- ইউরিক অ্যাসিড বাড়লে খারাপ। তার জন্য চিকিৎসা আছে, আছে কিছু সঠিক নিয়ম মানার বাধ্যবাধকতা।
- ওষুধ সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কিন্তু পরিমিত জীবনযাপন করলেই ইউরিক অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
- ইউরিক অ্যাসিডে আক্রান্ত প্রায় ৩০ শতাংশ রোগীই অ্যাসিম্পটোম্যাটিক হাইপার-ইউরেসেমিয়াতে ভোগেন।
বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক:
গাঁটে ব্যথা বা ফুলে উঠলে অনেকেই মনে করেন ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে গিয়েছে এবং প্রথমেই প্রোটিন খাওয়া কমিয়ে দেন। তবে আসল বিষয় হল, ইউরিক অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণে কিছু খাবার ছাড়া বেশিরভাগ খাবারই খাওয়া যেতে পারে। কেন বেশি কমে গেলেও ক্ষতি আবার বাড়লেও বিপদ? এই বিষয়ে বিস্তারিত জানালেন ইন্টারনাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
ইউরিক অ্যাসিড বাড়লে খারাপ। তার জন্য চিকিৎসা আছে, আছে কিছু সঠিক নিয়ম মানার বাধ্যবাধকতা। তবে বেশিরভাগই হয়তো মানেন না, আর মানলেও সঠিক জিনিসটা বাদ দিয়ে যেগুলোতে বেশি গুরুত্ব দেন সেটা হয়তো ততটা কার্যকর নয়। আবার এটাও মনে করা ভুল যে ওষুধ খেয়ে ইউরিক অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণে রাখবেন। কারণ, ওষুধ সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কিন্তু পরিমিত জীবনযাপন করলেই ইউরিক অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। অন্যদিকে ইউরিক অ্যাসিডে আক্রান্ত প্রায় ৩০ শতাংশ রোগীই অ্যাসিম্পটোম্যাটিক হাইপার-ইউরেসেমিয়াতে ভোগেন।
এতে কী হয়?
ইউরিক অ্যাসিড বৃদ্ধি পায় কিন্তু কোনওরকম তার লক্ষণ থাকে না। এমন হলে কিন্তু ওষুধ খাওয়ার দরকার পড়ে না। অপ্রয়োজনে ওষুধ খেলে হিতে-বিপরীত হতে থাকে। কারণ, ইউরিক অ্যাসিড একটা শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। সেটা শরীরের কিছু প্রয়োজনেও লাগে। তাই একেবারে কমে যাওয়াও বিপজ্জনক। কারণ, একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে বেশিরভাগ ডিমেনশিয়া অসুখে আক্রান্ত রোগীদের ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা কম। তাই অযথা ওষুধ খেয়ে ইউরিক অ্যাসিড কমাবেন কেন? জানতে হবে কখন ওষুধ, কখন ওষুধ নয়, অন্য পথে সমাধান।
কতটা প্রয়োজন?
ইউরিক অ্যাসিড একটা যৌগ যা পিউরিন নামক যৌগের মেটাবলিজম থেকে তৈরি হয়। পিউরিন সাধারণত উদ্ভিজ ও প্রাণীজ প্রোটিনে বর্তমান। যা থেকে শরীরে পিউরিনের মাত্রা বাড়ে। তবে শরীরের নিজস্ব কোষ ভেঙেও কিন্তু পিউরিন তৈরি হয়। ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় ইউরিক অ্যাসিড। পুরুষ ও মহিলার শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের স্বাভাবিক মাত্রার ফারাক আছে। পুরুষদের ক্ষেত্রে ৪-৮.৫ মিলিগ্রাম প্রতি ডেসিলিটারে ও মহিলাদের ক্ষেত্রে ২.৭-৭.৩ মিলিগ্রাম প্রতি ডেসিলিটারে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা থাকা বাঞ্ছনীয়। এর থেকে বেশি হলে তখন নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন।
বেশি মাত্রায় ক্ষতি কী?
