Home অন্যান্য ময়ূর সিংহাসন কোথায়?

ময়ূর সিংহাসন কোথায়?

রূপাঞ্জন গোস্বামী

স্বর্ণকারেরা বয়ে নিয়ে এসেছিলেন তখত-ই-মুরাসসা। মোহিত হয়ে গিয়েছিলেন জিল্লে-ই-ইলাহি আল্লাহ আজাদ আবুল মুজফফর শাহাব উদ-দিন মহাম্মদ খুররম বা মুঘল সম্রাট শাহজাহান। তিনি এটাই চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন রাজা সলোমনের মত একটা সিংহাসন বানাতে। যেটি দেখে স্তম্ভিত হয়ে যাবে বিশ্ব। যে সম্পদ নেই মুঘল দিল্লির প্রতিদ্বন্দ্বী ইস্তানবুল ও ইস্পাহানের কাছেও। তাই তো তিনি একটি মাত্র সিংহাসনের জন্য খরচ করেছিলেন তাজমহলের দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ। যে সিংহাসনটিকে বিশ্ব আজ চেনে ময়ূর সিংহাসনতখত-ই-তাউস নামে।

সম্রাট শাহজাহান

কী কী দিয়ে তৈরি হয়েছিল ময়ূর সিংহাসন!

সিংহাসনটি বানানোর জন্য সম্রাট শাহজাহান তাঁর রত্নভাণ্ডার থেকে দিয়েছিলেন ২৩০ কেজি ওজনের হিরে, রুবি, পান্না, মুক্তো এবং গার্নেট। নিজে হাতে রত্নভাণ্ডার থেকে বেছে নিয়েছিলেন সেরা সেরা রত্ন। যেগুলির মধ্যে ছিল বিখ্যাত হিরে কোহ-ই-নুর ( কোহিনুর, ১৮৬ ক্যারেট), আকবর শাহ (৯৫ ক্যারেট) শাহ ( ৮৮.৭৭ ক্যারেট), জাহাঙ্গির ( ৮৩ ক্যারেট) এবং বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রুবি তৈমুর (২৮২ ক্যারেট) বা ‘খিরাজ-ই-আলম’

এছাড়াও স্বর্ণকারদের প্রধান সাইদি গিলানিকে (বিবাদাল খান) সম্রাট শাহজাহান দিয়েছিলেন ১১৫০ কেজি খাঁটি সোনা। পারিশ্রমিক হিসেবে সাইদিকে দিয়েছিলেন তাঁর ওজনের সমপরিমাণ সোনা। স্বর্ণকারেরা সিংহাসন বানাতে শুরু করেছিলেন ১৬২৮ সালে। সময় নিয়েছিলেন সাত বছর।

কেমন দেখতে ছিল ময়ূর সিংহাসন!

আব্দুল হামিদ লাহোরির লেখা ‘বাদশানামা’, ইনায়েত খানের লেখা ‘শাহজাহাননামা’, ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ে, ফরাসি জহুরী তাভার্নিয়ের লেখাতে ময়ূর সিংহাসনের বিবরণ পাওয়া যায়। তবে লেখাগুলির মধ্যে তথ্যগত পার্থক্যও বিস্তর। তবুও এই সব সূত্র থেকে জানা যায়, আগাগোড়া সোনা দিয়ে মোড়া ছিল ছয় ফুট দৈর্ঘ্য ও চার ফুট প্রস্থের ময়ূর সিংহাসন। সোনার ওপর বিভিন্ন নকশায় বসানো ছিল শত শত হিরে,পান্না, রুবি ও গার্নেট। ময়ূর সিংহাসনে ওঠার জন্য ছিল বহুবিধ রত্নখচিত রুপোর সিঁড়ি।

শাহজাহানের ময়ূর সিংহাসন

সিংহাসনটির মাথার ওপরে ছিল মুক্তখচিত গম্বুজ। যেটির মাঝখানে বসানো ছিল ফুলের একটি স্তবক। স্তবকের ফুলগুলিও তৈরি করা হয়েছিল নানান দুস্প্রাপ্য রত্ন দিয়ে। স্তবকটির দুই পাশে বসানো ছিল দুটি সোনার ময়ূর। গম্বুজটির দুই পাশে বসানো ছিল আরও দুটি সোনার ময়ূর। এই কারণেই পরবর্তীকালে সিংহাসনটির নাম হয়েছিল ময়ূর সিংহাসন। ময়ুরগুলির পেখম তৈরি করা হয়েছিল নীলকান্তমণি ও অন্যান্য রত্ন দিয়ে। সিংহাসনের গায়ে সোনার ওপর পান্নার হরফ দিয়ে লেখা ছিল সম্রাটের প্রশস্তিপত্র।

