Home কৃষি উন্নত মানের ব্রয়লারের জাত উদ্ভাবন

উন্নত মানের ব্রয়লারের জাত উদ্ভাবন

মো. ইউসুফ আলী: প্রতিটি মানুষের দৈনিক কমপক্ষে ৫০-৬০ গ্রাম প্রাণিজ আমিষ প্রয়োজন। যেখানে আমাদের দেশ প্রতি দিন গড়ে ১২-১৫ গ্রাম উৎপাদন করতে সামর্থ্য হচ্ছে। সেক্ষেত্রে প্রাণিজ আমিষের চাহিদার মাত্র ২৫ শতাংশ পূরণ হচ্ছে। বাকি ৭৫ শতাংশই রয়েছে ঘাটতিতে। আশির দশক থেকে দেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পোল্ট্রি শিল্পের বিশেষ করে ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন শুরু হলে প্রাণিজ আমিষের ওই ২৫ শতাংশ চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়েছে। পূরণকৃত ওই চাহিদার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আসে ব্রয়লার মুরগির মাংস হতে। ব্রয়লার মুরগি দ্রুতবর্ধনশীল হওয়ায় স্বল্প সময়ে উৎপাদন পাওয়া যায়। সেই সাথে দেশী মুরগি, গরু ও খাসীর মাংস উৎপাদনের চেয়ে কম খরচে স্বল্প সময়ে বেশী উৎপাদন করা যায়। ফলে দেশের দারিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে কম মূল্যে প্রাণিজ আমিষ পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। এছাড়াও ওই শিল্পে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। প্রতি বছর সেই বিনিয়োগ ২০% হারে বৃদ্ধি হচ্ছে। অন্যদিকে বর্তমানে প্রায় ৬০ লক্ষ লোক এই শিল্পের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। ফলে পোল্ট্রি পালনের মাধ্যমে আতœকর্মস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্যতা, বেকারত্ব ও পুষ্টি সমস্যা সমাধানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। এছাড়াও ভবিষতে প্রাণিজ আমিষ জাতীয় খাদ্যে বিশেষ করে ডিম, দুধ ও মাংসের ব্যাপক ঘাটতি পূরণ করে  শিল্পের প্রসারে নেওয়া হচ্ছে নানান সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ। পুষ্টিকর আমিষ জাতীয় উপাদানের মধ্যে ব্রয়লারের মাংস সবচেয়ে স্বাস্থ্যসম্মত, সহজলভ্য ও তুলনামূলক সস্তা। এ শিল্পের অগ্রগতি ও বিস্তারের জন্য প্রয়োজন মান সম্মত ১দিন বয়সের বাচ্চা। যা ব্রয়লারের প্যারেন্ট স্টক থেকে সংগৃহীত ডিম ফুটিয়ে উৎপাদন করা হয়। আর ব্রয়লারের বাচ্চা উৎপাদনে আমাদের নিজস্ব কোন প্যারেন্ট স্টক না থাকায় বাইরের দেশ থেকে প্যারেন্ট স্টক আমদানিতে প্রতিবছর ব্যয় হয় প্রায় ৯০ কোটি টাকা।

