আলতাফ মাসুদ:
২০১৯-২০ হিসাব বছরের মন্দা কাটিয়ে ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধিতে ফিরে এসেছে দেশের ইস্পাতশিল্প। করোনা মহামারীর প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে ২০২০-২১ হিসাব বছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) ইস্পাতশিল্পের ব্যবসায় উল্লম্ফন দেখা দিয়েছে। চলতি হিসাব বছরের প্রথমার্ধে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ইস্পাত কোম্পানিগুলোর পণ্য বিক্রি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। এতে করে কোম্পানিগুলো নিট মুনাফায় বড় অঙ্কের প্রবৃদ্ধিতে রয়েছে। চলতি হিসাব বছরের প্রথমার্ধের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় এমন তথ্যে এসেছে।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চলতি প্রথমার্ধে ইস্পাতশিল্পে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বিএসআরএম গ্রুপের দুই কোম্পানি বিএসআরএম স্টিলস লিমিটেড ও বাংলাদেশ স্টিলস রি-রোলিং মিলস লিমিটেডের নিট মুনাফা কয়েকগুণ বেড়েছে। ইস্পাত খাতের তালিকাভুক্ত আরেক কোম্পানি জিপিএইচ ইস্পাতের নিট মুনাফা এ সময় দ্বিগুণ বেড়েছে। মূলত মহামারীর সময়ে তুলনামূলক কম মূল্যে কাঁচামাল পাওয়ায় নিট মুনাফায় এমন উল্লম্ফন হয়েছে বলে খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। তবে এখন কাঁচামালের দর অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকায় ভবিষ্যতে মুনাফার ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে কি না, তা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাঁচামালের দর বাড়ায় ইতোমধ্যেই দেশের বাজারে রডসহ বিভিন্ন ইস্পাত পণ্যের দামও ধারাবাহিকভাবে বাড়তে শুরু করেছে।
দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শুরুতে গত ২৫ মার্চ থেকে টানা ৬৬ দিনের লকডাউনে দেশের অন্যান্য শিল্পের মতো ইস্পাতশিল্পেরও উৎপাদন বন্ধ থাকে। এ সময় নির্মাণ কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ক্ষতির মুখে পড়ে শিল্পটি। তবে লকডাউন-পরবর্তী জুন মাস থেকে ধীরে ধীরে অচলাবস্থা কাটতে শুরু করে। সরকারি মেগা প্রকল্প ছাড়াও বেসরকারি খাতের নির্মাণকাজও পুরোদমে চলতে শুরু করে। নির্মাণকাজে গতি আসায় অক্টোবর থেকে ইস্পাত পণ্য বিক্রি বাড়তে শুরু করে। পণ্য মূল্য ও পরিমাণ বাড়তে থাকায় মহামারীর এই প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) ইস্পাত কোম্পানিগুলোর রেভিনিউ বাড়তে দেখা গেছে।
২০২০-২১ হিসাব বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) বিএসআরএম গ্রুপের কোম্পানি বাংলাদেশ স্টিলস রি-রোলিং মিলস লিমিটেড (বিএসআরএম লিমিটেড) ও এর অধীন সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানের পণ্য বিক্রি থেকে আয় হয়েছে ১ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪১ শতাংশ বেশি। মহামারীর সময়ে কাঁচামালের দর তুলনামূলক কম তাই কোম্পানির উৎপাদন ব্যয় কিছুটা কমেছে। এতে করে চলতি দ্বিতীয় প্রান্তিকে কোম্পানির পরিচালন আয় হয়েছে ১৭৩ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৭৬ কোটি টাকা। একই সময়ে সরকারি প্রণোদনার সুফলও পেয়েছে কোম্পানিটি। কম সুদের প্রণোদনার ঋণ পাওয়ায় দ্বিতীয় প্রান্তিকে কোম্পানির সুদবাবদ ব্যয়ও কমেছে। ফলে কর-পূর্ববর্তী মুনাফা হয় ১৫৪ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৪০ শতাংশ বেশি। আর কর পরিশোধের পর চলতি দ্বিতীয় প্রান্তিকে নিট মুনাফা হয়েছে ১০৮ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৩ কোটি ৮৬ লাখ টাকা।
