Home অন্যান্য অগ্নিযুগের বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার

অগ্নিযুগের বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার

বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক

গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক। সমস্ত চট্টগ্রাম তখন অগ্নিগর্ভ। উমাতারা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের এক আপাত নিরীহ অংকের শিক্ষক সূর্য সেনের নেতৃত্বে এক অভাবিতপূর্ব মহাবিদ্রোহের সূচনা হয়। সেকালে ব্রিটিশ সরকার তাঁর মাথার দাম ধার্য করেছিল দশ হাজার টাকা৷ সূর্য সেনের বিপ্লবী দলের অন্যতম কমরেড অনন্ত সিং লিখেছেন:
“কে জানতো যে আত্মজিজ্ঞাসায় মগ্ন সেই নিরীহ শিক্ষকের স্থির প্রশান্ত চোখ দুটি একদিন জ্বলে উঠে মাতৃভূমির দ্বিশতাব্দীব্যাপী অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হবে?… কে জানতো সেই শীর্ণ বাহু ও ততোধিক শীর্ণ পদযুগলের অধিকারী একদিন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ রাজশক্তির বৃহত্তম আয়োজনকে ব্যর্থ করে- তার সমস্ত ক্ষমতাকে উপহাস করে বৎসরের পর বৎসর চট্টগ্রামের গ্রামে গ্রামে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলবে?”

মাস্টারদা সূর্য সেন

অতিরুক্তি নয়, এমনটাই ঘটেছিল বাস্তবে। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে আসছে। সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের তরুণ বিপ্লবীরা গোপনে সভা করে ইংরেজ রাজশক্তিকে দেশ থেকে বিতাড়নের স্বপ্ন দেখছেন। ইংরেজ গোয়েন্দাদের চোখে ধুলো দিয়ে ‘সাম্য আশ্রম’ নামে এক গোপন ডেরায় তাঁরা মিলিত হন। সূর্য সেনের সেই স্বপ্নের সারথিরা ছিলেন: অনুরূপ সেন, চারুবিকাশ দত্ত, অম্বিকা চক্রবর্তী, নগেন্দ্রনাথ সেন, গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ, নির্মল সেন, লোকনাথ বল প্রমুখ। জীবিত অবস্থাতেই কিংবদন্তির রহস্যময় নায়ক হয়ে উঠেছিলেন মাস্টারদা সূর্য সেন। তাঁকে একবার চোখে দেখার জন্য, তাঁর সঙ্গে একটিবার সাক্ষাতের জন্য অনেক মানুষের মতোই দিবারাত্রি প্রহর গুনত চট্টগ্রামেরই এক কিশোরী: প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষিকা ঊষাদির কাছ থেকে পাওয়া ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাইয়ের জীবনী পাঠ করে সে তখন মনে মনে অঙ্গীকার করেছে, দেশের মুক্তির জন্য একদিন প্রাণ দেবে। মাস্টারদার নেতৃত্বে সে ঝাঁপিয়ে পড়বে পরাধীন দেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে। ২৯ বছর বয়সে বীরাঙ্গনার মতো ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ করে দেশের জন্য আত্মবিসর্জন দিয়েছিলেন মারাঠি নারী মণিকর্ণিকা তামবে ওরফে ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই। আর মাত্র একুশ বছর বয়সে ভারতের স্বাধীনতার যুদ্ধে প্রথম নারী হিসেবে শহিদ হন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। আজ থেকে নব্বই বছর আগের সেই আগুন-ঝরা দিনটি ছিল ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৩২ সাল।
সহিংস আন্দোলনের কঠিন পথে বিপ্লবীদের জন্য নারীসঙ্গ ছিল নিষিদ্ধ। স্বজনবর্গের অনুরোধের চাপে বিয়ে করলেও সূর্য সেন নিজেও একদিনের জন্য দাম্পত্যজীবন যাপন করেননি। এমন কী ফুলশয্যাও বর্জন করেছিলেন। দলের সদস্যদের প্রতি তাঁর কঠোর নির্দেশ ছিল, মা, বোন আর নিকট আত্মীয়া ছাড়া অন্য কোনও নারীর সঙ্গে মেলামেশা করা যাবে না। কিন্তু সেই সূর্য সেন শেষপর্যন্ত তাঁর সিদ্ধান্ত শিথিল করেন। বিপ্লবী কল্পনা দত্ত এবং প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে তিনি রীতিমতো প্রশিক্ষণ দিয়ে দেবী চৌধুরানী উপন্যাসের ভবানী পাঠকের মতো ইস্পাতের তরবারি বানিয়ে তুলেছিলেন। তার আগে নিখুঁতভাবে যাচাই করে নিয়েছিলেন প্রীতিলতার দেশের জন্য আত্মবিসর্জনের সততাকে। প্রসঙ্গত তিনি লিখেছেন: “বাংলায় বীর যুবকের আজ অভাব নাই। বালেশ্বর থেকে জালালাবাদ, কালারপোল পর্যন্ত এদের দৃপ্ত অভিযানে দেশের মাটি বারে বারে বীর যুবকের রক্তে সিক্ত হয়েছে। কিন্তু বাংলার ঘরে ঘরে মায়ের জাতিও যে শক্তির খেলায় মেতেছে, ইতিহাসে সে অধ্যায় আজও অলিখিত রয়ে গেছে। মেয়েদের আত্মদানে সে অধ্যায় রচিত হোক এই-ই আমি চাই। ইংরেজ জানুক, বিশ্বজগৎ জানুক, এদেশের মেয়েরাও মুক্তিযুদ্ধে পেছনে নেই”।