অন্যদিকে ব্রয়লারের মাংস অত্যধিক নরম ও দেশী মুরগির মাংসের মত সুস্বাদু না হওয়ায় একশ্রেণীর ভোক্তারা সহজে ব্রয়লারের মাংস খায় না। এসব দিক বিবেচনা করে দেশীয় মুরগির জার্মপ্লাজম ও প্রচলিত উন্নত জাতের সিনথেটিক ব্রয়লারের সমন্বয়ে বাউ-ব্রো-হোয়াইট ও বাউ-ব্রো-কালার নামে ব্রয়লারের দুইটি নতুন জাত উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) পোল্ট্রি বিজ্ঞান বিভাগের একদল গবেষক। যা বাংলাদেশে প্রথম। উদ্ভাবিত ব্রয়লারের জাত দেশে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করলে ওই আমদানি খরচ সাশ্রয় হবে। এছাড়াও নতুন জাতগুলোর রোগবালাই ও মৃত্যুহার কম হওয়ায় দেশীয় লালন-পালন ব্যবস্থাপনায় কম খরচে বিদেশে সিনথেটিক ব্রয়লারের মতই উৎপাদন পাওয়া সম্ভব বলে মনে করেন উদ্ভাবক অধ্যাপক ড. আশরাফ আলী ও  সহযোগী অধ্যাপক ড. বজলুর রহমান মোল্যা।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) এসপিজিআর প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৬৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে পরিচালিত “দেশে প্রাপ্ত মুরগীর জার্মপ্লাজম ব্যবহার করে ব্রয়লারের প্যারেন্ট স্টক উদ্ভাবন’’ শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে চার বছর গবেষণা শেষে  বাউ-ব্রো হোয়াইট ও বাউ-ব্রো কালার নামে ব্রয়লারের জাত দুইটি উদ্ভাবনে সাফলতা পান গবেষকবৃন্দ। নতুন উদ্ভাবিত জাতগুলোর একদিনের বাচ্চার ওজন, খাদ্য রুপান্তর দক্ষতা, ৩৫ দিনে ওজন (১.৫ কেজি) বাজারে প্রচলিত ব্রয়লারের মতই। অপরদিকে মৃত্যু হার কম, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশী এবং লালন-পালন ব্যবস্থাপনা প্রচলিত ব্রয়লারের চেয়ে সহজ ও সাশ্রয়ী। ফলে উৎপাদনে লাভজনক। গবেষণা কাজে সহযোগিতা করেন পিএইচডি শিক্ষার্থী উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা গোলাম আজম।

উদ্ভাবিত ব্রয়লার সম্পর্কে গবেষণার প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. আশরাফ আলী বলেন, আমাদের দেশে বাণিজ্যিক হ্যাচারীগুলো প্রতিবছর কোটি কোটি বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে ব্রয়লারের প্যারেন্ট স্টক বাইরের দেশ থেকে আমদানী করে বাচ্চা উৎপাদন করে ব্রয়লার উৎপাদনের জন্য। অন্যদিকে বাইরে থেকে আমদানীকৃত প্যারেন্ট ব্রয়লার শীতপ্রধান দেশের উপযোগী করে তৈরী হওয়ায় দেশীয় আবহাওয়ায় সাথে খাপ খায়িয়ে নিতে সমস্যা হয়। ফলে শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরের মধ্যে বিশেষ লালন-পালন ব্যবস্থাপনায় ওইসব প্যারেন্ট স্টককে লালন-পালন করায় উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায়। ফলে বাচ্চার দাম তুলনামূলক বেশী। অপরদিকে ঐ সকল স্টকের রোগবালাই বেশী এবং বাইরে থেকে আনার সাথে সাথে বিভিন্ন নতুন নতুন রোগের জীবাণু দেশে বহন করে নিয়ে আসে। যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা (বার্ড ফ্লু)। অন্যদিকে বাজারে প্রচলিত ওইসব ব্রয়লারের মাংস অত্যধিক নরম ও দেশীয় মুরগির মত সুস্বাদু না হওয়ায় অনেকে অপছন্দ করেন। এসকল বিষয় বিবেচনা করে আমাদের নিজস্ব ব্রয়লারের প্যারেন্ট স্টক তৈরী করার লক্ষ্য নিয়ে চার বছর দেশীয় মুরগির জার্মপ্লাজম ও প্রচলিত উন্নত জাতের সিনথেটিক ব্রয়লারের মোরগ-মুরগি থেকে ক্রমানয়ে গুণগত বাছাই ও প্রজননের মাধ্যমে নতুন দুইটি ব্রয়লারের প্যারেন্ট স্টক অথ্যাৎ জাত উদ্ভাবনে সফল হয়েছি। যার উৎপাদন ক্ষমতা দেশের বাইরে থেকে আমদানিকৃত অন্যান্য উন্নতমানের ব্রয়লার প্যারেন্টের সমকক্ষ। মজার বিষয় হল- উদ্ভাবিত প্যারেন্ট স্টকগুলো দেশে প্রচলিত মুরগির ঘরেই লালন-পালন করে কাঙ্খিত উৎপাদন পাওয়া যাবে। কোন শীতাতাপ নিয়ন্ত্রণ ঘরের প্রয়োজন নেই। সেই সাথে প্রয়োজন নেই কোন ব্যয়বহুল টিকাদান কর্মসূচির। অন্যদিকে প্রচলিত ব্রয়লারের মতই আমাদের উদ্ভাবিত ব্রয়লার ৫ সপ্তাহে দেড় কেজি ওজনের হয়ে থাকে। তবে নতুন ব্রয়লার গুলোর মৃত্যু হার কম, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও ড্রেসিং (জীবন্ত ওজন হতে মাংসের শতাংশ) শতাংশ বেশী প্রচলিত ব্রয়লার হতে।

