বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি
ব্রাক্ষণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার ’শুটকি পল্লী’ নামে খ্যাত লালপুরে চলছে শুটকি বানানোর ধুম। প্রতি বছর কার্তিক মাস থেকে শুরু করে চৈত্র মাস পর্যন্ত উপজেলার লালপুর ইউনিয়নের লালপুর গ্রামে মেঘনা নদীর তীরে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশে দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন মাছের সিঁদল (চ্যাপা) ও শুকনা শুটকি তৈরি করা হয়। মাছ শুকানোর জন্য মেঘনা নদীর তীরে প্রায় ২ কিলোমিটার এলাকায় বাঁশ দিয়ে ৫/৬ ফুট উঁচু করে বিশেষ ধরনের শতাধিক মাঁচা (স্থানীয় ভাষায় ডাঙ্গি) তৈরি করা হয়েছে। লালপুরের তৈরি শুটকি গুনে-মানে ভালো এবং সুস্বাদু হওয়ায় রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রাম, হবিগঞ্জ, ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়িসহ বেশ কয়েকটি জেলায় এখানকার তৈরি শুটকি সরবরাহ করা হয়। এছাড়া লালপুরের শুটকি মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপ-আমেরিকায়ও রপ্তানি করা হয়।
লালপুরের শুটকি উৎপাদনকারীরা জানান, প্রতি মৌসুমে লালপুরে প্রায় শত কোটি টাকার শুটকি উৎপাদন ও বিক্রি করা হয়। শুটকি উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণনে কাজ করেন কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ হাজার লোক। তবে মাছের স্বল্পতা, শুটকি উৎপাদনের শ্রমিক ও অন্যান্য উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি, শুটকি উৎপাদনকারীদের পুঁজি স্বল্পতার জন্য লাভের বিরাট অংশ চলে যায় মধ্যস্বত্ব ভোগীদের পকেটে। ফলে ন্যায্য মুনাফা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন শুটকির প্রান্তিক উৎপাদনকারীরা। শুটকি উৎপাদনকারীদের দাবি, তাদের সহজ শর্তে ব্যাংক থেকে ঋণ দিলে এবং শুটকি সংরক্ষণের আধুনিক ব্যবস্থা করা গেলে শুটকির উৎপাদন দ্বিগুণ করা যাবে, তারাও এই ব্যবসা করে লাভবান হবেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, শুটকি উৎপাদনের জন্য লালপুরে মেঘনা নদীর তীরে প্রায় ২ কিলোমিটার এলাকায় নির্মিত করা হয়েছে শতাধিক মাঁচা। প্রতিদিন ভোরে শুটকি উৎপাদনকারীরা স্থানীয় এবং আশপাশের এলাকার বিভিন্ন বাজার থেকে পুঁটি, সরপুঁটি, শৈল, বোয়াল, টাকি, ট্যাংরা, গজার, বাইম, বোয়াল, মেনি, ভৈদা আলুনি কেচকি, মলা, ঢেলা, চাপিলা, খইলসা, কাইক্কা, গুতুম, চান্দাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ এনে রাখেন ডাঙ্গির নিচে। ডাঙ্গির নিচে বসেই এসব মাছ কাটেন এলাকার বিভিন্ন বয়সি শত শত নারী। মাছ কাটার পর এই মাছ নদীর পানিতে ভালো করে ধুঁয়ে শুকাতে দেয়া হয় ওইসব ডাঙ্গিতে। পাখিরা যাতে শুকাতে দেয়া মাছ নিতে বা নষ্ট করতে না পারে সেজন্য প্রতিটি মাঁচাই জাল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। লালপুরে শুকনা ও সিঁদল নামে দুই ধরনের শুটকি উৎপাদন করা হয়। শুকনা শুটকির ক্ষেত্রে কাটা মাছগুলো রোদে শুকানোর পর তা সরাসরি স্থানীয় বাজারের বিভিন্ন আড়তে চলে যায়।
শুটকি উৎপাদনকারী তপন দাস, অনিবাশ দাস, চিত্ত দাস, ললিত দাস ও সুধীর দাসসহ অনেকে জানান, তাদের অনেকেরই নিজস্ব পুঁজি নেই। জমির সব কাগজপত্র দেখাতে না পারায় তারা ব্যাংক থেকেও কোন ঋণ পান না। ফলে স্থানীয় আড়তদার ও মহাজনদের কাছ থেকে সুদে টাকা নেন তারা। তাছাড়া সংরক্ষণের কোন সুবিধা না থাকায় শুটকি নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় শুটকি উৎপাদনের পরপরই তা বাজারে বিক্রি করে দিতে হয়। এজন্য তারা কাক্সিক্ষত ও ন্যায্য মুনাফা পান না।
আড়তদার মো. আনোয়ার হোসেন ও নিখির চন্দ্র দাস বলেন, আমরা লালপুরের উৎপাদিত শুঁটকিসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শুটকি রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রাম, হবিগঞ্জ, ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়িসহ বেশ কয়েকটি জেলায় সরবরাহ করি। তারা বলেন, প্রতি বছর তারা শত কোটি টাকার বেশি শুটকি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলসহ বিদেশে রপ্তানি করেন।
লালপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মোর্শেদ মাস্টার বলেন, লালপুরে শুটকি উৎপাদন কাজে ৩-৪ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়। সরকার যদি শুটকি উৎপাদনকারীদের সহজ শর্তে ঋণ দেয় ও শুটকি সংরক্ষণে আধুনিক ব্যবস্থা করে তাহলে লালপুরে শুটকির উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পাবে। মানুষের কর্মসংস্থানও আরও বাড়বে।
এ ব্যাপারে জেলা মৎস্য অফিসার তাজমহল বেগম বলেন, সরকারিভাবে শুটকি উৎপাদনকারীদের ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা নেই। স্বাস্থ্যসম্মত ও আধুনিক উপায়ে শুটকি উৎপাদনের জন্য ক্ষুদ্র আকারে একটি পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে শুটকি উৎপাদন ও সংরক্ষণে আধুনিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ব্রাক্ষণবাড়িয়া প্রধান কার্যালয়ের সহকারি মহাব্যবস্থাপক হাসান মো. ইউসুফ খান সোহেল বলেন, শুটকি উৎপাদনকারীরা ট্রেড লাইসেন্স, উপজেলা মৎস্য ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সুপারিশসহ আবেদন করলে সরকারের ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচির আওতায় তাদের ঋণ প্রদান করা সম্ভব।