Home বিশেষ প্রতিবেদন এত সোনা কোথায় যায়?

এত সোনা কোথায় যায়?

স্বর্ণ: বছরে চাহিদা ২০ টন, ১৪ মাসে আমদানি ৪২ টন

বাজুসের সহসভাপতি দেওয়ান আমিনুল ইসলাম বলেন, যাত্রীদের মাধ্যমে যে বিপুল পরিমাণ সোনার বার আসে, তার সামান্য অংশই জুয়েলারির দোকানে যায়। দেশে যে পরিমাণ সোনা আসছে, তত বড় বাজার এখনো তৈরি হয়নি।

সালাহ উদ্দিন চৌধুরী:  গত ১৪ মাসে দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে প্রায় ৪২ টন (৩৬ লাখ ভরি) সোনার বার এসেছে। যার বর্তমান বাজারমূল্যে প্রায় ২৪৩ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। অথচ দেশে বাৎসরিক সোনার চাহিদা ১৮ থেকে ২০ টন। দেশে বৈধপথে আসা এসব সোনার বেশিরভাগই এসেছে প্রবাসীদের মাধ্যমে। বিদেশ থেকে ফেরার সময় সঙ্গে করে যাত্রীরা এই সোনা নিয়ে এসেছেন।

সোনা ব্যবসায়ী ও শুল্ক গোয়েন্দাদের মতে, এত সোনার চাহিদা বাংলাদেশে নেই। এই সোনার বড় অংশ বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাচার হয়। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলও বলছে, ভারতে অবৈধভাবে ঢোকা সোনার একটি অংশ যায় বাংলাদেশ থেকে। সংস্থাটি গত ৯ ডিসেম্বর ‘বুলিয়ন ট্রেড : ইন্ডিয়ান গোল্ড মার্কেট সিরিজ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, ভারতে বছরে ১০০ টনের মতো সোনা অবৈধ পথে ঢোকে। যার উৎস বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীন।

জানা যায়, বিদেশ থেকে ফেরার সময় একজন যাত্রী বিনা শুল্কে ১০০ গ্রাম বা সাড়ে আট ভরি পর্যন্ত সোনার গয়না আনতে পারেন। এই সোনার গয়না সাধারণত দেশের বাজারে কেনাবেচা হয়। তবে এই সোনার হিসাব নথিভুক্ত করা হয় না বিমানবন্দরে।

অন্যদিকে যাত্রী (অপর্যটক) ব্যাগেজ বিধিমালা অনুযায়ী, একজন যাত্রী ২৩৪ গ্রাম বা ২০ ভরি সোনার বার শুল্ককর পরিশোধ করে আনতে পারেন। এভাবে আনার ক্ষেত্রে ২০১৯-২০ অর্থবছরে শুল্ক ভরিপ্রতি এক হাজার টাকা কমিয়ে দুই হাজার টাকা নির্ধারণ করে সরকার। তিনটি বিমানবন্দরের কাস্টমসের তথ্য বলছে, সবচেয়ে বেশি সোনার বার আসছে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে।

২০২০ সালের নভেম্বর থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৪ মাসে যাত্রীরা এই বিমানবন্দর দিয়ে ২৫ লাখ ৩৯ হাজার ভরির সমপরিমাণ সোনার বার এনেছেন। একই সময়ে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে আনা হয়েছে ১০ লাখ ২৬ হাজার ভরি সোনা।

সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ছয় মাসের হিসাব পাওয়া গেছে। এতে দেখা যায়, এই বিমানবন্দর দিয়ে এসেছে ৭ হাজার ২৮৭ ভরি সোনা।

তিনটি বিমানবন্দরের তথ্য অনুযায়ী, যাত্রীদের আনা সোনার ৭০ শতাংশই আসছে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। আর প্রতি ভরিতে দুই হাজার টাকা করে ১৪ মাসে সরকার শুল্ক পেয়েছে ৭১৪ কোটি টাকা।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনার মো. ফখরুল আলম বলেন, আগে কখনো এত বেশি সোনা আসেনি। দেশে হঠাৎ করে এত বেশি সোনার চাহিদা তৈরি হওয়ার কথা নয়।

কাস্টমস কর্মকর্তারা জানান, দুবাই থেকে বৈধ পথে সোনা আসছে বেশি। এসব দেশে পাচারকারীর প্রতিনিধি বা এজেন্টরা বাংলাদেশগামী যাত্রীদের বারপ্রতি ১০ হাজার টাকা করে দেয়, সঙ্গে শুল্কের টাকা। এভাবে বাহক হিসেবে কাজ করতে কোনো ঝক্কি নেই বলে যাত্রীরা সহজে রাজি হন। বিমানবন্দরে শুল্ক দিয়ে সোনা ছাড়ানোর পর যাত্রীদের কাছ থেকে তা সংগ্রহ করে পাচারকারীর প্রতিনিধিরা।

বিমানবন্দর দিয়ে বৈধভাবে একজন যাত্রী সর্বোচ্চ ২০ ভরি পরিমাণ সোনার বার শুল্ক দিয়ে আনতে পারেন। সর্বশেষ ১৪ মাসের হিসাবে দেখা যায়, কমপক্ষে ১ লাখ ৭৮ হাজার যাত্রী সোনা এনেছেন। তবে একই যাত্রী বার বার সোনার বার এনেছেন, এমন ঘটনা উদ্‌ঘাটন করেছে কাস্টমস। সূত্র জানায়, তিনটি বিমানবন্দরের কাস্টমসে ব্যবহার হওয়া ‘গুডস ম্যানেজমেন্ট’ সফটওয়্যারের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, একজন যাত্রী তিন মাসে ২০ দফা সোনার বার এনেছেন। অবশ্য এতে কোনো আইনি বাধা নেই।

এদিকে দেশে সোনার চাহিদার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ২০২১ সালে সংশোধিত সোনা নীতিমালায় বলা হয়েছে, দেশে বছরে ১৮ থেকে ৩৬ টন নতুন সোনার চাহিদা রয়েছে। অবশ্য বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) হিসেবে, এ চাহিদা ১৮ থেকে ২০ টন।

দেশে এখন লাইসেন্সধারী ব্যবসায়ীরা সোনার বার আমদানি করতে পারেন। বাংলাদেশ ব্যাংক ১৯টি প্রতিষ্ঠানকে সোনা আমদানির ডিলার হিসেবে লাইসেন্স দিয়েছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, গত দেড় বছরে ৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে আটটি প্রতিষ্ঠান সোনা এনেছে প্রায় ১১৬ কেজি। এর প্রায় অর্ধেক এনেছে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ১১টি প্রতিষ্ঠান সোনা আমদানি করেনি।

বাজুসের সহসভাপতি দেওয়ান আমিনুল ইসলাম বলেন, যাত্রীদের মাধ্যমে যে বিপুল পরিমাণ সোনার বার আসে, তার সামান্য অংশই জুয়েলারির দোকানে যায়। দেশে যে পরিমাণ সোনা আসছে, তত বড় বাজার এখনো তৈরি হয়নি।