Home উদ্যোক্তা কোয়েলের খামার ছড়িয়ে দিচ্ছেন নারী উদ্যোক্তা ডলি

কোয়েলের খামার ছড়িয়ে দিচ্ছেন নারী উদ্যোক্তা ডলি

আনোয়ারা খানম ডলি। একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। চোখে তার একটাই স্বপ্ন, নিজের মতো আরও শত শত নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টি করা। নরসিংদীর পলাশ উপজেলার পলাশের চর গ্রামে মাত্র একজোড়া কোয়েল পাখি নিয়ে তিনি শুরু করেছিলেন হৃদয় কোয়েল হ্যাচারি নামের একটি প্রতিষ্ঠান। যা থেকে বর্তমানে তার তত্ত্বাবধানে সারাদেশে আট হাজারেরও বেশি কোয়েল হ্যাচারি রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

‘দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক মুক্তির ক্ষেত্রে নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে’ উল্লেখ করে আনোয়ারা খানম ডলি জানান, মাত্র বিশ হাজার টাকা দিয়ে শুরু হয় তার কোয়েল পাখি পালন। বারো বছরের ব্যবধানে এই খামার দিয়েই কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করেন তিনতলা বিশিষ্ট একটি বাড়ি। শুধু তাই নয়, তার এই কোয়েল পাখির খামার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এলাকার শতাধিক পরিবারের অর্থনৈতিক মুক্তি এনে দিয়েছে। পাশাপাশি সারাদেশে প্রায় দশ হাজারেরও বেশি মানুষ স্বাবলম্বী হয়েছেন এর মাধ্যমে।

কোয়েল পালন শুরু করার বিষয়ে ডলি খানম জানান, ছেলে হৃদয় তার মামার বাড়ি থেকে দুটি কোয়েল পাখির বাচ্চা এনে লালন-পালন করতো। সেখান থেকেই কোয়েল পালনে তার আগ্রহ জেগে ওঠে। পরে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণকরে মাত্র ২০ হাজার টাকা দিয়ে ৬শ’ কোয়েল পাখির বাচ্চা ক্রয় করে সীমিত আকারে শুরু করেন। গুণে, মানে ও পুষ্টিতে ভরপুর এই ডিমের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রথম বছরেই লাভের মুখ দেখেন তিনি। তার এই খামার দেখে এলাকায় ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। ফলে আশেপাশের লোকজনের মধ্যে কোয়েল পালনের আগ্রহ তৈরি হয়। এরপর বাচ্চা সরবরাহ করতে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি ইনকিউবেটর ক্রয় করে বাচ্চা ফুটানো শুরু করেন।

২০০৭ সালে বার্ড ফ্লু রোগে আক্রান্ত হয়ে খামারটি একপর্যায়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। এ অবস্থায় সরকার তাকে প্রায় ৯ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিলে তা দিয়েই হাল ধরেন কোয়েল খামারের। সংগ্রহ করেন চারটি বাচ্চা ফুটানোর যন্ত্র (ইনকিউবেটর)। যা দিয়ে একসাথে ২২ হাজার বাচ্চা উৎপাদন সম্ভব। চারটি মেশিন দিয়ে বাচ্চা ফুটিয়ে তিনি সারাদেশে বিক্রি করতে থাকেন। ডিম বিক্রির পাশাপাশি বাচ্চা বিক্রিতেও সাড়া ফেলেছে খামারটি।

ডলি খানম আরও জানান, অল্প পুঁজি, কম ঝুঁকি, কম সময় এবং খুব অল্প স্থানেই এই পাখি পালন করা যায়। ১ বর্গফুট জায়গায় ৬ টি কোয়েল পাখি পালন করা যায়। ঠাণ্ডা ছাড়া তেমন কোনো রোগ কোয়েল পাখির দেখা যায় না। একটি পাখি দৈনিক মাত্র ১ টাকা ২০ পয়সার খাবার খায় আর ১টি ডিম পাইকারি হিসেবে বিক্রি হয় ২ টাকা। এভাবে কোনো পরিবার যদি মাত্র ২ হাজার কোয়েল পাখি পালন করে তাহলে সকল খরচ বাদ দিয়ে দৈনিক ১২-১৪শ’ টাকা আয় করা সম্ভব।

কথা প্রসঙ্গে তিনি আরও জানান, আমি এই ২০ বছরে কোয়েল পাখির খামার দিয়ে কোটি টাকা ব্যয় করে দুটি বাড়ি নির্মাণ করেছি। যার ছাদেই রয়েছে এই পাখির খামার। আজ আমার একটি খামারেই রয়েছে ১০ হাজারের মতো পাখি। পাশের আরেকটি খামারে রয়েছে আরও ১০ হাজার। আমার খামার থেকে এখন দৈনিক ৮-৯ হাজার ডিম পাওয়া যায়, যা প্রতিদিন ২০-২৫জন হকার নিয়ে যায়। নিজস্ব খামারে উৎপাদিত কোয়েল পাখির বাচ্চা ৮ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা যায়। পাখির ডিম দেওয়া শেষ হলে প্রতিটি পাখি পাইকারি দরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে সিলেট এলাকায় ৩০-৩৫ টাকায় বিক্রি করা যায়। আমাদের তত্ত্বাবধানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ৮ হাজার খামার গড়ে উঠেছে।

কোয়েল পাখির উচ্ছিষ্ট দিয়ে গ্রামীন শক্তির সহায়তায় বায়োগ্যাসের একটি প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। এই গ্যাস দিয়েই পরিবারের সকল রান্নার কাজ করা হয়। যার ফলে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে একাধিক পুরস্কার লাভ করে খামারটি। এছাড়া জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে অনুষ্ঠিত প্রাণী সম্পদ মেলায় একাধিক পুরস্কার লাভ করে এই কোয়েল পালন প্রকল্প।

আনোয়ারা খানমের ছেলে হৃদয় জানান, বর্তমানে আমি কোয়েল পাখি, ডিম ও বাচ্চার মূল্য বাবদ ৪০-৪৫ লাখ টাকা বিভিন্ন লোকজনের কাছে পাওনা রয়েছি। খামারের মাধ্যমে সরকার যদি আমাকে ঋণের ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে আমি আরও অনেক বড় পরিসরে খামারটি গড়ে তুলব। এতে করে একদিকে বেকার সমস্যা দূর হবে আরেক দিকে ডিম, পুষ্টি ও মাংসের চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

এ বিষয়ে জেলা প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ডা. মো. হাবিবুর রহমান বলেন, এই কোয়েল পাখির খামারটি নরসিংদীর খামারিদের জন্য একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যা দেখে এলাকায় কোয়েল পালনে ব্যাপক সাড়া পড়েছে। আমরা খামারটি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছি। আনোয়ারা খানম ডলির এই কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ একাধিকবার তাকে পুরস্কৃত করেছি।

-অধিকার