অসামান্য সৌন্দর্যমণ্ডিত ময়ূর সিংহাসনটি স্থাপন করা হয়েছিল লালকেল্লার দেওয়ান-ই-খাসে। পারস্য পঞ্জিকার ১০৪৪ সালে, নভরোজ বা নববর্ষের দিনে সম্রাট শাহজাহান প্রথম বসেছিলেন ময়ূর সিংহাসনে। বসেছিলেন প্রায় দুই দশক। তবে ময়ূর সিংহাসনে রোজ বসতেন না সম্রাট। রাজজ্যোতিষীদের দেওয়া বিধান মেনে কেবলমাত্র উৎসবের দিনগুলিতেই ময়ূর সিংহাসনে বসতেন। বিশেষ বিশেষ দিনে ময়ূর সিংহাসনটিকে নিয়ে যাওয়া হত আগ্রাতেও

দিল্লির আকাশে পারস্যের বাজ

শাহজাহানকে বন্দি করে ১৬৫৮ সালের ৩১ জুলাই দিল্লির মসনদে বসেছিলেন ঔরঙ্গজেব। তারপর একে একে মসনদে বসেছিলেন পরবর্তী মুঘল সম্রাটেরা। কিন্তু মুঘল সম্রাটদের দুর্বল শাসনে দ্রুত দুর্বল হতে শুরু করেছিল মুঘল সাম্রাজ্য। ১৭৩৯ সাল, দিল্লির মসনদে তখন রোশন আখতার বাহাদুর বা মুহাম্মদ শাহ। আচমকা দিল্লি আক্রমণ করেছিলেন পারস্যের সম্রাট তাহমস কুলি খান। ইতিহাস যাঁকে চেনে নাদির শাহ নামে। ইতিহাসবিদদের কাছে কখনও তিনি পারস্যের নেপোলিয়ন, কখনও দ্বিতীয় আলেকজান্ডার। যাঁর আদর্শ ছিলেন চেঙ্গিস খান

পারস্যের ইতিহাস বলে, আফগান শাসকের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য, নাদির শাহ মুঘল সম্রাট মুহাম্মদ শাহের সাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্তু মুহাম্মদ শাহের ব্যবহার তাঁকে খুশি করেনি। তাই চরম অক্রোশ নিয়ে দিল্লি আক্রমণ করেছিলেন নাদির শাহ। ১৭৩৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি, কার্নালের যুদ্ধে মুঘল সম্রাটকে পরাজিত করে দখল করে নিয়েছিলেন দিল্লি।

কিন্তু দিল্লিতে ছড়িয়েছিল গুজব। কার্নালের যুদ্ধে নাকি প্রাণ হারিয়েছেন নাদির শাহ। ক্রোধান্ধ নাদির শাহ নিজের ভয়ঙ্কর উপস্থিতি জানান দেওয়ার জন্য দিল্লি ও আগ্রায় চালিয়েছিলেন এক ভয়াবহ গণহত্যা। প্রাণ হারিয়েছিলেন হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষ। নাদির শাহের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন মুঘল সম্রাট মহম্মদ শাহ। ক্ষমা করেছিলেন নাদির শাহ, তবে ক্ষমার বদলে তাঁকে দিতে হয়েছিল মুঘল খাজানার চাবি।

দিল্লি দখলের ৫৯ দিন পরে পারস্যের পথে রওনা হয়েছিলেন নাদির শাহ। সঙ্গে গিয়েছিল হাজার হাজার হাতি, ঘোড়া ও উট। প্রাণীগুলির পিঠে বোঝাই করা ছিল মুঘলদের যাবতীয় ধনরত্ন। সেগুলির মধ্যে ছিল কোহিনুর হিরে বসানো ময়ূর সিংহাসনও। কিন্তু পরবর্তীকালে মুহাম্মদ মুসিন সাদিকি তাঁর ‘জোহর-ই-সামসাম’ (১৭৮৯) বইয়ে লিখেছিলেন, মুহাম্মদ শাহ নিজে নাদির শাহকে ময়ূর সিংহাসন উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। কিন্তু এ তথ্য অনেক ইতিহাসবিদই মেনে নিতে পারেননি।

