মোঃ রবিউল ইসলাম (রবীন)
আদমদীঘি (বগুড়া): বগুড়ার প্রাচীনতম জনপদ সান্তাহার। সান্তাহার পৌর শহরের তারাপুর গ্রামের অবস্থিত মসজিদটিই দেশের সবচেয়ে ছোট মসজিদ হিসেবে দাবি করছেন এলাকাবাসী। এই মসজিদের উচ্চতা ১৫ ফুট আর প্রস্থ ৮ ফুট, দৈর্ঘ্য ৮ ফুট। মসজিদের দরজার উচ্চতা ৪ ফুট আর চওড়া দেড় ফুট। একটি গম্বুজ মসজিদ। জানালা নেই। দরজার উচ্চতা ৪ ফুট, চওড়ায় দেড় ফুট। একসঙ্গে একজন মানুষই ঢুকতে পারবে। ইটের তৈরি দেয়ালের পুরুত্ব দেড় ফুট। ইটগুলোর প্রতিটি অর্ধেকই ভাঙা। মসজিদের দরজায় দুটি রাজকীয় আদলের খিলান আছে। মুসলিম স্থাপত্যের নিদর্শন সংবলিত মিনার, খিলান ও মেহরাবই এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
মসজিদটির ভেতরে মাত্র তিনজন মানুষের নামাজ আদায় করার মতো জায়গা আছে। ছোট এ মসজিদটির ওপরে একটি গুম্বুজও রয়েছে। রয়েছে একটি ধ্সে পড়া মিনারের ধ্বংসাবশেষ। প্রাচীন এই মসজিদ সম্পর্কে এই এলাকার বিভিন্ন শ্রেনীর মানুষ,বগুড়া প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে একাধিক তথ্য পাওয়া গেছে। তবে বহু আগের নির্মিত এই মসজিদটি অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে আছে, যে কোন সময়ে এটি ধসে পড়তে পারে।
এলাকাবাসীর দাবি, এটি উপমহাদেশের সবচেয়ে ছোট মসজিদ। পৃথিবীর অন্য কোন দেশে এরচেয়ে ছোট মসজিদের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা যায়নি। সরকারিভাবে এটি সংরক্ষণ করা উচিত বলে বিশেষজ্ঞগন মন্ত্রব্য করেছেন।
সরজমিনে মসজিদটি মেপে দেখা গেছে, নামহীন এই মসজিদে সবোর্চ্চ তিন জন মানুষ এখানে নামাজ পড়ার উপযোগী। মসজিদটির দরজায় দুটি সুন্দর খিলান আছে ভেতরে আছে মিম্বর ও মেহরাবই বলে দেয়,এটি একটি ছোট মসজিদ।
এলাকাবাসী জানান, অনেক বছর আগে এখানে নামাজ পড়া হতো। কে বা কারা মসজিদটি নির্মাণ করেছেন-এ নিয়ে গ্রামবাসীর মধ্যে মতবিরোধ আছে। তবে তারা ছোট বেলা থেকে দেখেছেন এই অবস্থায় আছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়,১৭৭০ থেকে ১৭৯০ খৃষ্টাব্দের কোনো এক সময় এই মসজিদ বা ইমারতটি নির্মিত হয়। তৎকালিন সময়ে নাটোরের রাণীভবানির পরিচালিত ভারত উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ জমিদারী প্রায় ১২৯৯৯ বর্গমাইল, যার মধ্যে এই আদমদীঘি উপজেলার বিভিন্ন এলাকা অন্তর্ভুক্ত ছিল।
কথিত আছে সেই সময় এই এলাকাটি হিন্দু বসতিপূর্ণ এলাকা ছিল। সান্তাহার শহরের পাশে ছাতীয়ানগ্রাম ইউনিয়ন সদরে ছিল নাটোরের রাজা রামাকান্তের স্ত্রী রাণী ভাবানীর বাবার বাড়ি। কথিত আছে যে, সেই সময় সান্তাহারের তারাপুর গ্রামে তারাবানু নামে একজন পরহেজগার মুসলিম নারী বসবাস করতেন। তিনি নামাজ পড়ার জন্য একটি মসজিদ নির্মানের দাবি করেন রানী ভাবনির নিকট। কিন্তু তৎকালিন হিন্দু সমাজপতিরা এতে বাধা দেন। এ নিয়ে অনেক যুক্তিতর্কের পর পরবর্তিতে মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি যেন না পায়, সেই জন্য শুধু একজন মুসল্লি যাতে নামাজ পড়তে পারে সেই উপযোগী একটি মসজিদ রানীভবানী নির্মাণ করে দেন। সেই হিসেবে মসজিদটির বয়স কমপক্ষে ৩০০ বছর। চুন-সুড়কি দিয়ে তৈরি স্থাপনাটি এতোটাই পুরোনো যে, প্রথমে দেখে মসজিদ হিসেবে বোঝা কঠিন।
