Home করোনা আপডেট খাদ্যাভ্যাস ও জীবনশৈলী করোনা থেকে বাঁচাতে পারে

খাদ্যাভ্যাস ও জীবনশৈলী করোনা থেকে বাঁচাতে পারে

ড.‌ জয়ন্ত চৌধুরি ও ড.‌ প্রভাত মণ্ডল: বহু মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন, সুস্থ হয়ে উঠছেন অনেকে। আবার যঁাদের রোগ–‌প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তঁাদের অনেকের প্রাণও চলে যাচ্ছে। যত দিন না প্রতিষেধক মিলছে, তত দিন শক্তিশালী রোগ–‌প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউনিটি সিস্টেমই করোনার মতো অতিমারীর সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে সাহায্য করবে।
পুষ্টি ও রোগ–‌প্রতিরোধ ক্ষমতা
শরীর সুস্থ রাখতে পুষ্টিকর খাদ্যের বিকল্প নেই। নানা কারণে ভারতের মানুষ অপুষ্টিতে ভোগেন। সমীক্ষায় দেখা গেছে, ভারত, ইওরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মতো দেশে প্রায় ৫৫% মানুষ, যঁাদের বয়স পঞ্চাশের বেশি, তঁারা এক বা একাধিক ভিটামিন ও ট্রেস এলিমেন্টসের অভাবে ভুগে থাকেন। এর জন্য মূলত খাদ্যাভ্যাস ও জীবনশৈলী অনেকটাই দায়ী। আর ঠিকঠাক পুষ্টির অভাব এঁদের ইমিউনিটি সিস্টেমকে বিগড়ে দেওয়ার ফলে  শ্বাসনালী, মূত্রনালী এমনকী যৌননালীও সহজেই সংক্রমণের কবলে পড়ে।
হালফিল কিছু গবেষণা বলছে, হাই–‌রিস্ক গ্রুপে যঁারা রয়েছেন, তঁাদের প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি, দু’‌ধরনের সংক্রমণ প্রতিরোধেই চমকপ্রদ বেশ কিছু সম্ভাবনা আছে। একটি সুষম খাদ্য–‌তালিকা বানিয়ে সেই অনুযায়ী খাবারদাবার খেলে তা শ্বাসনালী–‌সহ অন্যান্য অঙ্গের সংক্রমণ যেমন ঠেকাতে পারে, পাশাপাশি মুড়িমুড়কির মতো অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার প্রয়োজন ও ঝুঁকি অনেকটাই কমিয়ে দেয়।
এনার্জি ও প্রোটিন
শরীরের ভেতরে কোষগুলি সচল থাকলে শরীরও সচল থাকে। আর কোষগুলি সচল থাকে পর্যাপ্ত পুষ্টি পেলে। এটি ইমিউনিটি সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত কোষগুলির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাই কোষগুলিতে পর্যাপ্ত পুষ্টির সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারলেই প্রাকৃতিক ভাবে রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করা যায় গাদাগুচ্ছের ওষুধ না খেয়ে। এর জন্য প্রচুর এনার্জি ও প্রোটিনের প্রয়োজন, যা রোজকার খাবার, যেমন ভাত, রুটি ও নানা উদ্ভিজ্জ ও প্রাণিজ প্রোটিন থেকেই পাওয়া যেতে পারে। প্রোটিন, বিশেষত আরজিনিন ও গ্লুটামিনের মতো অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড–সমৃদ্ধ খাবার রোগ–‌প্রতিরোধী কোষ নিউট্রোফিল, ম্যাক্রোফেজ ও লিম্ফোসাইট তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
ভিটামিন ডি
শরীরের রোগ–‌প্রতিরোধী কোষগুলির মধ্যে ভিটামিন ডি রিসেপ্টর (VDR) বলে এক ধরনের নিউক্লিয়ার রিসেপ্টর থাকে। এগুলি রোগ–‌প্রতিরোধী কোষের কার্যকারিতায় সহায়ক হয়। পাশাপাশি ভিটামিন ডি–‌কে সক্রিয় করার মতো কিছু এনজাইম থাকে, যা জীবাণু–‌প্রতিরোধী প্রোটিন বা অ্যান্টিবডি তৈরিতে সাহায্য করে। তাই রোজ এক থেকে দু’‌ঘণ্টা সূর্যালোকে কাটাতে পারাটা শরীরের প্রয়োজনীয় ভিটামিন ডি তৈরির জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।
