Home Second Lead যেভাবে মানুষ অপচিকিৎসার শিকার হচ্ছেন

যেভাবে মানুষ অপচিকিৎসার শিকার হচ্ছেন

তার  সেবাসমূহের তালিকা অনুযায়ী তিনি, বাত, ব্যথা, শিরা, নিউরো, ডায়বেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তশূন্যতা, গ্যাস্ট্রোলিভার ও পরিপাকতন্ত্র, হৃদরোগ, কিডনী, ক্যান্সার, স্ট্রোক, হরমোন, গর্ভধারণে অক্ষমতা রোগসহ মোট ৩৬ প্রকার রোগের চিকিৎসা দেন।

যশোর: শহরের মুড়লি এলাকার বাসিন্দা রাসেল হোসেন ও চামেলি খাতুন দম্পতি ৪ এপ্রিল বেলা সাড়ে ১১ টায় যশোর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে আসেন ডাক্তার দেখাতে। সেখানে দালাল চক্র তাদের জানায় হাসপাতালে ডাক্তার বসবেন না। তিনি চেম্বার করছেন স্ক্যান হসপিটাল এন্ড ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে। তারা সরল মনে ওই দালালের সাথে ডাক্তার গোলাম মোস্তফার চেম্বারে যান। ডাক্তার সেখানে ৬০০ টাকা ফি দিয়ে চামেলি খাতুনের ব্যবস্থাপত্রে ১০টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা লিখে দেন। ব্যবস্থাপত্রে লেখা টেস্ট করাতে রোগীর খচর হয় ৬ হাজার ৭০০ টাকা। এরপর রিপোর্ট দেখে ডাক্তার রোগীকে ওষুধ লিখে দেন। কিন্তু রোগী সুস্থ হওয়ার পরিবর্তে আরও অসুস্থ হয়ে পড়লে রোববার আবারও রাসেল তার স্ত্রী চামেলিকে নিয়ে যশোর জেনারেল হাসপাতালে আসেন। তখন তিনি জানতে পারেন গোলাম মোস্তফা কোনো ডাক্তার নন। বুঝতে পারেন, তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন।

ভুক্তভোগী রাসেল জানান, হঠাৎ তার স্ত্রীর পেটে ব্যথা শুরু হয়। এ জন্য হাসপাতালে এসেছিলেন ডাক্তার দেখাতে। কিন্তু তিনি প্রতারিত হয়েছেন। পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পর জানতে পারেন তার স্ত্রী অন্তঃস্বত্ত্বা। কিন্তু কথিত গাইনি ডাক্তারের কাছে রেফার না করে নিজেই ওষুধ লিখেছেন। তার কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে প্রায় আট হাজার টাকা। ওষুধ লিখেছেন চার হাজার টাকার। এরমধ্যে একটি জার্মান এবং ভারতের ওষুধও রয়েছে। কিন্তু এতো টাকা খরচ করে ওষুধ খেয়ে রোগীর কোনো কাজ হয়নি। রোববার সকালে আবারও তার চেম্বারে গেলে জানানো হয় একদিনে রোগ সুস্থ হবে না। কমপক্ষে ওই ওষুধ আরও সাতদিন খেতে হবে। তারপর রেজাল্ট পাওয়া যাবে। পরে তিনি ১০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে যশোর জেনারেল হাসপাতালের গাইনি বিভাগে দেখান। এ সময় হাসপাতাল থেকে ডাক্তার তাকে জানান রোগীকে অপচিকিৎসা করা হয়েছে। ব্যবস্থাপত্রে যে ওষুধ লিখেছেন তিনি কোনো ডাক্তার না। পরে তিনি তার সাথে প্রতারণার কারণ জানতে ওই প্রতিষ্ঠানে গেলে গোলাম মোস্তফাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