স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত মোরগ-মুরগী এবং প্রচলিত সিনথেটিক জাতের মধ্যে ভাল বৈশিষ্ঠ্য বিবেচনা করে ক্রমাগত  বাছাই ও প্রজননের মাধ্যমে নতুন জাতের ওই  ব্রয়লার প্যারেন্ট স্টক তৈরী করা হয়ে। নিম্নে উৎপাদন পদ্ধতি দেওয়া হল-

ইঅট ইৎড়রষবৎ ঈযরপশবহ উবাবষড়ঢ়সবহঃ ঘবংি ঢ়রপ (১)

উদ্ভাবিত প্যারেন্ট স্টক হতে বাউ-ব্রো হোয়াট ও বাউ-ব্রো কালার বাণিজ্যিক ব্রয়লার উৎপাদন পদ্ধতি-

ইঅট ইৎড়রষবৎ ঈযরপশবহ ওহাবহঃরড়হ ঘবংি ঢ়রপ (২).

গবেষণার সহযোগী গবেষক ড. বজলুর রহমান মোল্যা বলেন, আমাদের দেশে অধিকাংশ ভোক্তাই বাজারে গিয়ে রঙিন মুরগি অর্থাৎ দেশী মুরগি খুঁজে থাকেন। এ বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা দুই ধরনের মাংস উৎপাদনকারী (ব্রয়লার) মুরগির জাত উদ্ভাবন করেছি। দেশীয় মুরগি ও বাজারে প্রচলিত উন্নত মানের সিনথেটিক ব্রয়লারের সাথে মিল রেখেই জাত দুটি উদ্ভাবন করা হয়েছে। বাউ-ব্রো-কালার মুরগির মাংস অনেকটা দেশী মুরগির মত শক্ত প্রকৃতির এবং স্বাদের। অন্যদিকে বাউ-ব্রো-হোয়াইটেরও মাংস প্রচলিত ব্রয়লারের মাংস থেকে তুলনামুলক শক্ত এবং সুস্বাদু। তবে নতুন উদ্ভাবিত ব্রয়লার ও প্রচলিত ব্রয়লারের মাংসের পুষ্টিমানের কোন পাথর্ক্য নেই। বর্তমানে ব্রয়লারের জাত দুইটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত। বাজারে প্রচলিত ব্রয়লারের বাচ্চার চেয়ে কম দামে উদ্ভাবিত ব্রয়লারের বাচ্চা খামারীদের হাতে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। উদ্ভাবিত বাউ-ব্রো হোয়াইট ও বাউ-ব্রো কালার বাণিজ্যিক ব্রয়লারের উৎপাদন ক্ষমতা-

ড. মোল্ল্যা আরো বলেন, বর্তমানে জাত দুইটির আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতির লক্ষ্যে জেনেটিক্সের মলিকুলার পর্যায়ে কিছু কাজ করা হচ্ছে। মূলত, উদ্ভাবিত জাতগুলোর বৈশিষ্ট্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম অটুট থাকবে কিনা তাই পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে দেখা হচ্ছে। তবে অর্থায়নের অভাবে কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে আমরা জাত দুইটির প্যাটেন্ট করার আবেদন করতে পারছি না। দেশের খ্যাতনামা খামারী ও হ্যাচারী মালিকরা যদি আমাদের গবেষণায় অর্থায়নে এগিয়ে আসেন। তবে উদ্ভাবিত ব্রয়লার জাতগুলো দ্বারা দেশের আমদানি নির্ভর ব্রয়লার শিল্পকে রপ্তানী শিল্পে রুপান্তর করা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন। সেই সাথে দেশের প্রাণিজ আমিষেরও ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব।