Home First Lead লোডশেডিং-এ বিপাকে যশোরের ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প

লোডশেডিং-এ বিপাকে যশোরের ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প

আবদুল কাদের

যশোর: গত কয়েক দিন ধরে যশোরে চলছে  লোডশেডিং। এতে যশোরের গাড়ির যন্ত্রপাতি শিল্পে উৎপাদন চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ৩শ কারখানায় উৎপাদন কমেছে । ঠিকমত অর্ডার নিতে পারছে না কারখানা মালিকরা। বিদ্যুৎ ঘাটতিতে কেউ কেউ বিকল্প ব্যবস্থায় চালাচ্ছেন কারখানা। এতে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন গাড়ি শিল্পের উদ্যোক্তারা।

দেশব্যাপী রুটিন লোডশেডিংয়ে বিপাকে পড়েছে গোটা উৎপাদন খাত। কারখানাগুলোতে সার্বক্ষণিক উৎপাদন চালু রাখার ফার্নেস অয়েল দিয়ে জেনারেটর চালিয়ে উৎপাদন অব্যাহত রাখতে ব্যয় ৩০ শতাংশ বাড়ছে বিভিন্ন শিল্প খাতে। এ অবস্থায় অতিরিক্ত ব্যয় বহন করার সক্ষমতা না থাকায় অনেক কারখানা মালিক বাধ্য হয়ে উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছেন।

শিল্প-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগে থেকেই করোনার কারণে বাজার মন্দা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে ছিলেন তারা। এর মধ্যে চলমান বিদ্যুৎ সরবরাহ সংকট তাদের আর্থিকভাবে পঙ্গু করে দিচ্ছে।

বিগত পাঁচ দশকেও গাড়ি শিল্প বলতে সবই আমদানি নির্ভর ছিল। ক্ষুদ্র যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে গাড়ির বডি (চ্যাসিস) আসতো ভারত থেকে। কিন্তু সেই অবস্থার পরিবর্তন এসেছে। যশোরেই প্রস্তুত করা হয় গাড়ির যন্ত্রাংশ ও বডি। এতে একদিকে যেমন বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে, তেমনি দেশে কর্মসংস্থান হয়েছে।

যশোরের অটোমোবাইলস শিল্পের সুনাম রয়েছে দেশজুড়ে। প্রযুুক্তিগত মেশিনারির ব্যবহার ছাড়াই বিভিন্ন নামি দামি বিদেশি ব্র্যান্ডের গাড়ির বডি তৈরি করে দেশজুড়ে সুখ্যাতি কুড়িয়েছে জেলার ওয়ার্কশপগুলো।

যশোর শহরের বকচর, হুশতলা-মুড়লি মোড়সহ বিভিন্ন এলাকায় আট শতাধিক অটোমোবাইলস ওয়ার্কশপ রয়েছে। এসব ওয়ার্কশপে পাঁচ হাজারেরও বেশি শ্রমিক কাজ করছে। ওয়ার্কশপগুলোতে নতুন বাস-ট্রাকের বডি তৈরি, পুরাতন বডি সংস্কার, রং, ওয়ারিং ও ইঞ্জিন মেরামত কাজ করে প্রতিমাসে কমপক্ষে ১০ কোটি টাকা আয় হয়।

যশোর শহরের বকচরের আল-একলাস হোল্ডিং ওয়ার্কশপের মালিক নুরুজ্জামান শেখ বলেন, জেলার ওয়ার্কশপে কোরিয়ান, জাপানি, ইন্ডিয়ান গাড়ির বডির আদলে বাস-ট্রাকের বডি ও ক্যাবিন বানানো হয়ে থাকে। পুরনো জরাজীর্ণ গাড়ির চ্যাসিসে নতুন করে সংযোজন করা বডি কমপক্ষে ৩০ থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত টেকসই হয়। কিন্তু বর্তমানে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে শ্রমিকরা কাজ করতে পারছে না। এতে সময়মতো কাজ শেষ করতে পারছি না।

যশোর অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি আশরাফুল আলম বলেন, দেশের ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলার গাড়ি মালিকরা বডি তৈরি ও গাড়ির পার্টস কিনতে যশোরে আসেন। বর্তমানে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে তেমন ব্যবসা নেই। আবার বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে পণ্য উৎপাদন করা যাচ্ছে না। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছি আমরা।

