শেষমেশ অপেক্ষার অবসান। প্রথম প্রেমিকা খোঁজ নিলেন, “কেমন আছো?” শুধু তাই নয়। জানালেন, তিনি শীঘ্রই আসছেন। মাঝখানে কেটেছে সময়। বেশি নয়, মাত্র ৫ দশক!
এ যেন এক ভিন্ন স্বাদের রূপকথা। থর মরুভূমি বেড়াতে এসে সেই গল্পই শুনলেন মুম্বইয়ের একদল পর্যটক।
জীবন-সায়াহ্নে এসে নতুন করে আর কীই বা পাওয়ার থাকতে পারে মানুষের! সারাজীবন দায়িত্বপালনের পরে একটু শান্তি চান সকলেই। রাজস্থানের থর মরুভূমির মধ্যে ছোট্ট গ্রাম কুলধারার দ্বাররক্ষক, অশীতিপর বৃদ্ধ মানুষটির জীবনও তেমনই। এতকাল তিনি সংসার সামলেছেন ঠিকমতো। ছেলেরা সবাই বিয়ে-থা করেছে। তিনিও ঝাড়া হাত পা। নিঃসঙ্গ, অলস সময়ের মধ্যেই বয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।
কেবল তাঁর শূন্য হৃদয়ে উজ্জ্বল রেখার মত জেগে ছিলেন ম্যারিনা। যোগাযোগ করতে সাহস হয়নি আর। তবু পাওনার ঝুলি যে পূরণ হতে এখনও বাকি, তা হঠাৎই বোঝা গেল। এতদিনের ছাই চাপা আগুন সরিয়ে অশীতিপর বৃদ্ধের হৃদয়ে ছলাৎ ঢেউ উঠল আবার! তিনি বললেন, “মনে হচ্ছে একুশে ফিরে গেছি!”
১৯ শতকের পর থেকেই কুলধারা গ্রামের জনবসতি প্রায় ফিকে হয়ে এসেছে। অনেকে বলেন ভূতুড়ে গ্রাম! সেখানকার ৮২ বছরের সেই বৃদ্ধ জানালেন, “ম্যারিনাকে প্রথম যখন দেখি, আমার বয়স তিরিশের কোঠায়। মরুভূমিতে অ্যাডভেঞ্চার করতে অস্ট্রেলিয়া থেকে জয়সলমীর বেড়াতে এসেছিল ম্যারিনা। পাঁচ দিনের ট্রিপ। আমিই ওকে উটে চড়া শেখাই।”
উদ্বেল হৃদয়ে বলে চললেন বৃদ্ধ, সেই ১৯৭০ সাল এখনকার মত নয়। তখন প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ত মানুষ। তিনি এবং ম্যারিনা সেই পাঁচদিনের সফরে পরস্পরের থেকে চোখ ফেরাতে পারেন নি। দুজনের ক্ষেত্রেই যাকে বলে, প্রথম দর্শনে প্রেম।
তবে প্রেম নিবেদন করেছেন প্রথম ম্যারিনাই। অস্ট্রেলিয়া ফেরার আগেররদিন গাইডকে বলেছিলেন “ভালবাসি”। তাতে উত্তর দিতে পারেননি এখনকার বৃদ্ধ, কেবল লজ্জায় রাঙা হয়ে মুখ নামিয়েছিলেন। সেই ভাষা বুঝতে অসুবিধে হয়নি ম্যারিনার। তিনি একরাশ আনন্দ নিয়ে দেশে ফিরে আসেন।
এরপর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল দুজনের মধ্যে। একদিন ম্যারিনা তাঁর গাইডকে অস্ট্রেলিয়ায় আসার জন্য নিমন্ত্রণ জানালেন। গল্পের নায়ক প্রেমের উন্মাদনা বুকে নিয়ে অসাধ্য সাধন করতে পিছপা হননি। লোন নিয়ে জোগাড় করে ফেললেন তিরিশ হাজার টাকা। তৎক্ষণাৎ প্লেনের টিকিট, ভিসা সবকিছুর ব্যবস্থা করে পাড়ি দিলেন প্রেমিকার দেশ।
তাঁর কথায়, ” অস্ট্রেলিয়ায় সেই তিনমাস কেটেছিল স্বপ্নের মতো। ও আমায় ইংরিজি শেখাল, আমি ওকে শেখালাম ঘুমার নৃত্য।” কিন্তু তার পরই ম্যারিনা বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। তাঁকে বিয়ে করে সেখানে থেকে যেতে বললেন। এই অনুরোধ রক্ষা সম্ভব হয়নি প্রেমিকের পক্ষে। মাতৃভূমি বরাবরের জন্য ছেড়ে যেতে তাঁর মন চাইছিল না। ওদিকে ম্যারিনাও ভারতে এসে থাকতে রাজি ছিলেন না। ফলে প্রেমের মায়াজাল ছিন্ন করে, ম্যারিনাকে কাঁদিয়ে তিনি ফিরে এলেন ভারতে। আর যোগাযোগ রাখেননি প্রথম প্রেমের সঙ্গে।
এরপর জীবন বইল অন্য খাতে। বৃদ্ধের বাড়িতে সবাই বিয়ের জন্য চাপ দিতে তিনি বিয়েটা সেরে ফেললেন। জীবিকার তাগিদে কুলধারা গ্রামে দ্বাররক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হলেন। সন্তানাদি হল, সব দ্বায়িত্ব পালন করলেন। তারপর কেটে গেছে এতখানি সময়। স্মৃতির ভার অনেকটা হালকা হয়ে এসেছিল।
বৃদ্ধ বলে চলেন, দুবছর আগে তাঁর স্ত্রী মারা গেছেন। তারপর থেকে এই পরিত্যক্ত এলাকায় তিনি একাই। আর কোনও পিছুটান নেই। কিন্তু একমাস আগে হঠাৎ একদিন বদলে গেল সব। ম্যারিনার চিঠি এল। অবাক কান্ড! ৫০ বছর পর ম্যারিনা তাঁকে খুঁজে বার করেছেন আবার। রোজ ফোনে কথা হচ্ছে দুই প্রাচীন যুগলের। কত যে কথা, যেন ফুরোনোর নয়।
ম্যারিনা জানিয়েছেন, তিনি আজও অবিবাহিত। সবথেকে রোমাঞ্চকর খবর হল, খুব শীঘ্রই তিনি চলে আসার পরিকল্পনা করেছেন ভারতে। একসঙ্গে থাকবেন দুটিতে। ব্যস্, বৃদ্ধকে আর পায় কে! তিনি আর ভাবতেই চান না ভবিষ্যৎ কী। প্রতীক্ষার প্রহর শেষ হলেই মিলন হবে ম্যারিনার সঙ্গে, এই আশায় নতুন যৌবন ফিরে পেয়েছেন যেন।
-জিনিউজ