প্রোবায়োটিক
দই, ইয়োগার্ট বা ফার্মেন্টেড সবজি কিংবা মাংস খাদ্য–তালিকায় রাখলে এগুলির মাধ্যমে ল্যাকটোব্যাসিলাই ও বাইফিডোব্যাকটেরিয়া জাতীয় জীবাণু প্রবেশ করে, যা মানবশরীরে গ্রানুলোসাইট কোষগুলির ফ্যাগোসাইটিক অ্যাক্টিভিটি বাড়ায়। ফলে রক্তের মধ্যে স্বাভাবিক ইমিউনিটি তৈরি হয়।
প্রিবায়োটিক
ইনসুলিন, ল্যাকটুলোজ, ফ্রুক্টো ‌অলিগোস্যাকারাইড–‌সমৃদ্ধ ফাইবার–‌জাতীয় খাদ্য নিলে অন্ত্রের উপকারী জীবাণুর পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, ফলে রোগ–‌প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। এ ছাড়া প্রিবায়োটিক ও প্রোবায়োটিক মিশিয়ে তৈরি সিমবায়োটিকেরও উপকারী ভূমিকা রয়েছে। প্রিবায়োটিক–‌সমৃদ্ধ খাদ্যের মধ্যে পেঁয়াজ, রসুন, গোটা শস্যদানা (ভুট্টা, জোয়ার), শুঁটি–‌জাতীয় দানা (ছোলা, মটর) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট
সেলেনিয়াম, জিঙ্ক, ভিটামিন এ, সি ইত্যাদি ইমিউনিটি সিস্টেমের বিভিন্ন উপাদানকে প্রভাবিত করে। এই ধরনের মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের অধিকাংশই খাদ্যের বিভিন্ন প্রাকৃতিক উৎস, যেমন সবুজ পাতাবহুল সবজি, ফল, অন্যান্য সবজি এবং জোয়ার, ভুট্টার দানা ইত্যাদির মধ্যে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। এ ছাড়াও কিছু প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, যেমন ব্রেকফাস্ট সিরিয়াল্‌স, ফলের রস, ডেয়ারি প্রোডাক্টও এগুলির চমৎকার উৎস।
ডায়েটারি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট
ইমিউনিটি সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত কোষগুলি কাজ করে নিরন্তর পরস্পরের সঙ্গে সঙ্কেত আদানপ্রদানের মাধ্যমে নিবিড় সংযোগ রেখে। এই সংযোগে ছেদ পড়া মানে সিস্টেমটাই নড়বড়ে হয়ে যাওয়া। অক্সিডেশন এমন এক সমস্যা, যা কোষ ও কলার ক্ষতির মতো অপকর্মটি হামেশাই ঘটিয়ে থাকে। এর থেকে রেহাই পেতে আ্যন্টিঅক্সিডেন্টের জুড়ি মেলা ভার। তাই খাদ্য–‌তালিকায় প্রচুর পরিমাণ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকা উচিত, যা নানা রকম ফল, সবজি, সবুজ শাক ও শস্যদানার মধ্যে বিস্তর মেলে।
চা খুব উপকারী
চায়ের ওষধি গুণের কথা তো প্রায় পঁাচ হাজার বছর আগেই মানুষ টের পেয়েছিল। চায়ের মধ্যেকার রাসায়নিক উপাদানগুলি, যেমন পলিফেনল, ফ্লেভোনয়েডস, কিছু অ্যামাইনো অ্যাসিড ও সর্বোপরি ক্যাফেইন— এগুলির অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গুণের সঙ্গে আরও অনেক উপকারী ভূমিকা রয়েছে। যেমন ব্যথা ও ফোলা কমাতে, জীবাণু প্রতিরোধে এবং ডাই ইউরেটিক বা মূত্রবর্ধক হিসেবে চা দারুণ কাজ করে। করোনার ক্ষেত্রে চায়ের আর–একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সম্পর্কে জানা জরুরি, যার নাম থিওফাইলিন। হঁাপানির মতো শ্বাসযন্ত্রের রোগের চিকিৎসায় এই উপাদানটি ব্যবহারের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে।
যোগ, মেডিটেশন