এই ক্ষুদ্র মসজিদ বা ইমারতটির সংস্কার না থাকায় এটির ইট খুলে পড়তে শুরু করেছে। মসজিদটি ঘাস,লতা পাতায় আচ্ছাদিত হয়ে আছে। এলাকাবাসি দ্রুত এই মসজিদটির সংস্কার ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় নেয়ার জানান। তারাপুরগ্রামবাসি, সান্তাহার নাগরিক কমিটি,সান্তাহার প্রেস ক্লাব,আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক মোঃ সাজেদুল ইসলাম চাম্পা অবিলম্বে এই মসজিদটি সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর,বগুড়া আঞ্চলিক পরিচালক মোছাঃ নাহিদ সুলতানা বলেন, আমি ঐ স্থানটি ভিজিট করেছি। বিভিন্ন মিডিয়া এটিকে যে মসজিদ বলে যে দাবি করেছে,আমার কাছে সেটি মনে হয়নি। দেশের বা পৃথিবীর সর্বক্ষুদ্র মসজিদের কোন ক্রাইটেয়ায় এটি পড়ে না।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক ও প্রত্নতত্ত্ব গবেষক প্রফেসর ড.কাজি মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অষ্টাদশ শতাব্দির শেষের দিকে মোগল আমলে এই জাতীয় ইমারত বা মসজিদ রাজশাহী বিভাগে অনেকগুলি নির্মিত হয়েছে। এখানে দুই অথবা তিনজনের নামাজ পড়ার মতো পরিবেশ আছে, তবে এটি হয়তো সবচেয়ে ছোট মসজিদ বলা ঠিক হবে না হয়তো। এটা নিয়ে আরও গবেষনা প্রয়োজন।। তবে এসব ইমারত আমাদের ঐতিহ্য। এসব স্থাপনা অবশ্যই সংরক্ষণ করা উচিত।
বিশ্বের ক্ষুদ্রতম মসজিদ: হ্যান্স ইন্ডিয়ার সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে , হায়দরাবাদের কিশানবাগে একটি মসজিদ রয়েছে, যা জিন মসজিদ নামে পরিচিত। এতে যে জায়গা রয়েছে, তাতে বড়জোর ১২ জন মানুষ নামায আদায় করতে পারে। ফলে এটিই বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে ছোট মসজিদ বলা যায়। সে প্রতিবেদনে বলা হয়, মসজিদটি একটি পাহাড়ের ওপর হযরত সাইয়েদ শাহ ইমাদ উদ্দিন মোহাম্মদ মাহমুদ আল হুসাইনির দরগায় অবস্থিত। স্থানটি মির মাহমুদের পাহাড় নামেও পরিচিত। স্থানটি খুবই সুন্দর এবং এ দরগায় সুফিবাদের নিদর্শন পাওয়া যায়।
৪০০ বছর আগে নির্মিত এ জিন মসজিদ বর্তমানে অবহেলা ও অযত্নের শিকার হয়েছে। এ মসজিদের মুতাওয়াল্লী ড. মুহাম্মদ সফিউল্লাহ জানান, এ মসজিদটির আয়তন মাত্র ১০ বর্গমিটার। এতে একটি মিম্বর ও একটি মেহরাব রয়েছে। মুয়াজ্জিন একটি বিশেষ পথ ব্যবহার করে মসজিদের উপরের অংশে ওঠে এতে আযান দেন। ইতিহাস রক্ষায় আগ্রহী একটি দল, যারা এ মসজিদটিকে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুদ্র মসজিদের স্বীকৃতি দিতে চাইছেন, তারা শীঘ্রই এ উপলক্ষে একটি ‘ঐতিহ্য রক্ষায় হাঁটা’ কর্মসূচির ঘোষণা করেছেন।