গেল বছর কাঁচামালের দাম কম থাকায় বাংলাদেশ স্টিলস রি-রোলিং মিলস লিমিটেডের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) উৎপাদন ব্যয় কমেছে। এ ছাড়া স্বল্প সুদে প্রণোদনার ঋণ পাওয়ায় সুদবাবদ ব্যয় কমেছে ২৪ কোটি টাকা। এতে করে কর-পূর্ববর্তী মুনাফা হয় ২২৫ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৯৯ কোটি টাকা। আর কর পরিশোধের পর চলতি প্রথমার্ধে নিট মুনাফা হয়েছে ১৫২ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২২৩ শতাংশ বেশি।
চলতি দ্বিতীয় প্রান্তিকে বিএসআরএম গ্রুপের অপর কোম্পানি বিএসআরএম স্টিলস লিমিটেডের পণ্য বিক্রি থেকে আয় বেড়েছে ২৩ শতাংশ। এ সময়ে কোম্পানির বিক্রয়, বিপণন ও সুদবাবদ ব্যয় কমে যাওয়ায় কর-পূর্ববর্তী নিট মুনাফা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৯৩ শতাংশ বেড়েছে। চলতি দ্বিতীয় প্রান্তিকে সুদবাবদ ব্যয় হয়েছে ১৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৫২ কোটি ২২ লাখ টাকা। কর পরিশোধের পর কোম্পানির নিট মুনাফা হয়েছে ৮৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ছিল মাত্র ২ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।
ইস্পাতশিল্পের মুনাফায় উল্লম্ফন প্রসঙ্গে বিএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত জানান, দীর্ঘদিনের লকডাউনের পর নির্মাণশিল্পে গতি আসায় ইস্পাত পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। এতে বিক্রি বেড়েছে। আবার মহামারীর সময়ে গত জুনে তুলনামূলক কম মূল্যে ইস্পাতের কাঁচামাল কেনায় উৎপাদন ব্যয় কমেছে। একই সময়ে সরকারের প্রণোদনার কারণে সুদ ব্যয়ও কমেছে। এসব কারণে মুনাফা বেড়েছে। তিনি জানান, আগের বছরে কম লভ্যাংশ পুষিয়ে নিতে এবার শেয়ারহোল্ডারদের ১০ শতাংশ অন্তর্বর্তী লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে কোম্পানি।
সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় ইস্পাতের কাঁচামালের দর অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে বলে জানান তপন সেনগুপ্ত। গেল বছরের জুনে যে কাঁচামাল ২৬০-২৬৫ মার্কিন ডলারে কেনা যেত তা এখন প্রায় ৫০০ ডলারে উঠেছে। এর ফলে ইস্পাত পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। তবে আমাদের সক্ষমতার কারণে উৎপাদন ব্যয় কিছুটা কমিয়ে আনতে পারি।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত জিপিএইচ ইস্পাতের চলতি প্রথমার্ধে পণ্য বিক্রি থেকে আয় দ্বিগুণ বেড়েছে। এ সময়ে কোম্পানির পণ্য বিক্রি থেকে আয় হয় ১ হাজার ৮৮ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৫৪৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে দ্বিতীয় প্রান্তিকে বিক্রি হয়েছে ৬৪৮ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২৮৪ কোটি টাকা। চলতি প্রান্তিকে কোম্পানিটির সম্প্রসারিত প্রকল্প বাণিজ্যিক উৎপাদনে গেছে। ফলে প্রশাসনিক, বিক্রয়, বিপণন ব্যয় বেড়েছে। এ ছাড়া সুদবাবদ ব্যয়ও বেড়েছে। চলতি প্রথমার্ধে কোম্পানির মোট আয় হয় ১৭২ কোটি টাকা, যেখানে দ্বিতীয় প্রান্তিক থেকে এসেছে ৯৯ কোটি টাকা। দ্বিতীয় প্রান্তিকে জিপিএইচ ইস্পাতের নিট মুনাফা হয়েছে ৪২ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৬ কোটি টাকা। আর চলতি হিসাব বছরের প্রথম দুই প্রান্তিক মিলিয়ে নিট মুনাফা হয়েছে ৬৯ কোটি টাকা, যা অন্যান্য আয় শেষে ৭১ কোটি ৪৭ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। আগের বছরের একই সময়ে অন্যান্য আয়সহ মুনাফা ছিল ৩০ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।
-দেশ রূপান্তর