শরীর–মনকে সুস্থ রাখতে হরেক যোগব্যায়াম ও মেডিটেশনের চল রয়েছে। এগুলি রোগের লক্ষণ কমাতে ও জীবনযাত্রা মসৃণ রাখতে সাহায্য করে। উপযুক্ত প্রশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে এগুলি ঠিকমতো করতে পারলে নানা শারীরিক ও মানসিক রোগ, যেমন গর্ভাবস্থায়, শিশু–‌জন্মের আগে ও পরে মায়ের মানসিক অবসাদ, স্ট্রেস, উত্তেজনা এবং ওবেসিটির প্রভাবকে দূরে সরিয়ে রাখা যায় সহজেই। এ ছাড়া হাইপারটেনশন, বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রণা, আর্থ্রাইটিস, মাথা বা পিঠের ব্যথা, হঁাপানি, টাইপ–‌টু ডায়াবেটিস, এইচআইভি, ব্রেস্ট ক্যান্সার, বয়সজনিত সমস্যা যেমন এজিং, অস্টিয়োপোরোসিস এবং পার্কিনসন্‌সে আক্রান্তদের খানিক উপশম দিতেও যোগব্যায়াম ও মেডিটেশনের উপযোগিতার কথা সকলেরই জানা। তাই দিনে অন্তত ৩০ মিনিট যদি যোগব্যায়াম ও মেডিটেশনের জন্য খরচ করা যায়, শরীরের জন্য লাভের অঙ্কটা বাড়ে বইকী।
ঘুম বাড়ায় প্রতিরোধ ক্ষমতা
ঘুমের সঙ্গে রোগ–‌প্রতিরোধ ক্ষমতার গভীর সম্পর্ক আছে। অনিদ্রা শরীরকে সংক্রমণপ্রবণ করে ফেলে। রোজকার ঘুমের সামান্যতম ব্যাঘাতও ইমিউনিটি সিস্টেমের অন্যতম সৈনিক লিউকোসাইটের সংবহনে ব্যাপক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। তাই সুস্থ–‌স্বাভাবিক জীবনের জন্য পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও গভীর ঘুম খুব দরকার।
কী করণীয়
‌■ রোজ মাংস, চিকেন, মাছ, ডিম, দুধ ও অন্যান্য ডেয়ারি প্রোডাক্ট, ডাল, বিন্‌স, বাদামের মতো প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার ঘুরিয়ে–‌ফিরিয়ে খেতে হবে।
‌■ যখন যেমন পাওয়া যাবে, মুসম্বি, কমলালেবু, পাতিলেবু, আনারস, কলা, আপেল, পেয়ারা, পাকা পেঁপে ও অন্যান্য ফল খাওয়া চাই। গুরুত্ব দিতে হবে টক ও লেবু–‌জাতীয় ফলকে।
‌■ কঁাচা হলুদ, আদা, রসুন, এলাচ, দারুচিনি, তুলসী ও কালোজিরে করোনা–‌রোধে কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে।
‌■ বেশি করে সবজি ও স্যালাড (টম্যাটো, শসা, গাজর, ক্যাপসিকাম, মুলো ও পেঁয়াজ) খেতে হবে।
‌■ সকালে পাতিলেবুর রস ও মধু–‌মেশানো ঈষদুষ্ণ জল পান করা যেতে পারে।
‌■ সিগারেট ও মদ্যপান এড়িয়ে চলুন।
‌■ আইসক্রিম, ঠান্ডা পানীয়, হোটেল–‌রেস্তোরঁা বা অনুষ্ঠানবাড়িতে খাওয়া পারতপক্ষে নয়।
‌■ নিয়মিত ব্যায়াম, যোগ, প্রাণায়াম মনকে সুস্থ রাখতে পারে।
‌■ রোজ সকালে–‌বিকেলে বাড়ির উঠোন, ব্যালকনি বা ছাদে একটু হঁাটাহঁাটি করলে শরীরে ভিটামিন ডি–‌র অভাব মিটতে পারে।
■ পর্যাপ্ত ‌বিশ্রাম ও ঘুম ইমিউনিটি সিস্টেমকে চাঙ্গা করে।
■ মোবাইল ও সোশ্যাল মিডিয়ার পরিমিত ব্যবহার কাম্য।
■ মানসিক স্থিতি টলিয়ে দিতে পারে, এমন ভুয়ো খবর এড়িয়ে চলতে হবে। হু, আইসিএমআর বা অন্যান্য কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারি নিয়ামক সংস্থার পরামর্শ মেনে চলতে হবে।
■ চা চলবে। চীনে করোনার বিরুদ্ধে চা পানের কার্যকারিতার প্রমাণ মিলেছে।
■ সংক্রমিত হলে প্রচুর জল, ডাবের জল, মুসম্বি ও লেবুর রস খেতে হবে।
■ অযথা উদ্বেগ, ভয় ও উত্তেজনা রোগ–‌প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। নেতিবাচক মনোভাব ছেড়ে মনকে শক্ত রাখতে হবে।

-দৈনিক আজকাল