জয়িতা দাস
আর দশটা বড় শহরের মতো কলকাতায়ও তখন ক্রীতদাস ব্যবসার মস্ত রমরমা। খুলে আম হাটে-বাজারে মানুষ বিক্রি হচ্ছে। আবার নিজেদের পছন্দের কথা জানিয়ে অনেকে বিজ্ঞাপনও দিতেন। যেমন দিয়েছিলেন সেই শৌখিন সাহেব। ‘ক্যালকাটা জার্নাল’-এ। তা সাহেবকে কেন শৌখিন বলছি, সে তাঁর বিজ্ঞাপনের বয়ান পড়লেই বুঝতে পারবেন—
‘দু’জন কাফ্রি ক্রীতদাস চাই। অবশ্যই ফ্রেঞ্চ হর্ন বাজানোয় দক্ষ হতে হবে। অন্যথায় ক্রেতার বিভিন্ন কাজ, গৃহকর্ম ও কুকের কাজ সামাল দিতে পারবে, এমন লোক হলেই চলবে। তবে সুরায় আসক্ত কাউকে খরিদ করা হবে না।’
তা কলকাতার সাহেবপাড়ায় তখন এমন শৌখিন সাহেবদের ছড়াছড়ি। প্রত্যেকের শখ আলাদা, মেজাজও আলাদা। অতএব বিজ্ঞাপনের ভাষাও আলাদা। কেউ নেহাতই ঘরের কাজকর্ম সামাল দেওয়ার জন্য ক্রীতদাস খুঁজছেন তো অন্যজন খুঁজছেন ফ্রেঞ্চ হর্ন বাজিয়ে। এ দিকে এ দেশের পাততাড়ি গুটিয়ে স্বদেশে ফেরার জাহাজ ধরার আগে অনেকেই পছন্দের ক্রীতদাসটিকে বিক্রি করে দিতেন। এ ভাবেই, কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে। সেই সব বিজ্ঞাপনে লেখা থাকত, ‘To be Sold– Two French Horn men, who dress hair and shave, and wait to table.’ অথবা, এক ‘fine Coffree boy’-এর সন্ধান দেওয়া হচ্ছে, যে কি না বাটলার, খিদমতগার আর কুকিংয়ের কাজে ওস্তাদ।
কেউ কেউ আর একটু বিস্তারিতভাবে, অর্থাৎ দরেরও স্পষ্ট উল্লেখ করতেন। যেমন ওই বাটলার, খিদমতগার আর কুকিংয়ের কাজে ওস্তাদ ক্রীতদাসটির জন্য তাঁর প্রভু দর হাঁকিয়েছিলেন চারশো সিক্কা।
সে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস বলে। দেশীয় ক্রীতদাস আরও কম দামে মিলত। আসলে বয়স আর কে কেমন কাজ করতে পারবে, সেই বুঝে দর ঠিক হত। অল্পবয়সী দেশীয় মেয়ে কিনলে দাম পড়ত ষোলো থেকে একশো টাকা। ১৮৩১ সনের ফেব্রুয়ারি মাসের ‘বেঙ্গল ক্রনিকল’ দিচ্ছে এই তথ্য। মির্জা হাদি রুসওয়ার ‘ওমরাও জান’-এর কথা মনে পড়েছে কি? অনেক দরাদরির পর হুসেনি ওরফে ওমরাও জানকে খানমজান খরিদ করেছিলেন একশো পঁচিশ টাকা দিয়ে।
তা দেশীয় ক্রীতদাসদের দাম কম হওয়ার কারণও ছিল। দূর বিদেশ থেকে তো আর এদের আমদানি করতে হচ্ছে না! এরা সব কলকাতার আশপাশেরই গাঁ-গঞ্জের মানুষ। অভাব সইতে না পেরে কয়েক মুঠো চালের বিনিময়ে হয়তো নিজেদের বা পরিবারের অন্য কোনও সদস্যকে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। আবার চুরি করেও দাস সংগ্রহ করা হত। বাচ্চাদের, এবং মেয়েদেরও। ১৯০৮ সনে প্রকাশিত ক্যালকাটা হিস্টোরিক্যাল সোসাইটির জার্নালের একটি প্রবন্ধে এমন কথাই বলা হয়েছে। গঙ্গার ঘাটে তখন বিশাল বিশাল সব জাহাজ এসে ভিড়ছে। কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস নিয়ে। পাশাপাশি ভিড়ছে বড় বড় নৌকাও। চুরি করা বাচ্চা আর মেয়েতে ভর্তি সেই নৌকা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি খুশি। প্রতিটি ক্রীতদাস পিছু তারা যে চার টাকা চার আনা করে ট্যাক্স আদায় করছে। আবার নিজেরাও কখনও কখনও সরাসরি বিক্রি করত ক্রীতদাস।