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে এগিয়ে আসা ভারতীয় নারী

বিপ্লবী নির্মল সেনের উদ্যোগে অবশেষে একদিন (১৯৩২ সালের মে মাসের শেষ দিকে) সূর্য সেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে প্রীতিলতার। তার আগে নির্মল সেনকে প্রীতিলতা বলেছিল, দেশের প্রয়োজনে সে নিজের পরিবারের প্রতি মমতা ও কর্তব্যকে অগ্রাহ্য করতে পারবে। আর সূর্য সেন যেদিন প্রীতিকে প্রথম দেখেন সেদিন তাঁর জহুরির চোখ প্রকৃত জহর চিনতে ভুল করেনি। তিনি লিখেছেন: ‘তার চোখেমুখে একটা আনন্দের আভাস দেখলাম। এতদূর পথ হেঁটে এসেছে, তার জন্য তার চেহারায় ক্লান্তির কোনও চিহ্নই লক্ষ করলাম না। যে আনন্দের আভা তার চোখেমুখে দেখলাম, তার মধ্যে আতিশয্য নেই, Fickleness নেই, sincerity আর শ্রদ্ধার ভাব তার মধ্যে ফুটে উঠেছে। একজন উচ্চশিক্ষিত cultured lady একটি পর্ণকুটিরের মধ্যে আমার সামনে এসে আমাকে প্রণাম করে উঠে বিনীতভাবে আমার দিকে দাঁড়িয়ে রইল, মাথায় হাত দিয়ে নীরবে তাকে আশীর্বাদ করলাম।’

প্রীতিলতার জন্ম হয় ১৯১১ সালের ৫ মে মঙ্গলবার চট্টগ্রামের ধলঘাট গ্রামে। বাবা জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার ছিলেন মিউনিসিপ্যাল অফিসের হেড কেরানি। মায়ের নাম প্রতিভাদেবী। তাঁদের ৬ পুত্রকন্যা: মধুসূদন, প্রীতিলতা, কনকলতা, শান্তিলতা, আশালতা আর সন্তোষ।
এই পরিবারের মূল পদবি ছিল দাশগুপ্ত। তাঁদের কোনও এক পূর্বপুরুষ নবাবি আমলে ‘ওয়াহেদেদার’ উপাধি পেয়েছিলেন, এই ওয়াহেদেদার থেকে ওয়াদ্দেদার বা ওয়াদ্দার পদবি হয়। মা প্রতিভা দেবী প্রীতিলতাকে ভালোবেসে ‘রাণী’ (রানি) বলে ডাকতেন।ডাঃ খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে ১৯১৮ সালে প্রীতিলতার প্রাথমিক শিক্ষার সূচনা হয়। ইতিহাসের শিক্ষিকা যখন ক্লাসে রানি লক্ষ্মীবাইয়ের পুরুষের পোশাক পরে ইংরেজদের সঙ্গে লড়াইয়ের গল্প বলতেন তখন মুগ্ধ প্রীতিলতার মনের মধ্যে তীব্র আগুনের শিখা জ্বলে উঠত।