ঈগল পরিবহনের সত্ত্বাধিকারী পবিত্র কাপুড়িয়া জানান, যশোরের শ্রমিকরা তৈরি করছে গাড়ির পার্টস ও বডি। যা মানসম্মত। আমাদেরও অনেক গাড়ির বডি, পার্টস এখান থেকে নিয়ে থাকি।
যশোরে শতাধিক গাড়ির পার্টস, স্প্রিংপাতি ও বডি উৎপাদন হচ্ছে। যা আগে সবই আমদানি নির্ভর ছিল। এসব উৎপাদিত গাড়ির পার্টস ব্যবহার করছেন দেশের প্রতিষ্ঠিত পরিবহন ও স্থানীয় রুটের গাড়ির ব্যবসায়ীরা। একই সাথে পাথর ও ইটভাঙ্গা মেশিনও তৈরি করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে পাথরভাঙ্গা মেশিন ভারতে রফতানি করছেন উদ্যোক্তারা। যার বাজার হাজার কোটি টাকা বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

যশোরের গাড়ির পার্টস উৎপাদনকারীদের মধ্যে অন্যতম এনায়েত ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা। প্রতিষ্ঠানটির সত্ত্বাধিকারী মো. আক্তার হোসেন জানান, তাদের কারখানায় শতাধিক গাড়ির পার্টস উৎপাদন করা হয়। যার মধ্যে রয়েছে গাড়ির ব্রেকড্রাম, পেসারপ্লেট, গিয়ারবক্স, ব্রেকডিস্ক, ইঞ্জিন হাউজিং, হ্যাঙ্গার, গিয়ার বক্সের বডি অন্যতম। তিনি বলেন, বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদন অর্ধেকের নীচে নেমে গেছে। সকাল ৬টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত শ্রমিকরা আগে ৫ টন সামগ্রী গালাতেন। কিন্তু এখন সেটি এক থেকে ২ টন হচ্ছে। বিদ্যুৎ থাকছেনা ৪-৫ ঘণ্টা। লোহা, পাত গলোনোর মধ্যে যদি বিদ্যুৎ চলে যায় সেটি আবারও গলাতে হয়। এভাবে আর পারছি না। ব্যয় বাড়লেও উৎপাদন কম হচ্ছে।

উপশহর এলাকায় এসকে মেটাল ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলেন তরুণ উদ্যোক্তা কামরুল হাসান সোহেল। বর্তমানে সেখানে পিকআপের স্প্রিংপাতি উৎপাদন হচ্ছে। প্রতিমাসে গড়ে ২ হাজার ৫শ থেকে ৩ হাজার পিস স্প্রিংপাতি উৎপাদন করছে প্রতিষ্ঠানটি।

কামরুল হাসান সোহেল জানান, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা পেলে স্প্রিংপাতির বাজার আরও বড় করতে পারতাম। কিন্তু এখন চলছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। যেকারণে পণ্য উৎপাদন করতে পারছিনা।

যশোরের রিপন মেশিনারীজের সত্ত্বাধিকারী আশরাফুল ইসলাম বাবু জানান, বর্তমানে তার প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন হচ্ছে স্টোন মিনি ক্রাশার, ইটভাঙ্গা, পাথরভাঙ্গা মেশিন, ইস্পলার, প্রেসার পুলি, লাইনার স্লট প্লেট, পানির পম্প, স্যালো ইঞ্জিনের মেশিনসহ বিভিন্ন ধরণের মেশিনারীজ। ওই প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পাথরভাঙ্গা মেশিন দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি ভারতে রপ্তানি হচ্ছে। অথচ টানা লোডশেডিংয়ের কারণে সেটি কাজে লাগাতে পারছিনা। শুধু রিপন ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসপ না, যশোরে অন্তত ৩শ’ হালকা ও ভারী প্রকৌশল শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যাদের একই অবস্থা।

বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতি যশোর জেলা শাখার সদস্য সিরাজ খান মিন্টু জানান, জেলায় ৩শ’টি হালকা ও ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ২৫টি প্রতিষ্ঠান ভারী শিল্প পণ্য উৎপাদন করছে। বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে সেটি ব্যাহত হচ্ছে। কেউ ঠিকমতো পণ্য উৎপাদন করতে পারছে না।

যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান খান জানান, যশোরের ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প প্রতিষ্ঠান অনেক আগে থেকে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত যন্ত্রাংশ ভালোমানের। লোডশেডিংয়ের কারণে যদি উৎপাদন কমে যায় তাহলে সেটি ভালো খবর নয়, এজন্য সরকারকে শিল্পখাতে বিদ্যুতের লোডশেডিং করা থেকে বিরত থাকতে হবে। সরকারের কাছে শিল্প খাতকে চলমান বিদ্যুৎ বিভ্রাটের আওতার বাইরে রাখার দাবি জানান তিনি।