মতামত:
অলোক আচার্য
যারা বাসা ভাড়া করে থাকতেন তারা বাসা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাচ্ছেন শুধু বাসা ভাড়ার খরচ বাঁচাতে। সামান্য খরচ বাঁচাতে গিয়ে নতুন পরিকল্পনা তৈরি করতে হচ্ছে। হয়তো তার সন্তান যে স্কুলে পড়ালেখা করত সেখানে আর তারা পড়তে পারবে না। করোনাভাইরাস পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের জীবিকায় প্রভাব ফেলছে। এই প্রভাব পরছে মূলত নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জীবনযাত্রায়। ফলে মানুষ জীবনযাপন প্রক্রিয়া বদলাতে বাধ্য হচ্ছে। বিশেষ করে বেসরকারি চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে চাকরিচ্যুতি, কম বেতনে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। কর্মী ছাঁটাই যেন করোনাকালে একটি নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। করোনার কারণে অর্থনীতিতে যে পরিবর্তন আসতে চলেছে তা খুব দ্রুতই শেষ হবে না। পরবর্তী দশকে অর্থনীতির এ ধারা বিশ্বকে ভোগাবে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব নিয়ে চিন্তা করতে হবে কয়েকটি দিক থেকে। বিবিসি রেডিওতে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ম্যালপাস বলেন, করোনাভাইরাস বিশ্বের ৬ কোটি মানুষকে নতুন করে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে ঠেলে দিতে পারে। এ ৬ কোটির বেশি মানুষকে প্রতিদিন এক ডলারের কম অর্থ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে হতে পারে। তিনি আরও বলেন, করোনাভাইরাস অর্থনীতির জন্য এক বিধ্বংসী আঘাত। এটি ঠেকাতে লকডাউন শতকোটি মানুষের জীবন ও জীবিকায় প্রভাব ফেলেছে যা উদ্বেগজনক। তিনি আরও বলেন যে দরিদ্র দেশগুলোর মানুষ শুধু বেকারই নয়, অনানুষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্রও হারাচ্ছে।
বিশ্বব্যাংক ও তার সহযোগীরা ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে, তবে এটা যথেষ্ট নয় বলে তিনি মনে করেন। দরিদ্র দেশগুলোর জন্য ঋণ ও ত্রাণ দেয়ার আহ্বান জানান তিনি। দারিদ্রতা মানুষের এমন এক অবস্থা যে তা থেকে মুক্তি পেতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন দরকার হয় এবং সেই সঙ্গে প্রয়োজন হয় পর্যাপ্ত সুযোগের। প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টি করাটাও সময়সাধ্য। কারণ এরই মধ্যে নতুন করে চাকরিরর বাজারে প্রবেশে অপেক্ষায় থাকবে অনেক মানুষ। পোশাক শিল্পে কর্মী ছাঁটাই হচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছরের মার্চের মাঝামাঝি থেকে ৭ এপ্রিল পর্যন্ত পোশাক খাতে প্রায় ২২ লাখ শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। সব মিলিয়ে করোনা কারণে ৭ কোটি মানুষ কর্মহীন এবং দারিদ্র্যসীমায় রয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সরকারি হিসেবে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। করোনার কারণে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা আরও ২২ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়ে হবে ৪৩ শতাংশ। করোনার কারনে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর চাপ বেড়েছে। অবস্থা এমন যে দারিদ্র্যতা আরও দরিদ্র্যতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অর্থাৎ নিম্ন আয়ের মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। যা দারিদ্র্য সমস্যাকে আরও প্রকট করবে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) এর পূর্বাভাস মতে, চলতি অর্থবছরে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি কমে ২ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসতে পারে। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, করোনার কারণে সাধারণ মানুষের আয় কমে দেশে দারিদ্র্র্যের হার বেড়ে হয়েছে ৩৫ শতাংশ। এর পাশাপাশি বেড়েছে আয় ও ভোগ বৈষম্য। মন্দার যে পূর্বাভাস বইতে শুরু করেছিল তা শুরু হয়ে গেছে। এবারের বিশ্ব মন্দা ছাড়িয়ে যাবে ২০০৯ সালের মন্দাকেও। জীবনধারা পরিবর্তনের এই ধারা রোধ করা বা এর লাগাম টেনে ধরা সহজ হবে না। কারণ সবার জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা বরাবরই একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়। সেক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় যেমন যারা করোনার পূর্বেই বেকার ছিল, করোনার সময়ে যারা চাকরি হারিয়ে বেকার হলো এবং যারা আগামীতে চাকরির বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আসছে এই তিন দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবতে হবে। অর্থাৎ একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। করোনাকালের মহামারি আর কতদিন পৃথিবীতে বিরাজ করবে তা বলা সম্ভব না। কয়েকটি দেশের ভ্যাকসিন ট্রায়ালে রয়েছে। হয়তো খুব দ্রুতই চূড়ান্ত সাফল্য আসবে। ততদিনে নতুন করে দারিদ্র্যের শিকার হবে আরও বহু মানুষ। জীবনযাপন পরিবর্তন করতে বাধ্য হবে। চেনা শহর ছেড়ে নতুন ঠিকানায় পাড়ি জমাবে। সবকিছুই চলবে পরিবর্তনের নতুন ধারায়।
সৌজন্যে: দৈনিক সংবাদ
[লেখক : সাংবাদিক]
sopnil.roy@gmail.com