কক্সবাজার: রাতের ভোটের নির্বাচন কমিশন সচিব ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ শেষ পর্যন্ত দুর্নীতির জালে আটকা পড়েছেন।
তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কক্সবাজারে ৩ লাখ কোটি টাকার মেগা প্রকল্পে দুর্নীতির সাথে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে।
হেলালুদ্দীন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর দিনের ভোট রাতে করার নির্বাচন কমিশন সচিব হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
গত ৫ আগষ্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও স্বৈরাচার দেশ থেকে পলায়নের পর ২৩ অক্টোবর তিনি পুলিশের হাতে ধরা পড়ে বর্তমানে জেল হাজতে রয়েছেন।
দুদক সুত্র জানিয়েছে, গত ১৫ বছরে কক্সবাজারে ৩ লাখ কোটি টাকা ব্যয়ে নেয়া ৭৫টি মেগা প্রকল্পের মধ্যে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ, ভুমি অধিগ্রহণ, রোহিঙ্গাদের ডাটাবেজ তৈরি, রেল লাইন প্রকল্পের মতো বিশাল প্রকল্পে এই দূর্নীতি হয়েছে। দুদকের অনুসন্ধানে তার বিরুদ্ধে ভূমি অধিগ্রহণসহ ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ পেয়েছে।
দুদকের কক্সবাজার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার বলেন, গত ১৭ মার্চ দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে কক্সবাজার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়। কমিশনের পক্ষে উপ-পরিচালক (অনু. ও তদন্ত) ওমর ফারুক স্বাক্ষরিত দেওয়া এই চিঠিতে বলা হয়েছে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীনের বিরুদ্ধে কক্সবাজারে মেগা প্রকল্পে বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগ অনুসন্ধান করে কমিশনে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে।
হেলালুদ্দীনের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধানের বিষয়টি নিশ্চিত করে গুলশান আনোয়ার বলেন, দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই আমরা অনুসন্ধান কাজ শুরু করেছি। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে কমিশনে প্রতিবেদন জমা দিতে পারব।
দুদক সুত্র জানিয়েছে, তার বিরুদ্ধে তিন প্রকল্প থেকে ৮০ কোটি টাকা লোপাট, জালিয়াতি করে রোহিঙ্গাদের এনআইডি ও পাসপোর্ট প্রদান, ৫৫ হাজার ৩১০ জনকে অবৈধভাবে ভোটার করাসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে।
বিগত পতিত সরকারের আস্থাভাজন এবং ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে রাতের ভোটের কারিগর হিসেবে পরিচিত নির্বাচন কমিশনের সাবেক সচিব হেলালুদ্দীনের বাড়ি কক্সবাজারে। অবসরের পর তিনি আওয়ামী লীগের নমিনেশনে কক্সবাজার-রামু-ঈদগাহ আসন থেকে জাতীয় নির্বাচন করারও প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। সাবেক এই সচিব কক্সবাজারের তৎকালীন জেলা প্রশাসকসহ প্রশাসনের কর্মকর্তা, পুলিশ সুপার ও মেয়রের সঙ্গে যোগসাজশে দুর্নীতির হাট বসিয়েছিলেন কক্সবাজার সদরের ঈদগাহ এলাকায়।
সাবেক দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন ২০২১ সালের ৩০ জুন কমিশনে জমা দেওয়া ৬২০ পৃষ্ঠার এক অনুসন্ধান রিপোর্টে এই দুর্নীতির বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেছিল। তবুও হেলালের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। উল্টো হেলালুদ্দীন ও তার চক্রের সদস্যরা প্রভাব খাটিয়ে চাকরিচ্যুত করে শরীফ উদ্দিনকে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শেষ রক্ষা হয়নি হেলালুদ্দীনের। হত্যা ও বিস্ফোরক মামলার আসামি হয়ে বর্তমানে জেল হাজতে রয়েছেন হেলালুদ্দীন।
২০২০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার পৌরসভার পানি শোধনাগার প্রকল্পটি উদ্বোধন করেন সেই সময়কার স্থানীয় সরকারের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ। ওই দিন প্রায় ৮ কোটি টাকার চেক স্থানীয় সার্কিট হাউসে বসে তার সিন্ডিকেটে থাকা কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমানকে প্রদান করেন তিনি। ওই ৮ কোটি টাকার একটি অংশ মেয়রের কাছ থেকে তার স্ত্রীর নামে ঘুষ নেন বলে অভিযোগ পান দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা। দুদক কর্তৃক নো-ডেবিট নির্দেশনা সত্বেও তার নির্দেশে ৮ কোটি টাকা ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক কক্সবাজার শাখা দুদকের চিঠি ছাড়াই প্রদান করেন।
অভিযোগ রয়েছে, হেলালের ভিজিটিং কার্ড দিয়ে এল এ শাখায় (ভুমি অধিগ্রহণ শাখা) ফাইল লিপিবদ্ধ করত দালাল চক্র। সাবেক এই সিনিয়র সচিবের লিখিত সুপারিশে কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের ভুয়া এনআইডি কার্ড তৈরি করে টাকা উত্তোলনের একটি অভিযোগ দুদক কক্সবাজার কার্যালয় তদন্ত করলেও তার চাপে উল্টো রিপোর্ট দেওয়া হয়। এছাড়াও ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে হেলালের ভাইয়েরা রোহিঙ্গাদের এনআইডি ও পাসপোর্ট জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ ওঠে। ৫৫ হাজার ৩১০ জন অবৈধ ভোটার হওয়ার ঘটনায় নাম আসে হেলাল ও তার ভাইদের।
দুদক জানিয়েছে, ক্ষমতার দাপটে এতদিন ধামাচাপা পড়েছিল কক্সবাজারে ৮০ কোটি টাকার দুর্নীতির তদন্ত। এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে আছে এর সঙ্গে যুক্ত হোতারা। তদন্ত প্রতিবেদনে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল, তাদের বেশিরভাগই রাঘব বোয়াল। এদের মধ্যে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ রাজনীতিবিদ রয়েছেন সাতজন, চেয়ারম্যান দু’জন, জেলা প্রশাসকসহ প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা ২০ জন, পুলিশ সুপারসহ পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তা চারজন, সার্ভেয়ার রয়েছেন ২৩ জন, কানুনগো সাতজন, তহশীলদার ছয়জন, সাব-রেজিস্ট্রার দু’জন, অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা ছয়জন ও ব্যাংকের ম্যানেজার রয়েছেন তিনজন। প্রভাবশালী এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করতে তদন্ত প্রতিবেদনে সুপারিশ করেছিলেন চাকরিচ্যুত দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন।
সূত্র বাসস