Home আন্তর্জাতিক আফ্রিকার মানুষদের গ্রাম!

আফ্রিকার মানুষদের গ্রাম!

সিদ্দিদের ‘গোমা’ নৃত্য।

রূপাঞ্জন গোস্বামী

আফ্রিকার আকাশ লাল করে দিয়ে সূর্য ডুবে যায়। শন শন করে বইতে শুরু করে হিমেল হাওয়া। আধ খাওয়া চাঁদ ভাসে রাতের আকাশে। দূর থেকে ভেসে আসে সিংহের গর্জন, হায়নার হাসি। আতঙ্কে জঙ্গল ভাঙতে ভাঙতে ছুটে পালায় ওয়াইল্ড বিস্টের দল। ঠিক তখনই অরণ্যের প্রান্তে জেগে ওঠে আদিম গ্রামগুলো। গ্রামের মাঝখানে গনগনিয়ে জ্বলে আগুন। লাঠির আঘাত বুকে নিয়ে আওয়াজ তোলে ফাঁপা গুঁড়ি, ‘দ্রিম দ্রিমি দ্রিম’। রুক্ষ মাটির বুকে পায়ের উদ্দাম ছন্দ মেলায় আফ্রিকার আদিবাসীরা।

বাতাসে ভর করে দূর থেকে দূরে ছড়িয়ে পড়ে আফ্রিকান ড্রামসের নেশা ধরিয়ে দেওয়া আওয়াজ। সে আওয়াজ বুঝি আরব সাগর পেরিয়ে চলে আসে ভারতের পশ্চিম উপকূলেও। গুজরাতের গির, কর্নাটকের ইয়েল্লাপুর অরণ্যের প্রান্তে থাকা কিছু গ্রামে, আগুনকে ঘিরে একইরকমভাবে উদ্দাম নৃত্যে মেতে ওঠেন একদল মানুষ। তাদের চেহারা ভারতীয়দের মতো নয়। ভারত তাদের স্বদেশও নয়। তাদের দেশ আফ্রিকার ইথিওপিয়া।

কীভাবে আফ্রিকা থেকে ভারতে এসেছিল তারা!

ইতিহাস এদের চেনে হাবসি নামে। অ্যাবিসিনিয়ার (ইথিওপিয়া) লোকেদের হাবসি বলা হত। ভারতে হাবসিরা এসেছি্লেন মূলত ক্রীতদাস হয়ে। আরবের দাস ব্যবসায়ীরা হাবসিদের ভারতে পাচার করতে শুরু করেছিল। ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে, হাবসি ক্রীতদাসদের নিয়ে প্রথম জাহাজটি গুজরাটের ভারুচ বন্দরে নোঙর ফেলেছিল। এর পরে ৭১২ খ্রিস্টাব্দে, উমিয়াদ খিলাফতের সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাশিম, তাঁর হাবসি সেনা নিয়ে ভারতে এসেছিলেন।

একসময় আরবদের হাত থেকে দাস ব্যবসা ছিনিয়ে নেয় পর্তুগিজেরা। হাজার হাজার হাবসিকে পর্তুগিজ জাহাজে চাপিয়ে আনা হতে থাকে ভারতে। দাসেদের মধ্যে কেউ কেউ জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করত। পর্যাপ্ত খাদ্য ও পানীয় না পেয়ে মাঝপথেই প্রাণ হারাত অনেক দাস। আতঙ্কে কেউ কেউ হারিয়ে ফেলত মানসিক সুস্থতা। সুস্থ হাবসিদের খোলা বাজারে বিক্রি করে দিত পর্তুগিজ দাস ব্যবসায়ীরা। শক্তিশালী চেহারার হাবসিদের দিয়ে মালিকেরা করাত পরিশ্রমসাধ্য কাজ। পর্তুগিজদের দেখাদেখি আফ্রিকা থেকে হাবসিদের তুলে এনে বিক্রি করতে শুরু করেছিল ডাচ, ফরাসি ও ইংরেজ দাস ব্যবসায়ীরাও।