ইউরিক অ্যাসিড ঠিক কোন মাত্রায় গেলে তবে ক্ষতি শুরু হবে সেটা নির্দিষ্ট করে বলা খুব কঠিন। এমনও হয়, ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা ৭, কিন্তু ইউরিক অ্যাসিড জনিত আর্থ্রাইটিসে ভুগছে রোগী। এ ক্ষেত্রে দেখা যায় ইউরিক অ্যাসিডের ক্রিস্টালগুলো শরীরের বিভিন্ন জয়েন্টে জমতে শুরু করেছে। যা থেকে শরীরে প্রদাহ তৈরি হতে থাকে। হঠাৎ করেই রোগী সেই ব্যথা বুঝতে পারেন। যাকে বলা হয় ক্রিস্টাল আর্থ্রাইটিস। দেখা যায় কেউ যদি একদিন একটু অ্যালকোহল বা মদ্যপান করেন ও উচ্চপ্রোটিন যুক্ত খাবার খান তারপর খুব ব্যথা শুরু হয়। সকালে উঠে দেখেন হাঁটতে পারছেন না।
তবে ইউরিক অ্যাসিড থেকে বাতের ব্যথা হয় না। অনেকেই মনে করেন হাঁটুতে কিংবা গা-হাত-পায়ে ব্যথা হলে তার পিছনে হয়তো ইউরিক অ্যাসিড দায়ী। আসলে তা কিন্তু নয়। অনেক অন্য কারণে ব্যথা হয়। সব কিছুতে ইউরিক অ্যাসিড ধরে নেওয়া ঠিক নয়। দেখা যায় অনেকেই বেশি সচেতন হতে গিয়ে প্রথমেই সব খাওয়া বন্ধ করে দেন। এতে করে আরও বেশি ক্ষতি হয়। পর্যাপ্ত প্রোটিনের ঘাটতি দেখা দেয়। আসলে সমস্যা হয়, ইউরিক অ্যাসিড বাড়লে তা থেকে কিডনির খুব ক্ষতি হয়। তাই কারও ইউরিক অ্যাসিড একটু বাড়লেই অর্থাৎ ১০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটারের বেশি ও সঙ্গে কিডনির সামান্যতম সমস্যা থাকলে ইউরিক অ্যাসিড কমানোর ওষুধ খেতে হবে।
যে কারণে বাড়তে পারে বর্তমানে বেশিরভাগ অল্পবয়সিদের দেখা যায় বডিমাস ইনডেক্স খুব বেশি। অর্থাৎ সারাক্ষণ বসে বসে কাজ করার জন্য কায়িক শ্রম খুব কম। তাই ২৫-৩০ বছর বয়সের পর থেকেই সমস্যা শুরু হয়। ওজন বাড়ে বা মেদ জমে, ফ্যাটি লিভার দেখা যায়, রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইড বা কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পায় ইউরিক অ্যাসিডও। ইউরিক অ্যাসিড সাধারণত মেটাবলিক সিনড্রোম। হাঁটাচলা না করা, বসে বসে সারাক্ষণ ফোন বা ল্যাপটপে কাজ, খাদ্যাভ্যাস ঠিক না থাকাই ইউরিক অ্যাসিড বৃদ্ধির কারণ। এসব ক্ষেত্রে কিন্তু ওষুধ দিয়ে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। লাইফস্টাইল পরিবর্তনের মাধ্যমে ইউরিক অ্যাসিডকে ঠিক মাত্রায় আনতে হবে। এটাই একমাত্র পথ।
কখন ওষুধ খাবেন?
শুধুমাত্র ১০-১৫ শতাংশ রোগীর যাঁদের খুব বেশিমাত্রায় থাকে ইউরিক অ্যাসিড তাঁদেরই ওষুধ প্রয়োজন। বেশির ভাগেরই নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের মাধ্যমে অসুখ সারিয়ে ফেলা সম্ভব। এছাড়া কিডনির অসুখ, ডায়াবেটিস রয়েছে, কিংবা হার্টের ওষুধ খেয়ে ইউরিক অ্যাসিড বাড়ছে তখন কিন্তু ওষুধ দ্বারা ইউরিক অ্যাসিডকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
ইউরিক অ্যাসিড মানেই প্রোটিন বাদ নয়
ইউরিক অ্যাসিড মানেই প্রোটিন বাদ নয়। এ ব্যাপারে আমজনতার অনেক আন রয়েছে। ইউরিক অ্যাসিড শুনলেই, টম্যাটো বন্ধ, সমস্ত প্রোটিনে নিয়ন্ত্রণ রেখা জারি ইত্যাদি নানা কিছু চলতে থাকে। তবে সঠিক ধারণা কারও নেই। ভুল হয়ে যায় তাই। নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিনের তথ্য, সামুদ্রিক মাছ, ওয়াইন, বিয়ার আর মেটে ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে যাওয়ার পিছনে সবচেয়ে দায়ী। তাই মাঁদের বেশি তাঁদের এই খাবার গুলো বর্জন করলেই হবে।
তার জন্য উদ্ভিজ প্রোটিন খাওয়া বন্ধ করা পুরো অর্থহীন। উদ্ভিজ প্রোটিন খাওয়ার সঙ্গে ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে যাওয়ার কোনও যোগসূত্র নেই। ইউরিক অ্যাসিড থাকলে অল্প মাত্রায় উদ্ভিজ প্রোটিন অর্থাৎ বিভিন্ন সবজি যেমন টম্যাটো, সোয়াবিন, ডাল বা দানাশস্য খাওয়া যেতেই পারে। তবে মদ্যপান না করাই ভালো। আর নিয়মিত এক্সারসাইজ করতে হবে। ইউরিক অ্যাসিড খুব চেনা অসুখ হলেও ছোটখাটো ভুলগুলো ডেকে আনতে পারে অন্য বিপদ। তাই ঠিকটা জেনে তারপর নিয়ন্ত্রণ করুন।
-সংগৃহীত