Home First Lead ৫৪ হাজার কোটি টাকার ‘মাতারবাড়ী জয়েন্টভেঞ্চার’

৫৪ হাজার কোটি টাকার ‘মাতারবাড়ী জয়েন্টভেঞ্চার’

মাতারবাড়িতে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের কাজ চলছে একযোগে

 

 সালেহ নোমান

মাতারবাড়ি থেকে ফিরে:

কক্সবাজার জেলার দ্বীপ উপজেলা মহেশখালির উত্তরাংশ মাতার বাড়ীতে এখন চলছে প্রায় ৫৪ হাজার কোটি টাকার বিশাল কর্মযজ্ঞ। মূলত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত প্রকল্প, গভীর সমুদ্র বন্দরের প্রথম পর্বের প্রথম অংশ নির্মাণ এবং চট্টগ্রাম কক্সবাজার সড়কের সাথে সংযুক্ত হতে সড়ক অবকাঠামো নির্মিত হবে।

 প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্য জাপানের টোকিও ইলেকট্রিক পাওয়ার সার্ভিস কোম্পানী লিমিটেড টেপেসকো,  জাপানের শীর্ষ স্থানীয় প্রকৌশল পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিপ্পন কোই, বৃটেনের প্রকৌশল পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ফিচটনার ও আষ্ট্রেলিয়ার প্রতিষ্ঠান এসএমইসি। সবার সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে জয়েন্ট ভেঞ্চার ‘মাতারবাড়ী জেভিসি’ ।

 ২০২৫/২৬সালের মধ্যে নির্মিত হবে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প ও গভীর সমুদ্র বন্দরের প্রথম পর্বের প্রথম অংশ। যাতে আপাতত ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৪ হাজার কোটি টাকা।

নির্মাণ কাজে ঠিকাদার হিসেবে আছে জাপানের আরো তিনটি প্রতিষ্ঠান সুমিতোমো কর্পোরেশন, তোশিবা কর্পোরেশন ও আইএইচআই কর্পোরেশন।

 জ্বালানি মন্ত্রণালয়েরে অঙ্গপ্রতিষ্ঠান কোল পাওয়ার জেনারেশান কোম্পানী লিমিটেড সিপিজিসিবিএল মাতারবাড়ী ও ধলঘাটা ইউনিয়নে প্রতিটি ৬০০ মেগাওয়াট উৎপাদনে সক্ষম দুটি আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিযেছে। এ প্রকল্পের আওতায় আমদানীকৃত কয়লা লোড-আনলোড জেটি, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, টাউনশীপ নির্মাণ, স্থানীয় এলাকায় বিদ্যুতায়ন, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে।

ডিপিপি অনুযায়ী  প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ৩৫,৯৮৪ কোটি টাকা। প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ২৮,৯৩৯ কোটি টাকা প্রকল্প সাহায্য হিসাবে জাইকা থেকে এবং অবশিষ্ট ৭০৪৫ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকার ও সিপিজিসিবিএল এর নিজস্ব তহবিল থেকে সংস্থান করা হবে।

 প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা  মাতারবাড়ি ২X৬০০ মেগাওয়াট আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছেন।

২০১৯ সাল নাগাদ এই প্রকল্পের অগ্রগতি ২৬.৬৫% হয়েছে বলে জানিয়েছেন মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম।

কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের পাশাপাশি এগিয়ে চলছে মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের কার্যক্রম। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বিশেষ নৌ-পথ( ব্রেক ওয়াটার) তৈরি করে  কয়লা খালাসের টার্মিনাল নির্মিত হচ্ছে। একই নৌ-পথের সুবিধা কাজে লাগিয়ে সেখানে বড় আকারের জাহাজ ভিড়ানোর জন্য বন্দরের টার্মিনাল নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরে প্রথম পর্বের প্রথম অংশে নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা।  ২০২৬ সালে জাহাজ ভিড়বে এমনটা ধরে ডিপিপি চূড়ান্ত করা হয়েছে। শীঘ্রই ডিপিপি অনুমোদনের জন্য  একনেক’এ পাঠানো হবে।