হাবসি দাসেদের সঙ্গে আরব দাস ব্যবসায়ীরা।

হাবসিদের নাম হয়ে গিয়েছিল ‘সিদ্দি’

ঊনবিংশ শতাব্দীতে দাসপ্রথা অবলুপ্ত হওয়ার পর, ভারতের বিভিন্ন জায়গায় দাস হিসেবে থাকা হাবসিরা, এলাকা ছেড়ে পালিয়েছিল সংসার পরিজন নিয়ে। পাছে মালিকেরা আবার ধরে ফেলে, আবার পায়ে দাসত্বের বেড়ি পরায়। হাবসিদের কোনও গোষ্ঠী লুকিয়ে পড়েছিল গুজরাটের জঙ্গলে। কোনও গোষ্ঠী পালিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানের সিন্ধপ্রদেশে। কোনও গোষ্ঠী পশ্চিমঘাট পর্বতমালার দুর্গম পাহাড়ি পথ দিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল কর্নাটকের ‘উত্তর কান্নাড়’ জেলায়।

কবেই ছেড়ে এসেছেন আফ্রিকা, এখনও ভারত আপন করে নেয়নি এঁদের।

দাসত্বের শৃংখল থেকে মুক্তি পাওয়া হাবসিদের নিজেদের এলাকায় দেখে স্থানীয় ভারতীয়রা প্রতিবাদ করেননি। কিন্তু বুকে টেনেও নেননি। হয়তো তাদের চেহারার জন্যেই। আজ ভারতে বাস করেন প্রায় সত্তর হাজার হাবসি। তবে তাঁরা হাবসি শব্দটির কালিমা নিজেদের জীবন থেকে সরাবার জন্যেই আজ নিজেদের বলেন সিদ্দি। ইথিওপিয়ায় যা একটি সম্মানসূচক শব্দ।

পর্তুগিজদের প্রভাবে ভারতীয় সিদ্দিরা মূলত খ্রিস্টান। তবে মুসলিম ও হিন্দু সিদ্দিও দেখতে পাওয়া যায়। সিদ্দিদের পদবি সিদ্দিই। ধর্ম অনুযায়ী শুধু পালটে যায় নাম। যেমন কৃষ্ণা সিদ্দি, ইমাম সিদ্দি, বাস্তিয়ান সিদ্দি। সিদ্দিরা মূলত কোঙ্কোনি ভাষায় কথা বলেন। তবে কোনও কোনও গোষ্ঠী বলেন গুজরাতি, কন্নড় ও মারাঠি। সিদ্দিরা ভুলে গিয়েছেন তাঁদের মাতৃভাষা ‘অ্যামহারিক’।

কর্নাটকের একটি সিদ্দি গোষ্ঠী।

আজও সিদ্দিদের এক সুতোয় বেঁধে রেখেছে দুটি অভ্যাস

স্থানীয় ধর্ম ও সংস্কৃতি আপন করে নিলেও, আজও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সিদ্দিদের একসুতোয় বেঁধে রেখেছে সুদূর আফ্রিকা থেকে ভারতে নিয়ে আসা দু’টি অভ্যাস। প্রথমটি হলো পূর্ব পুরুষদের আত্মার উপাসনা পদ্ধতি ‘হিরিয়ারু’ এবং দ্বিতীয়টি হল আফ্রিকার ছন্দ ও তালে গাঁথা এক নৃত্যশৈলী ‘গোমা’। যা সোয়াহিলি শব্দ ‘এনগোমা’ থেকে এসেছে।

