Home পর্যটন কবিতীর্থ চুরুলিয়া

কবিতীর্থ চুরুলিয়া

চুরুলিয়া

রত্না ভট্টাচার্য্য
শক্তিপদ ভট্টাচার্য্য

বিদ্রোহী কবি  কাজী নজরুল জন্মগ্রহণ করেছিলেন বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া নামক এক অখ্যাত গ্রামে। চুরুলিয়া আজ আর তত অখ্যাত নয়, বরং নজরুলের জন্মস্থান হওয়ার সুবাদে জায়গাটি কবিতীর্থ চুরুলিয়া নামে খ্যাতি পেয়েছে। কবির জন্ম ১৩০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ (ইংরাজির ২৪ মে, ১৮৯৯)।

কবির শৈশব ও কৈশোর কেটেছিলো এই গ্রামে। অন্যান্য জায়গা ও কলকাতায় থাকার পর তাঁর শেষ জীবন কাটে ঢাকায়। চুরুলিয়ায় গড়ে উঠেছে নজরুলের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র নিয়ে একটি সংগ্রহশালা। এখানে তাঁর শৈশবের শিক্ষাদীক্ষা, আরবী, ফারসি শেখার চেষ্টার কথা, লেটোর দলের গান, যৌবনে সেনাবাহিনীতে যোগদানের কথা, আজীবনের কর্মধারা প্রতিফলিত হয়েছে বিভিন্ন রঙিন চিত্রাবলিতে। চিত্রগুলি ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজের একদা অধ্যক্ষ বিজন চৌধুরির দ্বারা অঙ্কিত।

সাদা কালো নানা আলোকচিত্র, পাণ্ডুলিপি ও চিঠিপত্র সযত্নে রাখা আছে। রয়েছে বিভিন্ন সময়ে প্রাপ্ত কবির বিভিন্ন পুরস্কার, পদকের সম্ভারের মধ্যে জগত্তারিণী পদক ও মানপত্র, পদ্মভূষণ পদক ও মানপত্র। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট কবির মৃত্যু ও পরবর্তী শবযাত্রার আলোকচিত্র। রয়েছে নানা ধরনের বস্ত্র, বাদ্যযন্ত্র, ব্যবহারিক জিনিসপত্র, আসবাব মায় গ্রামাফোন, তানপুরা ইত্যাদি। ব্যবহৃত জিনিসগুলির অধিকাংশ দিয়েছেন কবির কনিষ্ঠ পুত্রবধূ কল্যাণী কাজী। এই সংগ্রহশালার কয়েকটি শো-কেস দিয়েছেন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল কর্তৃপক্ষ।

নজরুল অ্যাকাডেমি প্রতিদিন খোলা থাকে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা, দুপুর ২টা থেকে ৫টা পর্যন্ত। সংগ্রহশালাটি পা রাখল ৫৯ বছরে। নজরুল অ্যাকাডেমির পাশেই রয়েছে নজরুলের পাঠশালা যেখানে তিনি শৈশবে পড়াশোনা করেছিলেন।

এছাড়া আরো একটি দ্রষ্টব্য হল সমাধিস্থল। এখানে রয়েছে কবির পাথরের পূর্ণাবয়ব মূর্তি। কবি ও কবিপত্নী প্রমিলাদেবীর সমাধি রয়েছে পাশাপাশি। কবির কবরের মাটি আনা হয়েছে ঢাকা থেকে। মাটি নিয়ে আসেন বিপ্লবী গণেশ ঘোষ ও কাজী সব্যসাচী। সব্যসাচী কবির জ্যেষ্ঠপুত্র ও আবৃত্তিকার ছিলেন।