না, এই তথ্যে কোনও খাদ মেশানো নেই। কৃষকের বকেয়া খাজনা জমেছে! আদায় হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই! অতএব বিক্রি করে দাও এদের। এই নিয়ে সেকালে হইচই কম হয়নি। অবশেষে চাপের মুখে নতি স্বীকার করতেই হয়। বন্ধ হয় কৃষক বিক্রি। ১৮১৯ সালে, এক আইন পাস করে।
এ দিকে ওয়ারেন হেস্টিংস চালু করেছিলেন আর এক নতুন নিয়ম। দেশে তখন ঠগি আর ডাকাতদের মস্ত উৎপাত। ইংরেজরা রীতিমতো নাস্তানাবুদ। ভয় দেখাতে ডাকাত ধরা পড়লেই ফাঁসি দেওয়া হত। অবশ্যই অপরাধ প্রমাণিত হলে। আর ফাঁসি দেওয়া হত নিজের গ্রামেই। পরিবার-পরিজনদের সামনে। এর পরের নিয়মটা ছিল ভয়ঙ্কর। শুধু ডাকাত নয়, হেস্টিংস তার পরিবারকেও শাস্তি দেওয়ার নিয়ম চালু করেছিলেন। কী সেই শাস্তি! কোম্পানির ক্রীতদাসের খাতায় ঠাঁই পেত ডাকাতের পরিবারের সমস্ত সদস্যের নাম।
আর যারা ডাকাত নয়, কিন্তু দাগি আসামি! এদেরও বিক্রি করে দেওয়া হত ক্রীতদাস হিসেবে। বিদেশের বাজারে। এর জন্য সুমাত্রায় তৈরি হয়েছিল এক দুর্গ— মার্লবরো ফোর্ট। কোম্পানির ব্যয় সংকোচের জন্যই নাকি এমন ব্যবস্থা! এতে আসামিদের রক্ষণাবেক্ষণের খরচটাও বাঁচে, আবার বেশ দু’পয়সা আয়ও হয়। কোম্পানি কর্তৃপক্ষ খুশি।
তা কেমন ছিল কলকাতার এই ক্রীতদাসদের জীবন! যেমন হয়। প্রচণ্ড অত্যাচার করা হত। সেই অত্যাচারে প্রাণ যেত অনেকেরই। আর যারা একটু সাহসী, তারা সুযোগ পেলে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত। তখন আবার ক্রীতদাসের সন্ধান চাই বলে কাগজে কাগজে বিজ্ঞাপন। পলাতকের বিস্তৃত বর্ণনা দিয়ে। এমনই এক পলাতকের সন্ধান পেতে বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল কাগজে। সেই বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘বয়স বছর কুড়ি। বেশ ফর্সা আর লম্বা। তবে রোগা। আর মুখে বসন্তের দাগ।’ এর পরই বিজ্ঞাপনদাতা অনুরোধ করেছেন, ‘It is requested that no one after the publication of this will employ him as a writer, or in any other capacity…’
অনেকে আবার পলাতকদের ধরে দিতে পারলে পুরস্কারও দিতেন। যেমন আমাদের চায়না বাজারের জনৈক রবার্ট ডানকান। তাঁর বছর বারোর ক্রীতদাসটিও পালিয়ে গিয়েছিল। ছেলেটির নাম ইণ্ডে। এই ইণ্ডের সন্ধান পেতে সোনার মোহর ইনাম দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন সাহেব।
এমন অজস্র বিজ্ঞাপন ছড়িয়ে আছে সেকালের কাগজপত্রে। পুরনো নথিপত্রে ঘাঁটলে ক্রীতদাসের উপর অত্যাচার সংক্রান্ত মামলারও হদিশ পাওয়া যাবে। জানা যাবে মারিয়া ডেভিসের কীর্তিকলাপের কথাও। ক্রীতদাসী নাসিবানের উপর এমন নির্যাতন করেছিলেন মেমসাহেব যে, এর জল গড়ায় আদালত অবধি। সে ১৮২৮ সনের কথা।
এ দিকে পৃথিবী জুড়ে তখন এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। আর একটা সময় অন্যান্য দেশের মতো ব্রিটিশ ভারতেও দাস প্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। উনিশ শতকের মধ্যপর্বে।
নিষিদ্ধ হয়। তাতে কলকাতার কলঙ্ক মুছে কি! একদিন এই জঘন্য প্রথা ডালপালা ছড়িয়েছিল তার জঠরেও, কলকাতা সে কথা অস্বীকার করে কী করে! খবরের কাগজে, বিজ্ঞাপনে, পুরনো নথিপত্রের সঙ্গে লেপটে থাকা ইতিহাস সুযোগ পেলেই সেই পুরনো স্মৃতির কথা মনে করিয়ে দেয় তাকে। অতএব, সুন্দরী কলকাতাকে এই কলঙ্ক নিয়েই বেঁচে থাকতে হয়। চাঁদের মতো।