আর সিদ্দিরা এনেছিল আফ্রিকার রক্ত। সিদ্দিদের কোষে থাকা Y DNAmtDNA প্রমাণ করছে সিদ্দিদের শরীরে আফ্রিকার বান্টু ও অনান্য আদিবাসীদের রক্ত বইছে। ২০০৩ সালে শিডিউলড ট্রাইব তালিকায় সিদ্দিদের অন্তর্ভুক্ত করা হলেও, ভারতে আজও সিদ্দিরা সমাজের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন। তাই হয়তো আজও শারীরিক গঠনে তারা আফ্রিকার বৈশিষ্ট্যগুলি ধরে রাখতে পেরেছে। কারণ সিদ্দিদের বিয়ে হয় কেবলমাত্র সিদ্দি গোষ্ঠীর মধ্যেই।

সিদ্দিদের ‘গোমা’ নৃত্য।

গির অরণ্যের প্রান্তে আছে সিদ্দিদের গ্রাম ‘জাম্বুর’

গুজরাটে আছে ‘সাসান গির’ অরণ্য। যে অরণ্যকে আমরা চিনি ‘গির অরণ্য’ নামে। ১৪২২ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে থাকা গির অরণ্যে বাস করে এশিয়াটিক লায়ন, ভারতীয় চিতাবাঘ, বন বিড়াল, হায়না, সোনালি শিয়াল, বেজি, চিতল, নীলগাই, অ্যান্টিলোপ, চিঙ্কারা, বুনোশুয়োর, ব্ল্যাক বাক, সজারু, খরগোশ, প্যাঙ্গোলিন ও আরও কত শত জীবজন্তু এবং তিনশো প্রজাতির পাখি। সেই গির অরণ্যের কিছু দূরেই আছে’ জাম্বুর’ নামের এক গ্রাম।

ভারতের বুকে আফ্রিকান মানুষদের গ্রাম ‘জাম্বুর’।

গ্রামের পথ ও বাড়িঘরগুলি দেখে যেকোনও ভারতীয় গ্রাম বলেই মনে হবে। কিন্তু গ্রামে ঢোকার পর পরিবেশ দ্রুত বদলাতে শুরু করবে। গ্রামের মানুষদের দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হবে। সাধারণ ভারতীয়দের চেহারার সঙ্গে এই গ্রামবাসীদের চেহারার সামান্যতম মিলও নেই। বাদামি রঙের কোঁকড়া চুল, চওড়া চ্যাপ্টা নাক, পুরু ঠোঁট, মিশকালো ত্বক, শিশু কন্যাদের মাথাভরা ছোটো ছো্টো বিনুনি, তাতে গাঁথা রঙিন পুঁতি, রঙচঙে ছিটকাপড়ের পোশাক। গ্রামে প্রথম আসা যেকোনও মানুষকে এক লহমায় ভারত থেকে আফ্রিকার কোনও গ্রামে নিয়ে চলে যাবে জাম্বুর গ্রামের পরিবেশ।

ভারতের মাটিতে আফ্রিকার শিশু। (জাম্বুর গ্রামের পথে)

সিদ্দিরা জানাবেন উষ্ণ আমন্ত্রণ

কোনও বাড়ির বারান্দায় অতিথিকে নিয়ে বসে পড়বেন গ্রামের মধ্যবয়স্ক সিদ্দিরা। শোনাবেন তাঁদের অতীত। জাম্বুর গ্রাম গড়ে ওঠার ইতিকথা। যা তাঁরা বংশপরম্পরায় শুনে এসেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্রামের অতিথি জেনে যাবেন গ্রামের আদ্যপ্রান্ত। গ্রামে বাস করেন প্রায় পাঁচশো জন সিদ্দি। কৃষিকাজ আর জঙ্গল থেকে কাঠ সংগ্রহ করাই এই সিদ্দি পরিবারগুলির পেশা। কেউ কেউ অবশ্য শ্রমিকের কাজও করেন। শহরে গিয়ে পড়াশোনা শেখা সিদ্দি যুবকেরা কাজের সন্ধানে ছড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন শহরে। শহর থেকেই পরিবারে টাকা পাঠান তাঁরা।

