স্কটিশ বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী তথা আবিষ্কারক আলেকজাণ্ডার গ্রাহাম বেল (Alexandar Graham Bell) সমগ্র বিশ্বে টেলিফোন আবিষ্কারের জন্য বিখ্যাত। তিনিই প্রথম ব্যবহারিক টেলিফোনের পেটেন্টের কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন। ১৮৮৫ সালে তিনি আমেরিকান টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ কোম্পানি স্থাপন করেন। অপটিক্যাল টেলি-যোগাযোগ ও এরোনটিক্স বিষয়েও তাঁর অসামান্য অবদান রয়েছে। ১৮৯৮ থেকে ১৯০৩ সাল পর্যন্ত আলেকজাণ্ডার গ্রাহাম বেল ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির দ্বিতীয় সভাপতি পদে আসীন ছিলেন। ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যায় গভীর আগ্রহের পাশাপাশি বংশগতিবিদ্যা নিয়েও গবেষণা ও চর্চা করতে ভালবাসতেন গ্রাহাম বেল।
১৮৪৭ সালের ৩ মার্চ স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের জন্ম হয়। তাঁদের পারিবারিক বাসস্থান ছিল সাউথ শার্লট স্ট্রিটে। তাঁর বাবা আলেকজান্ডার মেলভিল বেল পেশায় একজন অধ্যাপক ও ধ্বনিবিশারদ ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল এলিজা গ্রেস বেল। গ্রাহাম বেলের দুই ভাইয়ের নাম যথাক্রমে মেলভিল জেমস বেল এবং এডওয়ার্ড চার্লস বেল। তাঁর জন্মের সময় নাম ছিল আলেকজান্ডার বেল। ১০ বছর বয়সে তিনি নিজেই তাঁর বাবার কাছে আর্জি জানান যে ভাইদের মত তাঁরও একটি মধ্যনাম থাকা উচিত। তাঁর একাদশতম জন্মদিনে কানাডীয় পারিবারিক বন্ধু আলেকজান্ডার গ্রাহামের নামের অনুসরণে ‘গ্রাহাম’ মধ্যনামটি জুড়ে যায় আলেকজান্ডার বেলের নামের সঙ্গে। সেই থেকে তিনি আলেকজাণ্ডার গ্রাহাম বেল নামেই পরিচিত হন। শৈশবে কোনও প্রথাগত তালিম ছাড়াই পিয়ানো বাজানো শিখে নেন গ্রাহাম বেল। তাছাড়া ভেন্ট্রিলোকুইলিজমও শিখে ফেলেছিলেন তিনি। তাঁর মায়ের ক্রমান্বয়ে বধির হয়ে যাওয়া গ্রাহাম বেলকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাঁর মাকে কথা শোনানোর জন্য একটি বিশেষ পদ্ধতিও রপ্ত করে ফেলেছিলেন তিনি। এর ফলেই শব্দবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা ও চর্চা করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন গ্রাহাম বেল। আবার অন্যদিকে তাঁর পরিবারে ঠাকুরদাদা এবং তাঁর বাবাও সুন্দরভাবে কথা বলা ও বক্তৃতা দেওয়ার শিক্ষা দিতেন। এই বিষয়ে তাঁর বাবার লেখা দ্য স্ট্যান্ডার্ড এলোকিউশনিস্ট (১৮৬০) বইটি তাঁকে প্রভাবিত করেছিল। গ্রাহাম বেল এবং তাঁর ভাই তাঁদের বাবার কাছেই সুন্দরভাবে বক্তৃতা লেখা, যে কোনও প্রতীক ও শব্দকে শনাক্ত করা শিখেছিলেন। ক্রমেই লাতিন, স্কটিশ, গথিক ও সংস্কৃত ভাষার উচ্চারণরীতি না জেনেই সেই ভাষাগুলির বক্তৃতা সুন্দরভাবে বোঝাতে পারতেন আঙুলের ভঙ্গিমার মাধ্যমে। পরবর্তীকালে ১৮৭৭ সালে গার্ডিনার গ্রিন হার্বার্ডের ১৫ বছর বয়সী কন্যা মেভেল হার্বার্ডের সঙ্গে বিবাহ হয় গ্রাহাম বেলের।