সমাধি উদ্যানের প্রস্তরের স্মৃতি ফলকটি স্থাপিত হয় ১৯৯৮ সালে। মূর্তিটি স্থাপন করেছে স্টিল অথরিটি অফ ইন্ডিয়া লিমিটেড (SAIL ) এর অধীনস্থ ইসকো স্টিল প্ল্যান্ট। ব্ল্যাকস্টোনের স্মৃতিসৌধের ফলকটিতে রয়েছে অগ্নিবীণার ছবি। এছাড়াও কাজী পরিবারের অন্যান্যদের কবর ও স্মৃতিফলক রয়েছে। টাউন লাইব্রেরি, প্রমীলা মঞ্চ এবং নজরুল বিদ্যাপীঠ রয়েছে।

প্রমীলা মঞ্চটি দেখার মতো। কোনও মঞ্চ যে এত বড় হতে পারে তা এটি না দেখলে বিশ্বাসই হয় না। বিদ্যাপীঠের সামনে তোরণদ্বারটিও দেখার মতো। বিশাল তোরণদ্বারের চারপাশে কবিতার ফলক আটকানো।

গ্রামে ঢোকার মুখে রয়েছে প্রমীলাদেবীর নামে স্বাস্থ্য কেন্দ্র। নজরুলের জন্মদিন উপলক্ষে নজরুল অ্যাকাডেমি প্রতিবছর ১১ জ্যৈষ্ঠ থেকে শুরু করে সপ্তাহব্যাপী নজরুল মেলার আয়োজন করে। প্রমীলা মঞ্চে সন্ধে থেকে ভোর রাত পর্যন্ত নানা দিন নানা বিষয়ে অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। বাংলাদেশ, আসাম এবং আরও নানা জায়গা থেকে বহু গুণী ব্যক্তিরা এই অনুষ্ঠানে যোগ দেন। তখন ত্রৈমাসিক পত্র অণ্বেষা ও কবির অন্যান্য গ্রন্থাবলী এখানে পাওয়া  পাওয়া যায়।

চুরুলিয়ার আর একটি দর্শনীয় স্থান হল নরোত্তম নামে এক নৃপতির গড় বা দুর্গ। এই গড়ের অংশবিশেষ এখনও দেখা যায়।

আসানসোল থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরের চুরুলিয়ায় গাড়ি ভাড়া করে আসা যায় অথবা আসানসোল বাসস্ট্যান্ড থেকে চুরুলিয়াগামী মিনিবাসে চৌধুরিপুকুর স্টপে নামতে হবে।

চুরুলিয়া থেকে ঘুরে আসা যায় অজয় নদের ধারে ছোট্ট জঙ্গল সর্ষেতলি। ওপারে বীরভূম। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের বিট অফিস। নানা ধরনের বুনো ফুলের গাছ আর পাখির ডাক মনকে উদাস করে দেয়।

একবেলার জন্য বেড়িয়ে আসা কিংবা পিকনিক করার পক্ষে আদর্শ স্পট। নির্জন অথচ নিরুপদ্রব। ফাঁকা জমি, নদীর জল, ঝিঁঝিঁর ডাক, উন্মুক্ত বাতাস সবই মেলে এই সর্ষেতলিতে। সর্ষেতলিতে থাকার ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই।

চুরুলিয়া থেকে দোমহানি, পূঁচড়া হয়ে কেলেজোড়া স্বাস্থ্য কেন্দ্র হয়ে পাশের রাস্তা দিয়ে দুই কিলোমিটার মতো গেলেই পড়বে পানিফলা উষ্ণ প্রস্রবণ। এটি পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় উষ্ণ প্রস্রবণ, বক্রেশ্বরের পরেই এর স্থান। দ্বিতীয় স্থানাধিকারী হয়েও সে আজ বড়ই অবহেলিত। কিন্তু একসময় এই প্রস্রবণকে মধ্যমণি করে গড়ে উঠেছিল একটি সুন্দর মনোরম পার্ক। স্থানের সঙ্গে পার্কটিকেও মানানসই একটি নাম দেওয়া হয়েছিল। তা হল নিরালা পার্ক। একে ঘিরে গড়ে উঠেছিল বাচ্চাদের পার্ক, পিকনিকের শেড, ফুলের বাগান।

দিনে দিনে জায়গাটি ভ্রমণকারীদের কাছে প্রিয়ও হয়ে উঠেছিল। কিন্তু কোনও ভালো জিনিষের মেয়াদ বোধহয় বেশিদিন নয়। তাই কিছু অপ্রীতিকর ঘটনার জন্য আজ সবই খাপছাড়া। ধূসর অতীতকে বুকে নিয়ে উষ্ণ প্রস্রবণ এখনও গরম জল উগরে দিচ্ছে। সেটি একটি বাঁধানো জায়গার মধ্যে রয়েছে। গাছগাছালিতে ছাওয়া জায়গাটি এখনও বেশ মনোরম। উৎসাহী পর্যটকরা গেলে আনন্দই পাবেন।

উষ্ণ প্রস্রবণকে ঘিরে সারা ভারতবর্ষ এবং বিদেশেও পর্যটনের রমরমা কিন্তু এটিকে ঘিরে নতুন কোনও ভাবনাচিন্তা কেন হচ্ছে না সেটাই আশ্চর্যের বিষয়।

কেলেজোড়া থেকে একসময়ের সমৃদ্ধ গ্রাম পূঁচড়া ঘুরে আসা যেতে পারে। গ্রামের নামটি অদ্ভুত ঠেকলেও নামের উৎস জানলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসবে।

জৈন আচারঙ্গ সূত্র থেকে জানা যায় প্রাচীনকালে জৈনধর্ম ছড়িয়ে পড়েছিল এই রাঢ অঞ্চলে। জৈনদের ২৪তম তীর্থঙ্কর বর্ধমান মহাবীর পদব্রজে রাঢ অঞ্চল পরিভ্রমণ করেছিলেন। সেই সময় মহাবীর এই গ্রামে কিছুদিন কাটিয়েছিলেন। এই স্থানে মহাবীরের সময় অতিবাহিত করার স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য গ্রামের পাঁচটি জায়গায় চূড়া তৈরি করা হয়েছিল। এই পাঁচটি চূড়ার জন্য গ্রামের নাম হয় পঞ্চচূড়া, তা থেকেই ক্রমে ক্রমে পূঁচড়া হয়েছে।

পাঁচটি চূড়ার চারটিই অবলুপ্ত, কেবল একটি চূড়ার ধবংসাবশেষ আজও দেখা যায়। জৈন ধর্মের মানুষের কাছে প্রাচীনকালে পূঁচড়া তীর্থবিশেষ ছিল।

বর্তমানে পূঁচড়ায় গেলে জৈনধর্মের বহু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায়। গ্রামে ১৯৭৭ সালে জৈনধর্মের সড়াক সম্প্রদায় কর্তৃক স্থাপিত পূঁচড়া ভগবান মহাবীর দিগম্বর জৈন হাইস্কুল আছে। বিদ্যালয়ের ভিতরে রয়েছে শ্রীমহাবীর জৈন মন্দির। এই মন্দিরে বেশ কিছু প্রাচীন তীর্থঙ্করের মূর্তি আছে। এই মূর্তিগুলি গ্রামেরই আনাচকানাচ থেকে সংগৃহীত। স্কুলটি পূঁচড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের উল্টোদিকে। গ্রামের রাজাপাড়ায় ধানক্ষেতে ধ্বংসপ্রাপ্ত মহাবীর ও আদিনাথের মূর্তি প্রোথিত অবস্থায় আছে।

গ্রামের শিবস্থানে শিবলিঙ্গের সঙ্গে পার্শ্বনাথ সহ কিছু মূর্তি দেখা যায়। ষষ্ঠীতলায় খোলা আকাশের নীচে পাঁচিলের সঙ্গে অনেক মূর্তি গেঁথে দেওয়া আছে। আজ সব স্মৃতি হলেও গ্রামটি ভারী সুন্দর, ঘুরে বেড়াতে মন্দ লাগবে না। চুরুলিয়ায় নজরুল যুব আবাসে থাকার জন্য অন লাইনে বুকিং এর ঠিকানা – youthhostelbooking.wb.gov.in