ড.আহমেদ আবদুল্লাহ
পূর্বে উল্লিখিত ইতিহাসবিদরা ছাড়াও আরাে বেশ কিছু ইতিহাসবিদের সন্ধান পাওয়া যায়, যারা মুঘল যুগে প্রাদেশিক ইতিহাস চর্চায় উল্লেখযােগ্য অবদান রেখেছেন। প্রথমেই বলা যায়, মুহাম্মদ কাসিমের কথা। মুহাম্মদ কাসিমের সুবিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থ তারিখ-ই-ফেরেশতা।
তিনি তার এই গ্রন্থ রচনা করতে গিয়ে প্রায় ৩৫টি ইতিহাস গ্রন্থ অধ্যয়ন করেছেন। এই গ্রন্থে অঞ্চলভিত্তিক ইতিহাস রচনার ধারাকে অনুসরণ করে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের ধারাবাহিক ইতিহাস রচনার প্রয়াস লক্ষ করা যায়। এ ধারার আরেকটি মূল্যবান গ্রন্থ হচ্ছে মির্জা নাথান রচিত ‘বাহরিস্তান-ই-গায়েবি’।
তিনি ছিলেন যুবরাজ শাহজাহানের সমবয়সী। এই গ্রন্থটি সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে মুঘল বাংলার ইতিহাসের একটি অমূল্য গ্রন্থ। এই গ্রন্থে ১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দে সুবাদার ইসলাম খানের সুবাদার নিযুক্ত হওয়া থেকে শুরু করে ১৬২৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত বিধৃত, যখন যুবরাজ শাহজাহান রাজমহল ত্যাগ করে দাক্ষিণাত্যে চলে যান। মির্জা নাথান তার এই গ্রন্থে বিভিন্ন স্থানের ভৌগােলিক অবস্থান, নৈসর্গিক দৃশ্য, সপ্তদশ শতাব্দীর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনধারা, বিভিন্ন সামরিক অভিযান ও বিদ্রোহ দমন, সুফি সাধকদের প্রসঙ্গসহ অনেক বিষয় উপস্থাপন করেছেন।
মূলত সেই সময়কালের বাংলার ইতিহাসের আকর গ্রন্থ হিসেবে এই গ্রন্থটি সুপরিচিত। ঐতিহাসিক গােলাম হােসেন সেলিম প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান সংগ্রহ করে এসব উপাদানের সাথে দিল্লিকেন্দ্রিক রচিত সুলতানি ও মুঘল পর্বের ঐতিহাসিকদের ফার্সি ভাষায় রচিত গ্রন্থগুলাে থেকে উপাত্ত উপকরণ সংগ্রহ করে রচনা করেন রিয়াজ-উস- সালাতিন গ্রন্থটি। এই গ্রন্থের ওপর ভিত্তি করে চার্লস স্টুয়ার্ড তার History of Bengal’ রচনা করেন।
গােলাম হােসেন সেলিমের রিয়াজুস সালাতিনে সুলতানি আমলের বাংলার ধারাবাহিক ইতিহাস বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। বাংলা অঞ্চলের আঞ্চলিক ইতিহাস রচনার ধারাবাহিকতায় এরপর সাইয়েদ গােলাম হােসেন তাবতাবায়ির নাম উল্লেখ করা যায়। তবে তাবতাবায়ি কিছু ক্ষেত্রে ইংরেজদের পক্ষপাতিত্ব করার জন্য ঐতিহাসিকরা তার সমালােচনা করেছেন।
তিনি বাংলার শেষ ও স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার ওপর কিছু অপবাদ আরােপ করেন, যা গােলাম হােসেন সেলিম নিরপেক্ষভাবে ভ্রান্ত প্রমাণ করেছেন। তদুপরি অষ্টাদশ শতকে বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অনেক উপকরণ পাওয়া যায় তা গ্রন্থে। সবশেষে মুন্সী সলিম উল্লাহর প্রসঙ্গ দিয়ে ইতি টানছি। তিনি ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে মুঘল বাংলার ছয়জন সুবাদারের ৬০ বছরের (১৬৯৬-১৭৫৬) ঘটনাবলি নিয়ে ফার্সি ভাষায় রচনা করেন তার তারিখ-ই-বাংলা।
-লেখক, জাতি-তাত্ত্বিক জাদুঘরের সহকারী পরিচালক