Home Uncategorized ১৯৭১ সালে নিজহাতে অর্ধেক পা কেটে বাদ দেন তরুণ মেজর কার্ডোজো

১৯৭১ সালে নিজহাতে অর্ধেক পা কেটে বাদ দেন তরুণ মেজর কার্ডোজো

ইয়ান কার্ডোজো

৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১। তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ’র একটা জরুরি টেলিফোন আসে ভারতের ইস্টার্ন আর্মির চিফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জ্যাক জেকবের কাছে। ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে এয়ারফিল্ডগুলোতে ততক্ষণে বোমাবর্ষণ শুরু করেছে পাক সেনা। হামলা হয়েছে আগ্রা সহ ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের বেশ কয়েকটা জায়গায়। ৭১ সালের সেই যুদ্ধে পাক সেনার সঙ্গে লড়াইয়ে পূর্ববাংলার মুক্তি-বাহিনীর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন ইন্দিরা গান্ধী। উত্তর ভারতে পাক সেনার বোমাবর্ষণের জবাবে ভারতীয় সেনা সরাসরি নেমে পড়ে যুদ্ধে। যুদ্ধে ৫নং গোর্খা রাইফেলস সামলানোর ভার পরেছিল টগবগে এক তরুণ মেজরের উপর, যার অদম্য জেদের কাছে মাথা ঝুঁকিয়েছিল সমস্ত প্রতিবন্ধকতা। যুদ্ধ তাঁর পা কেড়ে নিলেও জীবন তাঁকে থামাতে পারেনি। হ্যাঁ! তিনিই ভারতের প্রথম প্রতিবন্ধী অফিসার মেজর জেনারেল ইয়ান কার্ডোজো।

১৯৩৭ সালের ৭ ই অগষ্ট তৎকালীন বম্বে শহরে জন্মেছিলেন ইয়ান কার্ডোজো। প্রথমে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল আর তারপর কলেজ থেকে পাশ করার পর তিনি ১৯৫৪ সালে যোগ দেন ‘জয়েন্ট সার্ভিস উইং’-এ। যা পরবর্তীতে ‘ন্যাশানাল ডিফেন্স আকাদেমি’ নামে পরিচিত।  মেধা আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি-সম্পন্ন ইয়ান ছিলেন সর্বকালের সেরা ‘অলরাউন্ডার ক্যাডেট’। এই বিভাগে স্বর্ণপদক এবং ‘মেধা’ বিভাগে প্রথম স্থান অর্জনের জন্য পেয়েছিলেন রৌপ্যপদক। ন্যাশনাল ডিফেন্স আকাদেমি থেকে ট্রেনিং সম্পূর্ণ করার পর ১৯৫৮ সালে তিনি ‘ইন্ডিয়ান মিলিটারি আকাদেমি’তে প্রথম ব্যাটালিয়ন হিসেবে গোর্খা রাইফেলসে যোগ দেন।

১৯৭১ সালে পাকিস্তান যখন ভারতে হামলা করে ৫নং গোর্খা রাইফেলসকে দায়িত্ব দেওয়া হয় পূর্ব পাকিস্তানকে সামলানোর এবং দখল করার। যুদ্ধ শুরু হবার দ্বিতীয় দিনেই গোর্খা রাইফেলসের নেতৃত্বে থাকা অফিসারের মৃত্যু হয় পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর গুলিতে। এই দুর্ঘটনার পর বাহিনীর ভার এসে পরে তরুণ মেজর ইয়ান কার্ডোজোর উপর। কার্ডোজো তখন দিল্লিতে কর্তব্যরত। একদিনের নোটিশে স্ত্রী আর তিন সন্তান’কে রেখে তিনি চলে আসেন রণক্ষেত্রে, গোর্খা রাইফেলসকে নেতৃত্ব দিতে।

১৩ দিনের সেই যুদ্ধে মাত্র ৪৮০ জন সেনাকে নিয়ে তিনি প্রাণপণ লড়াই চালিয়ে গেছিলেন ১৫০০ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। অতর্কিত আক্রমণ হওয়ায় যথেষ্ট পরিমান খাদ্যপানীয় মজুত করা সম্ভব হয়নি। এককণা খাবার তো দূরস্থান, এমনকি জলও ফুরিয়ে যায় একসময়। সেই অবস্থাতেই দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে চলেছিল গোর্খা রাইফেলসের জওয়ানরা। যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র এবং গুলিও ফুরিয়ে আসছিল। এভাবে টানা ৯ দিন ধরে যুদ্ধের পর যখন গোলাবারুদ সবই শেষের দিকে, তখন মরিয়া জওয়ানেরা জোটবদ্ধ হয়ে কুকরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উপর। ইয়ান কার্ডোজোর নেতৃত্বে প্রায় গেরিলা কায়দায় অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পাকিস্তানি সৈন্যদের আয়ত্তে আনার চেষ্টা চালাতে থাকে। ভারতীয় সেনা যখন সিলেট প্রায় দখল করে ফেলেছে সেই সময়েই ঘটে যায় এক বিরাট অঘটন। মেজর ইয়ান কার্ডোজোর পা পড়ে যায় এক লুকোনো ল্যান্ড মাইনে। বিস্ফোরণে ভয়ংকর-রকমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাঁর পা। তীব্র যন্ত্রণার মধ্যেও তিনি বুঝেছিলেন হার মানলে চলবে না। যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।

ইয়ান কার্ডোজো’কে যখন ডাক্তারদের ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়, তখন তীব্র যন্ত্রণায় অসাড় হয়ে গেছে তাঁর নিম্নাঙ্গ। পায়ের হাঁটুর নীচ থেকে গোড়ালি অব্দি মারাত্মকভাবে জখম। রক্তপাত বন্ধ হওয়ার নাম নেই। এ অবস্থায় তিনি বুঝেছিলেন এই জখম পা বাদ দেওয়া ছাড়া কোনও রাস্তা নেই, নাহলে তা ধীরে ধীরে পচতে শুরু করবে আর সংক্রমণ ছড়িয়ে যাবে সারা শরীরে। ডাক্তার এলে তিনি ডাক্তারকে মরফিন দিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু মরফিন বা পেথিডিন জাতীয় কোনো ওষুধই ছিল না সেই দুঃসময়ে। কারণ ওষুধ যেখানে মজুত রাখা হয়েছিল, বোমাবর্ষণে নষ্ট হয়ে গেছে সেই তাঁবু। কোনও উপায় না দেখে তিনি ডাক্তারকে নির্দেশ দেন, জ্ঞান থাকা অবস্থাতেই অপারেশন করে ঐ জখমি পা হাঁটুর নীচ থেকে বাদ দিতে।

এত তাড়াতাড়ি এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া ডাক্তারের পক্ষেও অসম্ভব ছিল। তাছাড়া পা বাদ দেবার মতো প্রয়োজনীয় উপকরণও ছিলনা ডাক্তারদের হাতে। ফলে তক্ষুনি অপারেশন করার ঝুঁকি নিতে রাজি হননি তাঁরা। আর এরপরই ঘটে যায় সেই হাড়হিম করা ঘটনা। ইয়ান তাঁর পাশে থাকা অফিসারকে নির্দেশ দেন নিজের কুকরিটা নিয়ে আসার আর আদেশ দেন হাঁটুর নীচ থেকে সেই আহত পা কুকরি দিয়ে কেটে বাদ দেবার জন্য।

এমন ভয়ংকর আদেশ শুনে হকচকিয়ে যান কর্তব্যরত অফিসার। ভয়ে সরে আসেন দু পা। এও কি সম্ভব! সহকর্মী অফিসারকে কোনওভাবেই রাজি করাতে না পেরে ইয়ান নিজের হাতেই তুলে নেন কুকরি। তারপর নিজেই সেই ছুরি দিয়ে ঘসে ঘসে হাঁটুর নীচ থেকে কেটে ফেলেন সেই ছিন্নবিচ্ছিন্ন পা, তারপর কর্তব্যরত অফিসারের হাতে সেটা ধরিয়ে দিয়ে মাটি-চাপা দিয়ে আসতে বলেন। অসম্ভব যন্ত্রণায় তখন কুঁকড়ে গেছে ইয়ানের শরীর। কথা ক’টি বলেই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েন তিনি।

সংজ্ঞাহীন অবস্থাতেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় ইয়ান কার্ডোজোকে। শেষ কয়েকদিন তিনি সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে থাকতে পারেননি বটে কিন্তু ততদিনে যুদ্ধ জয়ের দামামা বাজিয়ে দিয়ে গেছিলেন এই তরুণ গোর্খা মেজর। এরপর মাত্র তেরো দিনের লড়াইয়ে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয় পাক সেনা। ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যায় পূর্ব পাকিস্তান। জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র।ইয়ান কার্ডোজোকে প্রথমে মিলিটারি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। হাঁটুর নীচ থেকে কাটা অংশে যাতে পচন না ধরে তার দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা চলতে থাকে। টানা অনেকদিন চিকিৎসার পর আস্তে আস্তে ঘা শুকিয়ে গেলে ওয়াকার নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করেন তিনি। কিন্তু একটা পা এভাবে অকেজো থাকলে তো চলবেনা! কারণ ততদিনে আবার মনে মনে যুদ্ধে যাবার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন ইয়ান। তাই কৃত্রিম পা লাগানোর জন্য তিনি চলে এলেন পুনেতে।

পুনের ‘আর্টিফিশিয়াল লিম্ব সেন্টারে কৃত্রিম পা বসানো হয় তাঁর। শুধু কৃত্রিম পা বসালেই তো হবেনা, সেই পায়ে স্বাভাবিক চলাফেরা করাটাই এবার মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালো ইয়ানের। কৃত্রিম পা নিয়ে শুরু হল নতুন করে শরীরচর্চা। সকালে উঠে নিয়ম করে হাঁটা, পাহাড়ে চড়া, খেলাধুলা সবকিছুই ধীরে ধীরে আয়ত্বে এনে ফেললেন তিনি। ব্যাপারটা খুব সোজাও ছিল না, টানা ৬মাস অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছিল তাঁকে আগের জায়গায় ফিরে যাওয়ার জন্য। নিজেকে তিনি এমনভাবে তৈরি করেছিলেন যে আর পাঁচটা স্বাভাবিক মানুষের হাঁটাচলার সঙ্গে তাঁর হাঁটাচলার কোনও পার্থক্যই রইল না আর।সুস্থ হয়ে ইয়ান কর্ডোজো ফিরে এলেন সেনাবাহিনীতে যোগদান দিতে। কিন্তু সেই সময় সেনাবাহিনীতে কড়া নিয়ম ছিল কর্তব্যরত অফিসারের যদি কোনও কারণে অঙ্গহানি হয় তাহলে তিনি আর কখনও ‘ব্যাটালিয়নের’ অংশ হতে পারবেন না। ‘স্টাফ অফিসার’ হিসেবেই থাকতে হবে তাঁকে। সোজাকথায় তিনি শুধুমাত্র অফিসে বসে পেপারওয়ার্ক করতে পারবেন, আর কিছু নয়। সেই নিয়ম মেনে মেডিকেল টেস্টে ইয়ানকেও বাতিল করে দেন অফিসারেরা। কিন্তু কার্ডোজোর রক্তে বইছে যুদ্ধের নেশা। পা বাদ যাবার পরও নিজেকে এতদিন ধরে তিল তিল করে তৈরি করেছেন সে কি শুধু ‘স্টাফ অফিসার’ হবার জন্য!

কার্ডোজো এবার সরাসরি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বসলেন তৎকালীন অফিসারদের। জিজ্ঞেস করলেন তাঁদের অসুবিধাটা ঠিক কোথায়? কারণ তিনি তো যেকোনও সুস্থসবল দু-পাওয়ালা মানুষের মতোই সক্রিয় বা তাঁদের থেকেও অনেক বেশী সক্রিয়। অফিসারেরাও চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন, যদি তাই হয় তাহলে সেই সুস্থতার প্রমাণ দিতে হবে কার্ডোজোকে। ‘না’ শব্দটা সম্ভবত ছিলই না কার্ডোজোর অভিধানে। হাসিমুখে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন তিনি।

প্রথম পরীক্ষা ছিল মাঠে দৌড়নোর। সেই দৌড়ে তিনি সাত জন অফিসারকে পিছনে ফেলে প্রথম হন। এর পরের পরীক্ষা আরও কঠিন। রক ক্লাইম্বিং হবে তাঁকে। ৪৮০০ ফুটের একটা খাড়া পাহাড়ে কতটা তিনি উঠতে পারেন এই ছিল দেখার। পাহাড়ের উপর একজন অফিসার আগে থেকেই পৌঁছে গেছিলেন হেলিকপ্টারে, তাঁর পাখির চোখ ছিল ইয়ানের দিকেই। বলা বাহুল্য, সেই পরীক্ষাতেও জয়ী হয়ে ফিরলেন ইয়ান।

খানিকটা নয়, পুরো পাহাড়টাকেই সেদিন জয় করেছিলেন তিনি। শুনতে যতটা সহজ লাগছে ততটাও সহজ ছিলনা কাজটা। এক পায়ে উপরের দিকে পাহাড়ের বরফ কাটিয়ে শীর্ষে পৌঁছতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল তাঁকে। পাহাড়ের শীর্ষে যখন তিনি পৌঁছন, বিস্মিত অফিসারের মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছিল না। বিস্ময়ের ঝোঁক সামলে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন “আপনি এখানে এলেন কী করে?” ইয়ানের গলা তখন ইস্পাতের মতো দৃঢ়। উত্তরে বলেছিলেন “পাহাড় বেয়ে”। নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না কর্তব্যরত অফিসার, জিজ্ঞেস করেছিলেন “এতটা পথ! আপনার অসুবিধা হয়নি?”  আরও দৃঢ় হয়েছিল ইয়ান কর্ডোজোর গলা। বলেছিলেন “আমার কোথাও কোনো অসুবিধা হয়নি। আর এই কথাটা আপনি যেমন বুঝলেন তেমন আপনার সিনিয়ার অফিসারদেরও বোঝান, যাতে ভবিষ্যতে তাঁরা আমাকে আর অথর্ব মনে না করেন”।আর দেরি করেননি গ্রাউন্ড অফিসার। ইয়ানের ফাইল চেয়ে পাঠান হয়, দ্রুত ফিল্ডে ফিরিয়ে এনে ‘ব্যাটালিয়ন’ এর দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় ইয়ান কার্ডোজোর উপর। সেই প্রথম জলে চিকচিক করে ওঠে মেজর ব্রিগেডিয়ার (পরবর্তীতে) কর্ডোজোর চোখ। ইতিহাস বলে, তিনিই প্রথম প্রতিবন্ধী অফিসার, অসাধ্যসাধন করে যিনি বদলে দিয়েছিলেন সেনাবাহিনীর এতকালের পুরোনো নিয়ম।

তবে এখানেই থেমে থাকেননি কার্ডোজো, ব্যাটালিয়ন কম্যান্ডো থেকে দলকে সাহসিকতার সাথে চালনা করার জন্য তিনি কিছুদিনের মধ্যেই ব্রিগেডিয়ার কম্যান্ডোর পদ লাভ করেন। অবসর গ্রহণের পরেও, মেজর জেনারেল কার্ডোজো ২০০৫ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত গৌরবের সঙ্গে ভারতের পুনর্বাসন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রচুর বইও লিখেছেন তিনি। তার মধ্যে বেশ কিছু বই আজও বেস্ট সেলার। ৮৪ বছর বয়সে এসে আজও থেমে নেই তিনি। কাজের মধ্যেই যে মানুষের যথার্থ মুক্তি, নিজের সারাজীবন দিয়ে তাই যেন প্রমাণ করে চলেছেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর গর্ব মেজর জেনারেল ইয়ান কর্ডোজো।- দি ওয়াল