 অতি বিশ্বস্ত লোকের হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন নাদির শাহ

পারস্যে ফেরার পথে নাদির শাহের লুঠ করা বহু ধনরত্ন ছিনিয়ে নিয়েছিল বিভিন্ন উপজাতির হানাদারেরা। তবুও বিশাল পরিমাণ ধনরত্ন ও ময়ূর সিংহাসন নিয়ে পারস্যে পৌঁছেছিলেন নাদির শাহ। তাঁর কাছে ময়ূর সিংহাসনটি ছিল প্রায় ন’বছর। মুঘলদের থেকে লুঠ করা ধনরত্ন দিয়ে নাদির শাহ বানিয়েছিলেন একেবারে ময়ূর সিংহাসনের মত দেখতে আরও একটি সিংহাসন।

তবে ভারত থেকে পারস্যে ফিরে, বেশিরভাগ সময় যুদ্ধ করে কাটিয়েছিলেন নাদির শাহ। কখনও তুর্কি, কখনও আফগান, কখনও কুর্দ, কখনও তাঁর ভাইপো আলি কুইলির সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে গিয়েছিলেন। কুর্দদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাওয়ার পথে খোরাসানের ফথাবাদ এলাকায় ১৭৪৭ সালে তাঁবু পেতেছিলেন নাদির শাহ। মানসিক দিক থেকে তখন তিনি কিছুটা অসুস্থ্ হয়ে পড়েছিলেন। সবসময় উন্মত্তের মত আচরণ করতেন।

সকলের অলক্ষ্যে, নাদির শাহকে ক্ষমতা থেকে সরানোর পরিকল্পনা চুড়ান্ত হয়ে গেছিল। এক রাতে নাদির শাহ যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করেছিলেন তাঁরই অত্যন্ত বিশ্বস্ত সহযোগী ও দেহরক্ষীদের প্রধান সালাহ বেয় খান।

কোথায় গেল ময়ূর সিংহাসন!

নাদির শাহের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই, তাঁর সেনা ছাউনিতে আক্রমণ চালিয়েছিল কুর্দ যোদ্ধারা। আক্রমণ চালিয়েছিল আফগানিস্তানের দুরানি সম্রাট আহমেদ শাহের সেনারা। নাদির শাহের সঙ্গে থাকা যাবতীয় ধনরত্ন লুঠ করে কান্দাহারে নিয়ে গেছিল। তার মধ্যে ছিল কোহিনুর সমেত ময়ূর সিংহাসনও।

কিন্তু পরবর্তীকালে অনেক গবেষকই এই তথ্য বিশ্বাস করেননি। তাঁরা বলেছিলেন এত দামি ও ভারী সিংহাসন নিয়ে শত্রু এলাকায় যুদ্ধ করতে যাবেন, এতটা অপরিণত নাদির শাহ ছিলেন না। এই গবেষকদের মতে, নাদির শাহের মৃত্যুর পরে আফগান ও কুর্দরা নাদির শাহের মাশহাদের প্রাসাদ আক্রমণ করেছিল। সেখান থেকে লুঠ হয়ে যেতে পারে ময়ূর সিংহাসন।

কিন্তু ইবি ফ্রেজার তাঁর ‘দ্য হিস্ট্রি অফ নাদির শাহ’ বইতে দিয়েছিলেন অদ্ভুত একটি তথ্য। যে তথ্যটি ১৮২২ সালে ফ্রেজারকে দিয়েছিলেন এক বৃদ্ধ কুর্দ। বৃদ্ধ বলেছিলেন, নাদির শাহের সেনা ছাউনিতে প্রথম আক্রমণ করেছিল কুর্দরা। সেনা ছাউনি থেকে কুর্দরা খুঁজে পেয়েছিল ময়ূর সিংহাসন ও হাজার হাজার মুক্ত বসানো একটি সোনার গম্বুজ। ময়ূর সিংহাসনটি সঙ্গে সঙ্গেই ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু কুর্দেরা তখন মুক্তোর দাম জানত না। তাই অপ্রয়োজনীয় ভেবে দুস্প্রাপ্য মুক্তোগুলি চরম অবহেলায় ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল।

ময়ূর সিংহাসনের জন্য পাগল হয়ে উঠেছিলেন লর্ড কার্জনও

লর্ড কার্জন সারা এশিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছিলেন গুপ্তচর। চরেরা বলেছিল তেহরানের গুলেস্তান প্যালেসে টুকরো টুকরো অবস্থায় রাখা আছে আসল ময়ুর সিংহাসন। পারস্যের কাজার রাজত্বের প্রতিষ্ঠাতা আগা মহম্মদ শাহ সেটি ছিনিয়ে এনেছিলেন নাদির শাহের দৃষ্টিহীন নাতি শাহরুখ শাহের কাছ থেকে। কিন্তু লর্ড কার্জন বলেছিলেন খবরটি ভুল, গুলেস্তান প্যালেসে থাকা ময়ূর সিংহাসনটি শাহজাহানের নয়। ওই সিংহাসনটি ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে তৈরি করেছিলেন পারস্যের কাজার রাজত্বের শাসক দ্বিতীয় শাহ ফতে আলি। এই তথ্যটি লর্ড কার্জনের কাছে এসেছিল কাজার রাজত্বের এক উজিরের বংশধরের মাধ্যমে।

লর্ড কার্জনকে গুপ্তচরেরা দিয়েছিল আরও একটি খবর। ইস্তানবুলের টোপকাপি প্রাসাদে রাখা আছে শাহজাহানের ময়ূর সিংহাসন। প্রায় দেউলিয়া হতে বসা তুরস্ক ময়ূর সিংহাসন সহ টোপকাপি প্রাসাদ বিক্রি করার জন্য ক্রেতা খুঁজছে। এবারও লর্ড কার্জন বলেছিলেন টোপকাপি প্রাসাদে রাখা সিংহাসনটিও শাহজাহানের নয়। কারণ বিশেষজ্ঞদের গোপনে ইস্তানবুল পাঠিয়ে তদন্ত আগেই সেরে রেখেছিলেন লর্ড কার্জন।

ছবি থেকে বিভ্রান্তি!

কিছু বিদেশি গবেষকের মতে ময়ূর সিংহাসনের গঠন সংক্রান্ত বিভ্রান্তির সূচনা করেছিল একটি ছবি থেকে। শাহজাহানের দরবারের বিখ্যাত চিত্রকর গোবর্ধন একটি ময়ূর সিংহাসনের ছবি এঁকেছিলেন। কিন্তু বিদেশি গবেষকদের দাবি সেটি আদৌ ময়ূর সিংহাসনের নয়। কারণ গোবর্ধনের আঁকা সিংহাসনটি বেশ ছোট। এছাড়া আসল ময়ূর সিংহাসনে বারোটি রত্নখচিত স্তম্ভ গম্বুজকে ধরে রেখেছিল। গোবর্ধনের আঁকা ময়ূর সিংহাসনে আছে মাত্র চারটি স্তম্ভ।

এই গবেষকেরা বলছেন সম্রাট শাহজাহানের কাছে ময়ূর সিংহাসন নিয়ে মোট সাতটি ছোট ও বড় সিংহাসন ছিল। সম্ভবত গোবর্ধন সেগুলির মধ্যে একটি সিংহাসনের ছবি এঁকেছিলেন। ছোট সিংহাসনের গম্বুজেও ছিল ময়ূর। তাই সেই সিংহাসনকে ময়ূর সিংহাসন ভেবে বসেছিলেন সে যুগের অনেকেই। এই ছোট সিংহাসনটির নীচের অংশের সঙ্গে মিল আছে তেহরান ও ইস্তানবুলে থাকা ময়ূর সিংহাসন দুটির।

গবেষকেরা বলছেন, এমন হতেই পারে নাদির শাহ সাতটি সিংহাসন নিয়েই পারস্য পাড়ি দিয়েছিলেন। তার মধ্যে দু’টি সিংহাসন এখনও টিকে আছে ইস্তানবুল ও তেহরানে। মনে প্রশ্ন জাগে, এটা কি লর্ড কার্জনও জানতেন? তাই নকল বলে বাতিল করেছিলেন তেহরান ও ইস্তানবুলে থাকা ময়ূর সিংহাসন দুটিকে। তাহলে কোথায় হারিয়ে গেল শাহজাহানের সাধের ময়ূর সিংহাসন?

ভারত মহাসাগরের জলে ডুবে আছে ময়ূর সিংহাসন!

মাদ্রাজ-শ্রীলঙ্কা-দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ে লন্ডন যাওয়ার পথে, ১৭৮২ সালের ৪ আগস্ট ডুবে গেছিল ৮০০ টনের ব্রিটিশ জাহাজ ‘গ্রসভেনর’। দক্ষিণ আফ্রিকার পোন্ডোল্যান্ড উপকূলের খুব কাছে থাকা ডুবোপাহাড়ে ধাক্কা লেগে ডুবে যায় জাহাজটি। সেই জাহাজে ছিলেন ১২৩ জন যাত্রী। সাঁতরে তীরে উঠেছিলেন তাঁরা। যাত্রীরা ঠিক করেছিলেন, সমুদ্রের তীর ধরে হেঁটে ২৫০ মাইল দূরের ‘কেপ অফ গুড হোপ’-এ যাবেন।

কিন্তু কেউই পৌঁছতে পারেননি সেখানে। অনুমান করা হয়, বেশিরভাগ যাত্রী অনাহার ও ক্লান্তিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন। কেউ কেউ নিজের অজান্তেই ঢুকে গিয়েছিলেন উপজাতিদের ডেরায়। হয় তীরের আঘাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন, নয়তো মিশে গিয়েছিলেন উপজাতিদের দলে। শ্বেতাঙ্গ মহিলা যাত্রীদের সম্ভবত বিয়ে করে নিয়েছিল উপজাতিগুলির প্রধানেরা।

গ্রসভেনর জাহাজের তৈলচিত্র

১৮৮০ সালে, সিডনি টার্নার নামে এক গুপ্তধন সন্ধানী, ‘গ্রসভেনর’ জাহাজের ধ্বংসাবশেষ থেকে কিছু সোনার মোহর খুঁজে পেয়েছিলেন। ১৮৯৬ সালে আলেকজান্ডার লিন্ডসেও খুঁজে পেয়েছিলেন ৩৪০টি সোনার মোহর। ১৯২১ সালে মার্টিন ও ডেভিড ওয়েবস্টার প্রকাশ করেছিলেন ‘গ্রসভেনর’ জাহাজের ক্যাপ্টেনের লেখা কিছু তথ্য। যা জাহাজ ছাড়ার আগে মাদ্রাজে লিখে রাখা হয়েছিল।

জানা গিয়েছিল ‘গ্রসভেনর’ জাহাজে ছিল ১৯ বাক্স দামি পাথর, ৭২০টি সোনার বার, ১৪৫০টি রুপোর বার, প্রচুর সোনার মোহর যেগুলি ভারত থেকে চালান করা হচ্ছিল লন্ডনে। একই সময় লন্ডনের একটি কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল চাঞ্চল্যকর একটি তথ্য। ‘গ্রসভেনর’ জাহাজেই নাকি পিতলের বাক্সে রাখা ছিল কংক্রিটে গাঁথা দুটি রত্নখচিত সোনার ময়ূর। এবং ময়ূর দু’টি শাহজাহানের ময়ূর সিংহাসন থেকে খুলে নেওয়া হয়েছিল।

পোন্ডোল্যান্ড উপকূলের জল তোলপাড় করে শুরু হয়েছিল অনুসন্ধান। আঠারো ফুট গভীর জলের নীচে দশফুট পুরু বালির স্তর, তার তলায় ডুবে আছে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যাওয়া জাহাজ ‘গ্রসভেনর’। কিন্তু মহাসাগরের জলস্রোতে নিয়মিত সরতে থাকা বালি, ধনরত্ন সহ সোনার ময়ূরগুলিকে কোথায় টেনে নিয়ে গেছিল কে জানে। একসময় হাল ছেড়ে দিয়েছিল অনুসন্ধানকারীরা।

ময়ূর সিংহাসন আছে দক্ষিণ আফ্রিকার ‘হেলা হেলা’ উপত্যকায়!

দক্ষিণ আফ্রিকার বিখ্যাত সংরক্ষণবিদ এবং ব্রিটেনের রয়াল জিওগ্রাফিক সোসাইটির সদস্য শিলাগ অ্যান্ট্রোবাস ২০১০ সালে লিখেছিলেন একটি প্রবন্ধ। তাতে তিনি লিখেছিলেন, শাহজাহানের ময়ূর সিংহাসন সম্ভবত অক্ষত অবস্থায় লুকনো আছে হেলা হেলা উপত্যকার গোপন স্থানে। দক্ষিণ আফ্রিকার কোয়াজু্লু-নাটাল প্রদেশে আছে এই ‘হেলা হেলা’ উপত্যকা।

প্রবন্ধটিতে শিলাগ লিখেছিলেন ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধ এড়াবার জন্য দ্বিতীয় শাহ আলম ময়ূর সিংহাসন উপহার দিয়েছিলেন রাজা তৃতীয় জর্জকে। তাই ‘গ্রসভেনর’ জাহাজে করে অত্যন্ত গোপনে লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল ময়ূর সিংহাসন।

শিলাগ অ্যান্ট্রোবাস

‘গ্রসভেনর’ ডুবে যাওয়ার পর, ঘটনাস্থল থেকে জোয়া উপজাতির যোদ্ধারা খুঁজে পেয়েছিল একটি বিশাল কাঠের বাক্স। যার ভেতরে ছিল ময়ূর সিংহাসন। যোদ্ধারা সিংহাসনটি বয়ে নিয়ে এসেছিল তাদের দলপতির কাছে। ময়ূর সিংহাসনে বসতে শুরু করেছিল জোয়া দলপতি। খবরটি পেয়েছিল জুলু উপজাতিদের দলপতি ‘চাকা’। প্রায় তিনশো জুলু যোদ্ধাকে পাঠিয়েছিল জোয়াদের কাছ থেকে ময়ূর সিংহাসন ছিনিয়ে আনার জন্য।

যুদ্ধে জোয়াদের হারিয়ে ময়ূর সিংহাসন নিয়ে আসা হয়েছিল হেলা হেলা উপত্যকায়। আট জুলু যোদ্ধা সিংহাসনটি নিয়ে হেলা হেলা গিরিপথের ওপরে উঠে এসেছিল। সেই সময় পাহাড়ের নীচে থাকা বাকি জুলু যোদ্ধাদের আক্রমণ করেছিল ভাকা উপজাতির যোদ্ধারা। পুরোনো হারের বদলা নিতে এসেছিল তারা।

উপত্যকায় রক্তবন্যা বইয়ে দিয়েছিল ভাকা উপজাতির যোদ্ধারা। প্রাণ হারিয়েছিল বেশিরভাগ জুলু যোদ্ধা। ময়ূর সিংহাসন নিয়ে আট জুলু যোদ্ধা পালিয়ে গিয়েছিল অরণ্যের গভীরে। পাহাড়ি নদীর জলের তলার লুকিয়ে রেখেছিল ময়ূর সিংহাসন। তারপর ফিরে গিয়েছিল তাদের এলাকায়।

ফিরে দেখেছিল জুলু দলপতি ‘চাকা’ নিহত। দলপতির জায়গা নিয়েছে চাকার ভাই দিনগান। এই আট জুলু যোদ্ধা নতুন দলপতি দিনগানকে পছন্দ করত না। তাই তারা সিংহাসনের কথা দিনগানকে জানায়নি। আমৃত্যু গোপন রেখেছিল। কালের নিয়মে মারা গিয়েছিল আট জুলু যোদ্ধা। তাদের সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছিল ময়ূর সিংহাসনের ঠিকানাও।

তবে এক যোদ্ধা নাকি তার নাতিকে বলেছিল ময়ূর সিংহাসনের ঠিকানা। নাতির নাম ছিল স্টোন। পরবর্তীকালে স্টোন ১১টি গরুর বিনিময়ে এলাকাটি চিনিয়ে দিতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু সেই রাতেই নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল স্টোন। আর তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। খুঁজে পাওয়া যায়নি সম্রাট শাহজাহানের ময়ূর সিংহাসন তখত-ই-তাউস

বিভিন্ন যুগের ইতিহাসবিদের মধ্যে ময়ূর সিংহাসনের গঠন ও পরিণতি নিয়ে বিরোধাভাস সুস্পষ্ট। তাই আজও চলছে বিতর্ক। কেটে যাচ্ছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। আরও ঘনীভূত, আরও জটিল হয়ে উঠছে ময়ূর সিংহাসনকে ঘিরে থাকা রহস্যের কুয়াশা। 

তথ্যসূত্র: Narrative of a journey to Khorasan by JB Fraser, The History of Nadir Shah, formerly called Thamas Kuli Khan, the Present Emperor of Persia by JB Fraser, Persia and the Persian question, Volume 1  by George Nathaniel Curzon , The Peacock Thrones of the world by KRN Swamy.