কল্পনা দত্ত (যোশী)


স্কুলে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের অন্যতম ছিলেন। তাঁরা একই সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলতেন। কল্পনা দত্ত তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছেন: “কোনও কোনও সময় আমরা স্বপ্ন দেখতাম বড় বিজ্ঞানী হব। সেই সময়ে ঝাঁসির রানি আমাদের চেতনাকে উদ্দীপ্ত করে। নিজেদেরকে আমরা অকুতোভয় বিপ্লবী হিসাবে দেখা শুরু করলাম।”

১৯২৮ সালে লেটার মার্কস সহ ম্যাট্রিক পরীক্ষায় সসম্মানে পাশ করে তিনি ঢাকার ইডেন কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকেও মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়ে বৃত্তি লাভ করেন। পড়াশোনার পাশাপাশি সাহিত্যচর্চাতেও গভীর আগ্রহ ছিল তাঁর। নিজে নাটক লিখে ঘরোয়াভাবে সেই নাটকের অভিনয় করতেন। ঢাকায় পড়ার সময় লীলা রায়ের প্রতিষ্ঠিত ‘দীপালি সংঘ’-এ যোগ দিয়ে তিনি লাঠিখেলা, ছুরিখেলা ও মল্লবিদ্যা আয়ত্ত করেন। স্মৃতিকথায় তিনি লিখেছেন: ‘আই এ পড়ার জন্য ঢাকায় দু’বছর থাকার সময় আমি নিজেকে মহান মাস্টারদার একজন উপযুক্ত কমরেড হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়েছি।’
কলকাতার বেথুন কলেজে বি এ পড়ার সময় তাঁর প্রিয় বিষয় ছিল দর্শন। খুব ভালো বাঁশি বাজাতেন বলে ছাত্রীমহলে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তিনি। বি এ পরীক্ষায় ডিস্টিংশন নিয়ে পাশ করা সত্ত্বেও ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের জন্য তাঁর রেজাল্ট আটকে রাখা হয়। এর বহুকাল পরে ২২ মার্চ, ২০১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে তাঁকে মরণোত্তর স্নাতক ডিগ্রি প্রদান করা হয়।
দশম শ্রেণির ছাত্রী প্রীতিলতার কাছে তাঁর এক বিপ্লবী আত্মীয় পূর্ণেন্দু দস্তিদার কিছু নিষিদ্ধ বৈপ্লবিক পুস্তিকা লুকিয়ে রাখার জন্য দিয়েছিলেন গোপনে। সেসব বইয়ের মধ্যে ছিল ‘দেশের কথা’, ‘বাঘা যতীন’, ‘ক্ষুদিরাম’ আর ‘কানাইলাল’। আগুনের অক্ষরে লেখা সেইসব বই প্রীতিলতাকে বিপ্লবের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করেছিল কৈশোরেই। কলকাতার কলেজে পড়ার সময় তা আরও পল্লবিত হয়ে ওঠে। 

১৯৩০ সালের ২রা ডিসেম্বর চাঁদপুর রেলস্টেশনে মিঃ ক্রেগের পরিবর্তে ভুল করে চাঁদপুরের এস ডি ও তারিণী মুখার্জিকে হত্যা করেন বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাস এবং কালীপদ চক্রবর্তী। বিচারে রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসির আদেশ হয় আর কালীপদ চক্রবর্তীকে দেওয়া হয় নির্বাসন।
রামকৃষ্ণ বিশ্বাসকে রাখা হয়েছিল আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। সেই সময় প্রীতিলতা ‘অমিতা দাস’ ছদ্মনামে ‘কাজিন’ পরিচয় দিয়ে প্রায় চল্লিশবার মৃত্যুপথযাত্রী রামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করেন। সেই সাক্ষাৎকারের অভিজ্ঞতার কথা তিনি লিখে রেখেছিলেন তাঁর ডায়েরিতে। সে খবর জেনেছিলেন মাস্টারদা সূর্য সেন। তাতে প্রীতিলতার প্রতি তাঁর আস্থা সুদৃঢ় হয়েছিল।১৯৩১ সালের ৪ আগস্ট রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসির পর প্রীতিলতা লিখেছিলেন: ‘রামকৃষ্ণদার ফাঁসির পর বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে সরাসরি যুক্ত হবার আকাঙ্ক্ষা আমার অনেক বেড়ে গেল।’
কিন্তু চট্টগ্রামে ফিরে এসে প্রীতিলতা দেখেন, বাবার চাকরি নেই। উপার্জন বন্ধ হয়ে গেছে৷ সংসারের হাল ধরার জন্য তিনি অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে নন্দনকানন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার চাকরি নিলেন। তখনও তাঁর মনের মধ্যে প্রবল ইচ্ছে, সূর্য সেনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেবেন।


পটিয়া উপজেলার ধলঘাট ছিল বিপ্লবীদের গোপন আস্তানা। বিধবা সাবিত্রীদেবীর ‘আশ্রমে’ বসে সূর্য সেন অতি সংগোপনে বিপ্লবীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিভিন্ন আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করতেন। ১৯৩২ সালের ১২ জুন এক প্রবল প্রাকৃতিক দুর্যোগের দিনে প্রীতিলতাকে সেই আশ্রমে ডেকে পাঠান সূর্য সেন। সেখানে তখন নির্মল সেন, ভোলা সেনের মতো ভয়ংকর বিপ্লবীরাও রয়েছেন।
পরদিন পটিয়া পুলিশ ক্যাম্পের অফিসার-ইন-চার্জ ক্যাপ্টেন ক্যামেরন গোপন সূত্র খবর পেয়ে ঐ বাড়িতে সদলবলে হানা দেয়।
নির্মল সেনের গুলিতে ক্যাপ্টেন ক্যামেরন মারা যায়। এরপর বাড়ির চারপাশ ঘিরে থাকা সৈনিকেরা প্রচণ্ড গুলিবৃষ্টি আরম্ভ করে। নির্মল সেনের বুকে গুলি লাগে এবং প্রচুর রক্তপাতের ফলে তাঁর মৃত্যু হয়। পালাতে গিয়ে ভোলা সেন সিপাহিদের গুলিতে মারা যান। অর্থ ও জরুরি কাগজপত্র নিয়ে সূর্য সেন এবং প্রীতিলতা সেই রাত্রিতে কচুরিপানা ভর্তি পুকুরে সাঁতার কেটে আর দীর্ঘ কাদায় ভরা পথ পায়ে হেঁটে পটিয়ার কাশীয়াইশ গ্রামে দলের এক কর্মীর বাড়িতে গিয়ে আত্মগোপন করে থাকেন।এরপর সূর্য সেনের নির্দেশে প্রীতিলতা নিজের বাড়িতে ফিরে এসে চাকরিতে যোগ দেন। কিন্তু পুলিশ তাঁকে সন্দেহ করে। কারণ সাবিত্রী দেবীর আশ্রমে তল্লাশি করে তারা নানা অস্ত্রশস্ত্র, ডায়েরি, কাগজপত্র ও প্রীতিলতার একটি ছবি খুঁজে পায়। অতঃপর মাস্টারদার নির্দেশে প্রীতিলতা আবার বাড়ি থেকে পালিয়ে অন্যত্র আত্মগোপন করে থাকে।

চট্টগ্রাম শহরের উত্তরে পাহাড়তলিতে ছিল একটি ইউরোপিয়ান ক্লাব। তার সামনে লেখা ছিল একটি অত্যন্ত অপমানজনক নির্দেশিকা:
কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ
সন্ধের পর থেকে সেখানে চলত শ্বেতাঙ্গদের মদ্যপান, হৈ হুল্লোড়, বেলেল্লাপনা। বিপ্লবীদের ভয়ংকর ক্ষোভ ছিল এই প্রমোদভবনটির প্রতি। এর আগে কয়েকবার সেখানে আক্রমণের পরিকল্পনা করেও সাফল্য আসেনি। সূর্য সেন এবার ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের দায়িত্ব দিলেন প্রীতিলতার উপরে।