সূত্র জানায়, খোদ সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারের চেয়ে নিজেকে বড় ডিগ্রিধারী পরিচয় দিয়ে ৬০০ টাকা ফি নিয়ে রোগী দেখছেন গোলাম মোস্তফা। রোগীর ব্যবস্থাপত্রে নিজের ডিগ্রি ব্যবহার করছেন ‘প্রফেসর’, আন্তর্জাতিক গবেষক ও রক্তের গ্রুপ, নখ, চোখ, জিহ্বা পর্যবেক্ষণে রোগ নির্ণয়ের উদ্ভাবক, এমপিএইচ (নিউট্রি), এমপিএইচডি (মা ও শিশু স্বাস্থ্য), এমএস (হেলথ), এমএসএস, এমবিএ,পিএইডি (ইউএসএ), পোস্টডক (ফেলো), সিএসডি (বারডেম), সিসি (সুইডিস,আইডিএ), চেয়ারম্যান বাংলাদেশ রিসার্চ ফাউন্ডেশন, প্রফেসর, ফ্যাকাল্টি অব হেলথ এন্ড মেডিকেল সায়েন্স (এক্স), সুপারভাইজার ইন সিডটান্স লার্নিং (পিএইচডি প্রোগ্রাম), আমেরিকা ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, ক্যালিফোর্নিয়া, ইউএসএ, চিফ কনসালটেন্ট শিন শিন জাপান হাসপাতালসহ কমপক্ষে অর্ধশত ডিগ্রি ব্যবহার করছেন। যার সবই ভুয়া। একজন চিকিৎসকের পক্ষে এতো দিকের বিশেষজ্ঞ হওয়া সম্ভব না বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
তার  সেবাসমূহের তালিকা অনুযায়ী তিনি, বাত, ব্যথা, শিরা, নিউরো, ডায়বেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তশূন্যতা, গ্যাস্ট্রোলিভার ও পরিপাকতন্ত্র, হৃদরোগ, কিডনী, ক্যান্সার, স্ট্রোক, হরমোন, গর্ভধারণে অক্ষমতা রোগসহ মোট ৩৬ প্রকার রোগের চিকিৎসা দেন।

অভিযুক্ত গোলাম মোস্তফা স্বীকার করেন, তিনি ডাক্তার নন, তবে ‘নিউট্রি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ’। তিনি নামের আগে ডাক্তার ব্যবহার করেন না। নামের আগে ‘ডাক্তার’ না লিখে ‘ডক্টর’ লখেন। যা সাধারণত পিএইচডি ডিগ্রিধারীরা লিখে থাকেন।  গোলাম মোস্তফা বলেন, “আমি যে রোগী দেখতে পারবো না, এমন কোনো প্রজ্ঞাপন জারি করেনি সরকার।” ৬০০ টাকা ফি নিতে পারবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি দাবি করেন, সারাদেশেই তার মতো ‘নিউট্রি’ ডিগ্রিধারীরা ফি নিয়ে রোগী দেখেন। তাই তিনিও ফি নিয়ে রোগী দেখছেন।

চিকিৎসা পেশার আইন অনুযায়ী ‘বিএমডিসি অ্যাক্ট-২০১০-এর সেকশন ২৯ অনুযায়ী বিএমডিসির নিবন্ধন ও অনুমোদন ছাড়া কোনো চিকিৎসক তার নামের আগে কোনো পদবি, শিক্ষাগত যোগ্যতা ও প্রশিক্ষণের নামও ব্যবহার করতে পারবেন না। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, অনেক ডাক্তারই পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন না করেও ‘বিশেষজ্ঞ’ শব্দ ব্যবহার করেন। যা জনসাধারণের সঙ্গে প্রতারণার সামিল, বিএমডিসির আইনের পরিপন্থি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

স্ক্যান হসপিতাল এন্ড ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের পরিচালক মহিবুল আলম বিপু এই প্রতারণার কোনো দায় নিতে রাজি না। তিনি বলেন, গোলাম মোস্তফা তাদের প্রতিষ্ঠানের কেউ না। এ প্রতিষ্ঠানের কোনো রোগী তাকে দিয়ে দেখানো হয় না। তিনি শুধু তার লোক মাধ্যমে ব্যক্তিগত রোগী দেখেন।

আসলেই এ ডিগ্রিতে রোগী দেখা যায় কিনা জানতে সিভিল সার্জন অফিসে গেলে ডিগ্রির বহর দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে প্রশাসনিক কর্মকর্তা আরিফুজ্জামান বলেন, ওই ব্যক্তি কোনোভাবেই একটি ক্লিনিকে বসে রোগী দেখতে পারেন না। ওই প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে এমবিবিএস ডাক্তার দিয়ে পরিচালনার জন্য। সেবার নামে প্রতারক নিয়ে রোগীর সাথে প্রতারণার জন্য নয়। ব্যবস্থাপত্র দেখালে তিনি জানান, প্রেসক্রিপশনে এই ব্যক্তি ‘নিষিদ্ধ’ ওষুধ লিখছেন।

ডেপুটি সিভিল সার্জন নাজমুস সাদিক রাসেল জানান, সরাসরি রোগীর সাথে প্রতারণা করছে গোলাম মোস্তফা। প্রতারিত কেউ অভিযোগ দিলে ওই প্রতিষ্ঠান ও কথিত চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।