জীবনযাত্রার বদলও ৩০-৪০ বছর বয়সে পৌঁছে ঘটানো যায় না। বয়সটা একটা সংখ্যা, ঠিকই, কিন্তু সেই সংখ্যাটা যত বাড়ে, বাধাও তত বেশি হয় শরীরকে রোগমুক্ত রাখার জন্য।
পিৎজা-পেস্ট্রি যতই প্রিয় হোক, শরীরের জন্য অপ্রিয়ই
আমি তো বলব এখন যে দ্রুত গতির জীবন, খাদ্যাভ্যাসের যে অবনমন, শারীরিক পরিশ্রমের যে শূন্যতা, এ নিয়ে বাচ্চদের বাবা-মায়েদের তো বটেই, বাচ্চাদেরও সরাসরি সচেতন করা উচিত। হয়তো বাচ্চাটি এসব শুনে বিষয়টি বুঝতে পারবে না, কিছু করতেও পারবে না। কিন্তু জাঙ্কফুড খেও না, রোজ খেলাধুলো করো—এইটা বোঝানো খুব জরুরি।বাবা-মায়েদেরও বোঝাতে হবে, মাসে একদিন-দুদিনের বেশি বাচ্চাকে জাঙ্কফুড খাওয়ানো যাবে না। পিৎজা, পেস্ট্রি, ঠান্ডা-মিষ্টি পানীয় বাচ্চার যতই প্রিয় হোক, তা বেশি পরিমাণে খেলে বাচ্চার শরীরের জন্যই অপ্রিয়। কিশোর-কিশোরীদেরও স্কুলস্তর থেকে হার্ট নিয়ে সচেতন করা জরুরি।
হার্ট অ্যাটাকের বয়স কমছে
পরিসংখ্যান বলছে, ভারতবর্ষে হৃদরোগের সংখ্যা যত বাড়ছে, তেমনি তার বয়সও কমছে। চল্লিশের আগে, এমনকি ৩০ বছর বয়সেও কোনও রোগ-অসুখ ছাড়া হার্ট অ্যাটাক এখন আর মোটেও বিরল নয়। শুধু তাই নয়, এই বিপদটা ক্রমবর্ধমান। আজকের ছোটরা আগামী প্রজন্মে পৌঁছে অনেক বেশি সংখ্যায় আক্রান্ত হতে পারে হৃদরোগে। সারা বিশ্বে যেখানে হৃদরোগ শুরু হওয়ার গড় বয়স ৬৫, আমাদের দেশে অর্থাৎ ভারতে এই বয়সটা নেমে এসেছে চল্লিশে।
অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের শরীরের ঘড়ি বদলে যায় চাকরির স্বার্থে। নাইট ডিউটি বা অড টাইমে ডিউটি খুবই কমন। উপায় নেই, রোজগারের স্বার্থে করতেই হবে। তবে রোজগার করে যদি সুস্থ না থাকা যায়, তবে তো তা কখনওই কাম্য নয়। আমাদের রোজগার কম থাকলে আমরা হাঁটি, সাইকেলে চড়ি। সুস্থ থাকি। অথচ রোজগার বেশি হলে গাড়ি চড়ি, যা কায়িক শ্রম কমিয়ে দেয়। ভবিষ্যতে অসুস্থতা ডেকে আনে। এক্ষেত্রে গোটা জীবনচক্র তো শরীরের সুস্থতার সঙ্গে বিরোধিতা করছে। ফলে আমাদের রোজগারের পাশাপাশি নিজের স্বাস্থ্য নিয়েও ভাবতে হবেই।
শরীরের নাম মহাশয়, তবে যা সওয়াবে তা সয় না
এই প্রসঙ্গে আমি আরও একটা কথা বলব, ধূমপান এবং মদ্যপানকে অভ্যাসে পরিণত করা চলবে না। আমরা অনেক ক্ষেত্রেই ডায়েট ও এক্সারসাইজ একেবারে ঠিক ভাবে করতে পারি না নানা কারণে। কিন্তু এই ধূমপান বা মদ্যপান কিন্তু বন্ধ করতে পারি। এটা একটা অন্যতম ‘প্রিভেন্টিভ মেজ়ার’। তবে এর জন্য ব্যক্তি-সচেতনতার চেয়ে সামাজিক সচেতনতাও জরুরি।
হাঁটাচলা করুন, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন। ডায়াবেটিস হতে দেবেন না, শরীরের অর্ধেক সমস্যা বাড়ার ঝুঁকি এমনিতেই কমে যাবে। শরীরের মাথা থেকে পা পর্যন্ত প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে সমস্যা ডেকে আনে ডায়াবেটিস। হার্টের তো বটেই। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও সুস্থ ও সুন্দর লাইফস্টাইল খুব জরুরি। কারণ শরীরের নাম মহাশয় হলেও, সব কিছু সয় না। এই রক্তচাপও হার্টের একটা বড় শত্রু। হার্টের এজিং আমরা এড়াতে পারব না। বয়স তো হবেই। কিন্তু এই বয়স হওয়ার গতি বেড়ে যাওয়াটাও কাম্য নয়।