Home অন্যান্য উপমহাদেশীয় ইতিহাস চর্চায় মুসলিম ঐতিহাসিকদের অবদান ( দ্বিতীয় পর্ব )

উপমহাদেশীয় ইতিহাস চর্চায় মুসলিম ঐতিহাসিকদের অবদান ( দ্বিতীয় পর্ব )

*মুঘল ইতিহাস চর্চার প্রধান বৈশিষ্ট্য আত্মজীবনী রচনা

ড:আহমেদ আবদুল্লাহ

কেবল গতানুগতিক ইতিহাস নয়। এ সময়কালে বেশ কিছু সুফি-সাধক, কবি ও অন্যান্য ব্যক্তিত্বের জীবনচরিত ও ইতিহাসও সংরক্ষিত হয়েছে। যেমন- হজরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতীর দালাইলুল আরেফিন’, খাজা বক্তিয়ার কাকি রচিত ‘ফাওয়াইদুস সালেকিন’, খাজা নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার মালফুজাত আলজালুস শাওয়াহিদ, সাইয়্যেদ আলি সানজারি রচিত ফাওয়াইদুল ফুয়াদ ইত্যাদি।

তুঘলক ও পরবর্তী সুলতানি আমলের ঐতিহাসিকদের প্রসঙ্গে আলােচনা করতে গেলে প্রথমে আবদুল মালিক ইসামির কথা বলে নেয়া যেতে পারে। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৩১১ সালে দিল্লিতে। তিনি ১৩৪৯-৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তার ঐতিহাসিক মহাকাব্য ফতুহ আল সালাতিন রচনা করে তা আলাউদ্দিন হাসান বাহমান শাহের নামে উৎসর্গ করেন।

ইসামি তার এই গ্রন্থে গজনির সুলতান মাহমুদ থেকে শুরু করে ১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ৩৫০ বছরের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন। ইসামি তার ফুতুহ আল-সালাতিন গ্রন্থে দিল্লির সব সুলতান ও শাসকের রাজত্বের ঘটনাবলির যথাযথ মূল্যায়ন করেছেন। জিয়াউদ্দিন বারানি ১২৮৫ খ্রিষ্টাব্দে বারান শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার অমর ইতিহাস গ্রন্থ তারিখ-ই-ফিরােজশাহী। এই গ্রন্থে মােট আটজন সুলতানের এবং প্রায় নব্বই বছরের অধিক সময়কালের ইতিহাসের ঘটনাবলি বর্ণিত হয়েছে। তারিখ-ই-ফিরােজশাহী রচনার পর বারানি ফতওয়া-ই-জাহানদায়ী রচনা করেন।

এ প্রসঙ্গে শামসুদ্দিন সিরাজ আফিফের তারিখ-ই-ফিরােজশাহীর কথা বলে নেয়া যেতে পারে। এই ইতিহাস গ্রন্থে সুলতান ফিরােজ শাহ তুঘলকের সিংহাসন আরােহণকে পক করে (১৩৫১ খ্রি.) তার রাজত্বকালের শেষ (১৩৮৮ খ্রি.) পর্যন্ত রাজনৈতিক ঘটনাবলি এবং তার সাথে ১৩৯৮-৯৯ খ্রিষ্টাব্দে তাইমুর কর্তৃক দিল্লি ধ্বংস পর্যন্ত আরাে ১০ বছরসহ মােট ৫০ বছরের ইতিহাস বিবৃত হয়েছে।

মুসলমানদের এই ইতিহাস চর্চাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যথা- প্রথম সময়কাল ৭১২-১১৯২ পর্যন্ত, দ্বিতীয় সময়কাল ১১৯২-১৫২৬ পর্যন্ত, তৃতীয়  সময়কাল ১৫২৬-১৮৫৮ পর্যন্ত। প্রথম সময়কালে মােহাম্মদ বিন কাসেম হতে শুরু করে গজনির সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানসহ তরাইনের যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা।

দ্বিতীয় সময়কালে সুলতানি আমলের ইতিহাস ।  তৃতীয় সময়কালে মােগল শাসনের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে শুরু করে মােগল শাসনের অবসান পর্যন্ত ইতিহাস চর্চার গতি ও প্রকৃতি।
যা হােক, তুঘলক পরবর্তী ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় যার নাম আসে তিনি ইয়াহিয়া বিন আহমদ সিরহিন্দি। তার রচিত গ্রন্থ তারিখ-ই-মুবারকশাহী।

তিনি তার এই গ্রন্থ সাইয়েদ সুলতান মুবারক শাহের নামে উৎসর্গ করেছেন। এটি দিল্লির সাইয়েদ বংশের ইতিবৃত্ত জানার জন্য একমাত্র আকর গ্রন্থ। তিনি তার এই গ্রন্থে হাসান নিজামীর তাজুল মাসির, মিনহাজ সিরাজ, জুরজানির তাবাকাত-ই-নাসিরি, জিয়াউদ্দিন বারানির তারিখ-ই-ফিরােজশাহী প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে উপকরণ সংগ্রহ করে ১১৯২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৩৫১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত  রাজনৈতিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন তার গ্রন্থে। ইবনে বতুতা মরক্কোর একজন সুপরিচিত পরিব্রাজক।

তিনি এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশ পরিভ্রমণ করে সুলতান আবুল মুজাহিদ মুহাম্মদ বিন তুঘলকের শাসনামলে দিল্লিতে আসেন। তিনি তার ভ্রমণ পথে বাংলাতেও আসেন। ইবনে বতুতা দিল্লির সুলতান কুতুব উদ্দিন আইবেকের সিংহাসন আরােহণ থেকে শুরু করে মামলুক ও খলজি বংশের সুলতানদের রাজত্বকালের প্রধান ঘটনাবলি এবং তুঘলক বংশের গিয়াস উদ্দিন তুঘলক ও মুহাম্মদ বিন তুঘলকের শাসনামলের ঘটনাবলি তুলে ধরেছেন।

ইবনে বতুতা বাংলায় প্রায় এক বছরকাল অবস্থান করেন এবং এই স্বল্পকালীন সময়ে তিনি বাংলার আর্থ-সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে প্রচুর উপাত্ত সংগ্রহ করেন এবং এসব উপাত্ত তার রিহলা বা ভ্রমণ বৃত্তান্তে লিপিবদ্ধ করেন। মুঘলযুগীয় ইতিহাস চর্চায় সর্বপ্রথম যে নামটি সগৌরবে উচ্চারিত হতে পারে সে নামটি বাবরের।

বাবর কেবল একজন যােদ্ধাই নয়, একজন সুপণ্ডিতও ছিলেন। তুজুক-ই-বাবরি রচনা করে তিনি ইসলামের প্রতি তার প্রগাঢ় অনুরাগ ব্যক্ত করেছেন। এই গ্রন্থে বাবরের জীবনের বাল্যকাল থেকে শুরু করে তার যৌবন, সামরিক জীবন, রাজনীতি, যুদ্ধ জীবন সুচারুরূপে বিধৃত হয়েছে। বাবরের তুজুকের এই ঐতিহ্য নিয়ে সম্রাট জাহাঙ্গীর যে তুজুক রচনা করেছেন তা তুজুক-ই-জাহাঙ্গিরী নামে খ্যাত।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, মুঘল ইতিহাস চর্চার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলাে তুজুক বা আত্মজীবনী রচনা।

-লেখক ড. আহমেদ আবদুল্লাহ, জাতি-তাত্ত্বিক জাদুঘরের সহকারি পরিচালক।