প্রকল্প কর্মকর্তারা জানিয়েছেন,  বন্দরের অংশে স্রোত প্রতিরোধক, নৌপথ খনন ও প্রশস্তকরণের কাজ কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঠিকাদারের মাধ্যমে করানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। মূলত: কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা নিয়ে আসার জন্য যে চ্যানেল ও টার্মিনাল নির্মিত হচ্ছে তার সাথে আলাদা করে দুটি টার্মিনাল নির্মিত হবে যা গভীর সমুদ্র বন্দর হিসেবে কন্টেইনার ল্যান্ডিং জেটি এবং সব ধরনের পণ্য উঠানামায় সক্ষম মাল্টিপারপাস জেটি নির্মিত হবে।

নৌ-পরিবহণ মন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল জুলফিকার আজিজ গত বুধবার মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ কাজ পরিদর্শন করেন।

নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ গত বুধবার মাতাবরাড়িতে

এ সময় নৌ- পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, “গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের স্বপ্ন এখন বাস্তবায়নের পথে। এক সময়ের কম পরিচিত  মাতারবাড়ী এখন বাংলাদেশের উন্নয়নের অনন্য দৃষ্টান্ত, বিশ্বব্যাপি পরিচিত।”

 প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই দ্বীপে বিদ্যুৎ প্রকল্পের সাথে বন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত দেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের আগে আমরা কেউ এই দ্বীপের নাম জানতামনা, অনেকে জানতোনা, উল্লেখ করেন তিনি।

 খালিদ মাহমুদ আরো বলেন, ‘শীঘ্রই একনেকে গভীর সমুদ্র বন্দরের ডিপিপি অনুমোদন হবে।’

 মাতারবাড়ী বন্দর নির্মাণের প্রাথমিক পরিকল্পনায় প্রথম ধাপে রয়েছে দুটি টার্মিনাল। সাধারণ পণ্যবাহী ও কনটেইনার টার্মিনালে বড় জাহাজ (মাদার ভ্যাসেল) ভিড়তে পারবে, যেটি এখন বাংলাদেশের কোনো বন্দর জেটিতে ভিড়তে পারে না।

দ্বিতীয় ধাপে নির্মিত হবে তিনটি কনটেইনার টার্মিনাল। এভাবে পর্যায়ক্রমে বাড়ানো হবে টার্মিনাল।

প্রথম ধাপে  নির্ধারিত ব্যয়ের ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকার মধ্যে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সাথে সংযুক্তির জন্য সড়ক নির্মাণ  খরচ ধরা হয়েছে আট হাজার কোটি টাকা । প্রথম ধাপের কাজ শেষ হবে ২০২৬ সালে।

মাতারবাড়ী এলাকা পরিদর্শন করে দেখা গেছে, যে দিকে চোখ যায়, কেবল নির্মান কাজ আর কাজ।

শ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশি- বিদেশি সাড়ে চার হাজার মানুষ কাজে করছে। তারমধ্যে এক হাজারের মত আছে বিদেশি প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞ।

মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের জন্য বিশ্বের নামকরা একাধিক সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত  নতুন কনসোটিয়াম ‘মাতার বাড়ী জয়েন্ট ভেনচার।’

জয়েনট ভেঞ্চার মাতারবাড়ী জেভিসি’র হয়ে পুরো নির্মাণ কাজে নেতৃত্বে আছেন অভিজ্ঞ জাপানী প্রকৌশলী সাতোরো ফুজিমাগার। তিনি মাতারবাড়ী আলট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কোল বেইজ পাওয়ার প্লান্টস এর প্রজেক্ট ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করছেন।

 বুধবার সন্ধ্যায় মাতার বাড়ীতে এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে তিনি জানান, ”প্রকল্পের কাজের অগ্রগতিতে আমি সন্তুষ্ট। প্রকল্পটি যথা সময়ে শেষ হওয়ার ব্যাপারে আমি আশাবাদী।”

”এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প, এই প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে নতুন করে সম্পর্ক তৈরী হয়েছে দুই দেশকে আরো বেশি ঘনিষ্ঠ করেছে,” উল্লেখ করেন তিনি।

গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ প্রকল্পের ১২ হাজার কোটি টাকা প্রদান করবে জাপানের একাধিক সংস্থা, যা ২০ বছরে পরিশোধ যোগ্য।