১৯৩২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হামলার দিন স্থির হল। ২৩ সেপ্টেম্বর প্রীতিলতা পাঞ্জাবি যুবকের পোশাক পরে আক্রমণে নেতৃত্ব দেন। তাঁর সহযোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন কালীকিংকর দে, বীরেশ্বর রায়, প্রফুল্ল দাস, শান্তি চক্রবর্তী, মহেন্দ্র চৌধুরী, সুশীল দে আর পান্না সেন।
রাত ১০টা ৪৫ মিনিটে আক্রমণ শুরু হয়। সেদিন ছিল শনিবার। প্রায় চল্লিশজন শ্বেতাঙ্গ মহিলা ও পুরুষ তখন ক্লাবঘরে আমোদপ্রমোদে মত্ত।
প্রীতিলতা হুইসেল বাজিয়ে আক্রমণের নির্দেশ দেবার পরেই শুরু হয় গুলিবৃষ্টি আর বোমা নিক্ষেপ। ঘন ঘন কেঁপে ওঠে ক্লাবঘরটি। সমস্ত বাতি নিভে যায়। অন্ধকারে আতঙ্কে ছুটোছুটি করতে থাকে দিশেহারা শ্বেতাঙ্গরা। ক্লাবের কয়েকজন ইংরেজ অফিসারের কাছে রিভলবার ছিল। তাঁরা পাল্টা আক্রমণ চালায়। এক মিলিটারি অফিসারের রিভলবারের গুলিতে প্রীতিলতার শরীরের বাঁ দিকে গুলি লাগে। তাঁর নির্দেশে আক্রমণ শেষ হলে সবাই ক্লাব থেকে বেরিয়ে কিছুটা পথ এগিয়ে আসেন। সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী সেদিনের সেই আক্রমণে মিসেস সুলিভান নামে একজন নিহত হয় এবং চারজন পুরুষ আর সাত জন নারী আহত হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে হতাহতের সংখ্যা ছিল আরও অনেকগুণ বেশি।আহত অবস্থায় গ্রেফতার হলে ইংরেজ পুলিশের হাতে চরম দুর্দশা ও অপমান ভোগ করতে হত তাঁকে। তাই প্রীতিলতা পটাশিয়াম সায়ানাইড মুখে দিয়ে আত্মহত্যা করেন। মারা যাবার আগে তিনি নিজের রিভলবারটা তুলে দেন বিপ্লবী কালীকিঙ্কর দে-র হাতে। মাটিতে পড়ে থাকা প্রীতিলতার নশ্বর দেহকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বাকি বিপ্লবীরা সবাই দ্রুত পালিয়ে যান। পরের দিন পুলিশ ইউরোপীয়ান ক্লাব থেকে ১০০ গজ দূরে প্রীতিলতার মৃতদেহটিকে সনাক্ত করে।
এই মর্মান্তিক দুঃসংবাদ পেয়ে প্রীতিলতার বাবা শোকে দুঃখে প্রায় উন্মাদ হয়ে যান। কিন্তু তাঁর মা গর্ব করে বলেছিলেন, ‘আমার মেয়ে দেশের কাজে প্রাণ দিয়েছে’। এই গর্ব আমাদেরও, এই গর্ব সমগ্র বঙ্গদেশের এবং আপামর ভারতবাসীর।

ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সুদীর্ঘকালের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের প্রথম নারী শহীদের পবিত্র রক্তের স্মৃতি নিয়ে আজও জেগে আছে কালের প্রহরী চট্টগ্রাম। জেগে আছে তাঁর স্মৃতিতে নির্মিত শহীদবেদিটি। এই ঐতিহাসিক মাহেন্দ্রক্ষণে চট্টগ্রামের অবিসংবাদিত বীরাঙ্গনা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে আমাদের সমবেত প্রাণের শত সহস্র শ্রদ্ধা নিবেদন করি।