তাঁর অন্যান্য ভাইদের মত বাবার কাছেই প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ গ্রহণ করেছিলেন আলেকজাণ্ডার গ্রাহাম বেল। তারপরে এডিনবার্গের রয়্যাল হাই স্কুলে ভর্তি হন তিনি এবং মাত্র ১৫ বছর বয়স পর্যন্তই সেখানে পড়াশোনা করেন। স্কুলে পড়াকালীন জীববিজ্ঞানের প্রতি তাঁর সবথেকে বেশি আগ্রহ তৈরি হয়, কিন্তু অন্য বিষয়গুলিতে সেভাবে মনোনিবেশ করতে পারেননি গ্রাহাম বেল। স্কুল ছাড়ার পরে তাঁর ঠাকুরদাদা আলেকজান্ডার বেলের সঙ্গে তিনি হ্যারিংটন স্কোয়ারে বাস করতে শুরু করেন। ১৬ বছর বয়সে গ্রাহাম বেল স্কটল্যান্ডের এলগিনের ওয়েস্টন হাউজ অ্যাকাডেমিতে তাৎক্ষণিক বক্তৃতা ও সঙ্গীতের শিক্ষক হিসেবে কাজে যোগ দেন। এছাড়া তিনি লাতিন ও গ্রিক ভাষাও শিখছিলেন এবং থাকা-খাওয়ার খরচ মেটানোর জন্য তিনি নিজেও ভাষা শেখাতে শুরু করেন। পরবর্তীকালে আলেকজাণ্ডার গ্রাহাম বেল এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৮৬৮ সালে পরিবারের সঙ্গে কানাডা যাওয়ার আগে গ্রাহাম বেল ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। ১৮৭০ সালে পড়াশোনা মাঝপথে থামিয়ে পরিবারের সঙ্গে কানাডায় চলে যান গ্রাহাম বেল এবং তার পরের বছর ১৮৭১ সালে ২৪ বছর বয়সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বোস্টন স্কুল ফর ডিফ মিউটস, ম্যাসাচুসেটসের নর্থ হ্যাম্পটনে ডিফ ক্লার্ক স্কুল এবং কানেক্টিকাটের হার্টফোর্ডের আমেরিকান স্কুল ফর দ্য ডিফ-এ শিক্ষকতা করতে শুরু করেন আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল। ১৮৭২ সালের অক্টোবর মাসে বোস্টনে তিনি নিজে ‘স্কুল অফ ভোকাল ফিজিওলজি অ্যান্ড মেকানিক্স অফ স্পিচ’ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। তরুণী হেলেন কেলার ছিলেন তাঁর একেবারে প্রথম দিককার ছাত্রী। সেই সময় টেলিগ্রাফই যোগাযোগের ক্ষেত্রে একমাত্র প্রতিষ্ঠিত মাধ্যম ছিল, একটি বিশেষ সময়ে বার্তা গ্রহণ ও প্রেরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল এই টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা। শব্দের প্রকৃতি বিষয়ে তাঁর প্রভূত জ্ঞানের মাধ্যমে গ্রাহাম বেল একই সময়ে একই তারের সাহায্যে একাধিক বার্তা প্রেরণের ব্যাপারে কল্পনা করেন। এর আগে ১৯ বছর বয়সে গ্রাহাম বেল ভাষাবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ আলেকজান্ডার এলিসকে একটি চিঠি লিখে মানুষের গলার স্বরকে কীভাবে যন্ত্রের মধ্য দিয়ে আদান-প্রদান করা যায় তা নিয়ে নিজের ভাবনা ব্যক্ত করেছিলেন। সেই চিঠির উত্তরে এলিস জানান যে জার্মানির হারম্যান ভন হেলম্ হোল্টজ এই একই কাজে নিযুক্ত আছেন। জার্মান ভাষায় লেখা হেলম্ হোল্টজের বইগুলি পড়ে এবং তার ছবিগুলি দেখে গ্রাহাম বেল ভেবে নেন যে সঙ্গীত বা ধ্বনিকে বৈদ্যুতিক তরঙ্গে রূপান্তরিত করা সম্ভব এবং এই জন্য গবেষণা করতে শুরু করেন। ফলে ক্রমেই তাঁর এই ‘ভয়েস টেলিগ্রাফ’ বানানোর প্রয়াসে সাড়া দিতে থাকেন নিকটাত্মীয়রা। ১৮৭৩ ও ১৮৭৪ সালের মধ্যে টমাস সন্ডার্স ও তাঁর শ্বশুরমশাই গার্ডিনার হার্বার্ডের আর্থিক সহায়তায় আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল হারমোনিক টেলিগ্রাফ বিষয়ে গবেষণা করতে শুরু করেন। এক্ষেত্রে তিনি প্রস্তাব দেন প্রতিটি বার্তার তীব্রতা ও কম্পাঙ্কের পার্থক্য সৃষ্টি করা দরকার। ক্রমেই তিনি ডট আর ড্যাশের সাহয্যে টেলিগ্রাফিক বার্তা প্রেরণের বদলে মানুষের গলার স্বর প্রেরণের চেষ্টা করতে শুরু করেন। এই গবেষণায় তিনি সেকালের বিখ্যাত ইলেক্ট্রিশিয়ান টমাস এ ওয়াটসনকে নিযুক্ত করেন বিশেষ তড়িৎ-ব্যবস্থা তৈরি করার জন্য। এভাবে দীর্ঘ গবেষণার ফলে টেলিফোন তৈরি হয়। ২৭ বছর বয়সে ১৮৭৫ সালে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল ও তাঁর গবেষণায় বিনিয়োগকারীরা একত্রে পেটেন্ট করানোর সিদ্ধান্ত নেন। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পেটেন্টের জন্য আবেদন করেন গ্রাহাম বেল। কিন্তু সেই বছর একই সঙ্গে একই ফর্মুলা সহ টেলিফোন উদ্ভাবনের পেটেন্টের আবেদন করেছিলেন এলিসা গ্রে। গ্রাহাম বেল এলিসার অনেক আগেই টেলিফোনের ধারণা আনলেও পেটেন্ট পান এলিশা গ্রে। তবে টেলিফোনের পেটেন্ট নিজের নামে করতে প্রায় ৬০০টি মামলা লড়তে হয়েছে গ্রাহাম বেলকে। টেলিফোনে তাঁর বলা প্রথম কথাটি ছিল ‘মি. ওয়াটসন কাম হিয়ার, আই ওয়ান্ট টু সি ইউ’। ১৮৭৬ সালে টেলিফোনের মাধ্যমে বহুদূরের অন্টারিওতে স্বরবার্তা (Voice Messege) পাঠাতে সক্ষম হন তিনি। এই বছরের শেষ দিকে বিনিয়োগকারীরা ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের কাছে এই পেটেন্টটি ১ লক্ষ ডলারের বিনিময়ে বিক্রি করার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সেই সময় তারা এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। পরবর্তীকালে ১৮৭৭ সালে স্থাপিত হয় বেল টেলিফোন কোম্পানি।
তবে শুধু টেলিফোন আবিষ্কারেই আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল সীমাবদ্ধ ছিলেন না। বিজ্ঞান জগতের অন্যান্য দিকেও তাঁর অবাধ যাতায়াত ছিল। টেলিফোন ছাড়া তাঁর আবিষ্কৃত অন্যান্য যন্ত্রগুলির মধ্যে অন্যতম হল ‘ফোটোফোন’ (Photophone)। বর্তমান সময়ে অপটিক্যাল তন্তুর মাধ্যমে আলোর ফোটন কণাকে ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ তথ্য প্রেরণ যে সম্ভব হয়েছে, তার পিছনে আসলে গ্রাহাম বেলের পরোক্ষ অবদান ছিল। ১৮৮০ সালে তিনি এবং তাঁর সহকারী চার্লস সামার টেন্টার ওয়াশিংটন ডিসিতে ২০০ মিটারেরও বেশি দূরত্বে বেতার স্বরবার্তা প্রেরণ করেছিলেন সফলভাবে এবং এই স্বরবার্তাগুলি একটি হালকা রশ্মি দ্বারা বাহিত হয়েছিল যা থেকে ফোটোফোনের ধারণা ও বাস্তবায়ন সম্ভবপর করেন আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল। তার ছাড়া বার্তা পাঠানোর দুই দশক আগেই এই পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন গ্রাহাম বেল। এছাড়া ১৮৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জেমস গারফিল্ডকে গুলি করে হত্যা করার পরে সঠিকভাবে বুলেটটি নিরীক্ষণ করতে একটি ধাতু শনাক্তকরণ যন্ত্র (Metal Detecter) আবিষ্কার করেন। কিন্তু সেই সময় রাষ্ট্রপতির শরীরের অনেক গভীরে থাকায় বুলেটটি শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি এই যন্ত্রের সাহায্যে। তাছাড়া হাইড্রোফয়েল, এরোনটিক্স এমনকি বংশগতিবিদ্যা নিয়েও গভীর চর্চা করেছেন তিনি।
১৮৯৭ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির দ্বিতীয় সভাপতি পদে আসীন হন আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল। ১৯১৭ সালে অন্টারিওতে বেল টেলিফোন মেমোরিয়াল নামে একটি স্মারক মূর্তি স্থাপিত হয় গ্রাহাম বেলের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে।
১৯২২ সালের ২ আগস্ট কানাডার বেইনভ্রেগে ৭৫ বছর বয়সে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের মৃত্যু হয়।