অর্থনৈতিক দিক থেকে দারিদ্রসীমার কাছাকাছি থাকলেও অন্তরের সম্পদে আজও সিদ্দিরা ধনী। খুবই অতিথিবৎসল হন সিদ্দিরা। বাড়ির বারান্দায় বসলে ভেতর থেকে এসে যাবে চা। গল্প করতে করতে বা গ্রাম দেখতে দেরি হয়ে গেলে, কেউ না কেউ তাঁর বাড়িতে খেয়ে যেতে বলবেন। নিজেরা যা খান তাই খেতে দেবেন। তবে বাড়িতে মুরগী বা মাছ রান্না হলে, সিদ্দিরা অতিথিদের প্লেটে তুলে দেবেন মুরগীর লেগ পিস কিংবা মাছের মাথা।

অতিথির জন্য তৈরি হচ্ছে খাবার।

ভারতের অনান্য সিদ্দি গোষ্ঠীগুলির মতো জাম্বুর গ্রামের সিদ্দিরাও আমিষাশী। মাংস মাছ ও ডিম খেতে ভালোবাসেন। কিন্তু উৎসব ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়া মাংস খাওয়ার সামর্থ্য সবার হয় না। তবে সিদ্দিদের যেকোনও বড় উৎসবে ভেড়া, ছাগল বা মুরগির মাংস থাকবেই।

সারাদিন কেটে যাবে বাবলা গাছের ছায়ায় বসে জাম্বুর গ্রামের গল্প শুনতে শুনতে। অতিথি রাতে গ্রামে থাকতে চাইলে, সিদ্দিরাই করে দেবেন ব্যবস্থা। গ্রামের কিছু সিদ্দি যুবক হোম-স্টে করার পরিকল্পনা নিচ্ছেন। কারণ গির অরণ্য দেখতে আসা পর্যটকদের কাছে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে আফ্রিকার মানুষদের গ্রাম জাম্বুর।

গির অরণ্যের পশ্চিমে সূর্য ঢলে

পাখিরা আকাশ থেকে দ্রুত নেমে আসে বাসায়। গির অরণ্যকে ঘিরে ফেলতে থাকে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। হু হু করে বইতে শুরু করে মাতাল হাওয়া। জাম্বুরা গ্রামের নৈশাবাসের সামনে পাতা খাটিয়ায় বসে থাকা অতিথির জন্য ততক্ষণে এসে যাবে ধুমায়িত চা আর বেসনের পকোড়া। গ্রামের মাঝে আগুন জ্বালাবেন গ্রামের যুবক যুবতীরা। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে আগুন। সশব্দে ফাটতে থাকবে আগুনলাগা কাঠ। শূন্যে উড়বে লালচে স্ফুলিঙ্গ।

আগুনকে ঘিরে শুরু হবে সিদ্দি যুবক যুবতীদের ‘ধামাল’ নাচ। চড়া ও অচেনা তালে বাজবে ভারতীয় ঢোল। রুক্ষ জমিতে তালে তালে পড়তে থাকবে কয়েক ডজন পা। এ নৃত্যশৈলী ভারতের নয়। নর্তক নর্তকীদের শরীরী বিভঙ্গে ভারতের বুকে অফুরন্ত প্রাণশক্তি নিয়ে জেগে উঠবে আফ্রিকা। আগুনের আভায় লাল হয়ে যাওয়া শরীরগুলো তৈরি করবে এক প্রাগৈতিহাসিক পরিবেশ।

গুজরাতের গির অরণ্য ভ্রমণে আসা অতিথি মনের ডানা মেলে পৌঁছে যাবেন আফ্রিকার মাহালে, সেরেঙ্গেটি, রুয়াহা ন্যাশনাল পার্কের পাশে থাকা আদিবাসী গ্রামে। অন্যদিকে শত শত বছর আগে আফ্রিকা ছেড়ে আসা মানুষগুলির দীর্ঘশ্বাস, বাতাস হয়ে ছুটে চলবে আরব সাগর পেরিয়ে আফ্রিকার দিকে।